বাংলাদেশের সাভারে রানা প্লাজা ধসের ১৭ দিনের মাথায় জীবিত অবস্থায় গার্মেন্টস কর্মী রেশমাকে উদ্ধারের পর, এখন এ নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে৷ বিতর্ক হয়েছে সংসদে৷ আর এই বিতর্কে এখন কথা বলছেন সাংবাদিকরাও৷
বিজ্ঞাপন
গত রবিবার যুক্তরাজ্যের ট্যাবলয়েড ‘সানডে মিরর' ১৭ দিন পর ধংসস্তূপের নীচ থেকে রেশমাকে উদ্ধারের ঘটনাকে ‘সাজানো নাটক' বলে প্রতিবেদন প্রকাশ করে৷ এর এক সপ্তাহ আগে বাংলাদেশের ‘দৈনিক আমার দেশ' তাদের অনলাইন সংস্করণে একই ধরণের প্রতিবেদন প্রকাশ করে৷ দুটি প্রতিবেদনই বলা হয় যে, রানা প্লাজা ধসের দিনই রেশমা তাঁর এক পুরুষ সহকর্মীর সঙ্গে বেরিয়ে আসেন৷ এরপর তাঁকে সাভারের এনাম মেডিকেলে দুই দিন চিকিত্সা দেয়া হয়৷ তাই ১৭ দিন পর রেশমাকে উদ্ধারের ঘটনা একটি ‘সাজানো নাটক'৷ তবে প্রতিবেদনে রেশমার সহকর্মীর নাম বা পরিচয় প্রকাশ করা হয়নি৷
মৃত্যুকূপ থেকে যেভাবে ফিরলেন রেশমা
সাভারে ধসে পড়া ভবন থকে ১৭ দিন পর উদ্ধার করা হয় জীবিত রেশমাকে৷ এই সতের দিন তিনি কিভাবে কাটিয়েছেন? প্রশ্ন অনেকের মনে৷ চলুন উত্তর খোঁজা যাক৷
ছবি: Getty Images/AFP/STRDEL
সুস্থ আছেন রেশমা
সাভারে ধসে পড়া ভবন থকে ১৭ দিন পর উদ্ধার করা হয় জীবিত রেশমাকে৷ তিনি এখন সুস্থ আছেন৷ কিন্তু ধসে পড়া রানা প্লাজার মধ্যে কিভাবে সতের দিন কাটিয়েছেন তিনি? প্রশ্ন অনেকের মনে৷ চলুন ছবিতে উত্তর খোঁজা যাক৷
ছবি: Reuters
উদ্ধার অভিযান
১০ মে স্থানীয় সময় বিকেল সোয়া ৩টার দিকে সেনাবাহিনীর উদ্ধারকর্মী রাজ্জাক ধসে পড়া ভবনের মধ্যে বেঁচে থাকা একজন মানুষের উপস্থিতি টের পান৷ সেই মানুষটি রেশমা৷ তিনি একটি ভাঙা পাইপ দিয়ে নিজের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করেন এবং তাঁকে বাঁচানোর অনুরোধ জানান৷ এরপর রড কেটে ভিতরে ঢুকে বিকেল ৪টা ২৫ মিনিটে রেশমাকে বাইরে নিয়ে আসা হয়৷
ছবি: Getty Images/STRDEL
যেভাবে টিকে ছিলেন রেশমা
১৭ দিন রেশমা কি খেয়ে টিকে ছিলেন সেই প্রশ্ন অনেকের৷ উদ্ধারকর্মী রাজ্জাক জানান, ‘‘রেশমা যে তলায় আটকে ছিলেন সেটা অন্যান্য তলার মতো মিশে যায়নি৷ সেখানে হাঁটা-চলা এবং নড়া-চড়া করার কিছুটা সুযোগ ছিল৷ রেশমা তাঁকে জানান যে, ঐ জায়গায় বিভিন্ন ধরনের শুকনা ও জুস জাতীয় খাবার ছিল, যা তিনি খেয়েছেন৷ ৭ মে শুকনা খাবার শেষ হয়ে যায় আর রসালো খাবার যায় পচে৷ ফলে শেষের দু’দিন ধরে তিনি অভুক্ত ছিলেন৷’’
ছবি: Getty Images/AFP/STRDEL
চিকিৎসকের ব্যখ্যা
ধ্বংসস্তূপের নীচে রেশমার এই ১৭দিন বেঁচে থাকার ঘটনাকে ডয়চে ভেলের কাছে ব্যাখা করেছেন মিটফোর্ড হাসপাতালের চিকিত্সক অধ্যাপক ডা. মনি লাল আইচ৷ তিনি বলেন, ‘‘রেশমা ১৭ দিনে হৃদরোগ বা নিউরোলোজিক্যাল সমস্যায় পড়তে পারতেন৷ হয়ত মানসিক জোর এবং বেঁচে থাকার প্রবল ইচ্ছার কারণেই তাঁকে সেই সমস্যায় পড়তে হয়নি৷ আর গবেষণায় প্রমাণিত যে নারীদের মানসিক চাপ সহ্য করার ক্ষমতা পুরুষের তুলনায় অনেক বেশি৷’’
ছবি: Reuters
গোটা বিশ্বে আলোড়ন
রেশমাকে ১৭ দিন পর জীবিত উদ্ধারের খবরে গোটা বিশ্বে আলোড়ন সৃষ্টি হয়৷ বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দ্রুত সাভারে সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে এই তরুণীকে দেখতে যান৷ রেশমাকে কেউ যাতে মানসিকভাবে পীড়া না দেয় সেজন্যও সবাইকে নির্দেশনা দেন শেখ হাসিনা৷
ছবি: dapd
তৃতীয় নারী রেশমা
১৭ দিন ধরে অন্ধকারে ডুবে থাকা রেশমাকে উদ্ধারের খবরের সঙ্গে একটি পরিসংখ্যান প্রকাশ করে বিবিসি৷ এতে দেখা যাচ্ছে, এর আগে পাকিস্তানে একই রকম পরিস্থিতিতে নাকাশা বিবি নামক এক নারী পচা খাবার আর পানি খেয়ে টিকে ছিলেন ৬৩ দিন৷ আর হাইতির ইভান্স মোনসিজনাক টিকে ছিলেন ২৭ দিন৷ এই সময়ের পর তাদের জীবিত উদ্ধার করা হয়৷
ছবি: Getty Images
পরিবারের সঙ্গে দেখা
রেশমার মা জোবেদা খাতুন, দুই ভাই ও বোন আসমা গত কয়েকদিন ধরেই রয়েছেন সাভারে৷ হাসপাতালে রেশমার সঙ্গে দেখা করেছেন তারা৷ রেশমার বড় ভাই জাহিদুল ইসলাম জানিয়েছেন, ‘‘বর্তমানে রেশমা ভালো আছে, সুস্থ আছে৷’’
ছবি: Reuters
বাড়ছে মৃতের সংখ্যা
এদিকে, সাভারে ভবন ধসে মৃতের সংখ্যা ক্রমশ বেড়েই চলেছে৷ গত ২৪ এপ্রিল ভবন ধসের পর ১২ মে অবধি উদ্ধার করা হয়েছে ১,১২৭ টি মৃতদেহ৷ নিহতদের মধ্যে ঠিক কতজন নারী আর কতজন পুরুষ – সেই হিসেব এখন আরা জানা যাচ্ছে না৷ অনেক মরদেহ পচে গেছে৷ গোটা বিশ্বে স্মরণকালের মধ্যে ভয়াবহতম ভবন ধস এটি৷
ছবি: picture-alliance/dpa
তবুও কি সতর্ক আমরা?
সাভার ভবন ধসের পর কতটা সতর্ক হয়েছে বাংলাদেশ? এই প্রশ্ন অনেকর মনে৷ বিশেষ করে, যে পোশাক খাত বাংলাদেশকে গোটা বিশ্বের কাছে পরিচিত করে তুলছে, সেই খাতের শ্রমিকদের নিরাপত্তায় সরকার কতটা সচেষ্ট? সর্বশেষ খবর হচ্ছে, শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে সরকার৷ রানা প্লাজা ধসের পর পোশাক শিল্পের যে নেতিবাচক ‘ইমেজ’ তৈরি হয়েছে, তা থেকে বেরিয়ে আসতেই এই পদক্ষেপ৷
ছবি: Reuters
‘আমাদের ব্যর্থতার প্রতীক’
শান্তিতে নোবেল জয়ী বাংলাদেশের অর্থনীতিবিদ প্রফেসর মোহাম্মদ ইউনূস গত ৯ মে একটি নিবন্ধের একাংশে লিখেছেন, ‘‘সাভার ট্র্যাজেডি জাতি হিসেবে আমাদের ব্যর্থতার প্রতীক৷ রানা প্লাজার ফাটল ফেটে ভবন ধসে দেখিয়ে দিলো আমাদের রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় যে বিশাল ফাটল ধরেছে সেটা আমলে না নিলে জাতিও এরকম ধসের ভেতর হারিয়ে যাবে৷’’
ছবি: AP
10 ছবি1 | 10
এ নিয়ে জাতীয় সংসদে মঙ্গলবার বিতর্ক হয়েছে৷ বিএনপির সংসদ সদস্য এবং বিরোধী দলের ভারপ্রাপ্ত চিফ হুইপ শহীউদ্দিন চৌধুরী এ্যানি সংসদে বলেছেন, সরকার রানা প্লাজা ধসের দায়-দায়িত্ব থেকে বাঁচতে এই নাটক সাজিয়েছে৷ সরকারের উচিত আসল ঘটনা প্রকাশ করা৷ এর জবাবে কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী বলেন, মিররের রিপোর্টই সাজানো নাটক৷ আর এই ট্যাবলয়েড পত্রিকার কাজই হলো গাল-গল্প প্রচার করে কাটতি বাড়ানো৷ তিনি বলেন, রেশমাকে উদ্ধারের ৫০ দিন পর মিররের সাংবাদিক সাইমন রাইট এই রিপোর্টটি করেছেন৷ হলুদ সাংবাদিকতার কারণে দাক্ষিণ আফ্রিকায় একবার গ্রেপ্তারও হয়েছিলেন তিনি৷
বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল এটিএন বাংলার বার্তা প্রধান জ ই মামুন ডয়চে ভেলেকে বলেন, মিররের রিপোর্টের সত্যতা নিয়ে তাঁর প্রশ্ন আছে৷ তারা যে সব তথ্যের ভিত্তিতে বলছে যে, রেশমা উদ্ধার সাজানো নাটক – সেসব তথ্য তারা প্রমাণসহ হাজির করতে পারেনি৷ আর রেশমার সহকর্মীর কোনো পরিচয় প্রকাশ না করায় রিপোর্টের গ্রহণযোগ্যতা প্রশ্নের মুখে৷ তিনি বলেন, রিপোর্টে সাভারের যে এনাম মেডিকেলে রেশমার চিকিত্সা নেয়ার কথা বলা হয়েছে সেই এনাম মেডিকেলে এটিএন বাংলাও অনুসন্ধান করেছে৷ সেখানে রেশমার ভর্তির কোনো কাগজ পত্র নেই৷ আর মিররও কোনো কাজপত্র বা হাসপতাল কর্তৃপক্ষের বক্তব্য হাজির করতে পারেনি৷ তাহলে তথ্য-প্রমাণ ছাড়া মিরর কিভাবে একে ‘সাজানো নাটক' বলে? তাঁর মতে, ট্যাবলয়েড পত্রিকার বৈশিষ্ট্যই এরকম৷ তাই জ ই মামুনের প্রশ্ন, মিরর জানালো আর বাংলাদেশের সাংবাদিকরা জানলো – না এটা কিভাবে সম্ভব? তিনি বলেন, মিরর যদি রেশমার সহকর্মীকে হাজির করতে পারে তাহলে তাঁর কথা প্রচার করবে এটিএন বাংলা৷
একুশে টেলিভিশনের প্রধান বার্তা সম্পাদক ইব্রাহিম আজাদ ডয়চে ভেলেকে বলেন, মিররের রিপোর্ট একটি বিতর্ক তৈরি করেছে৷ তবে বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য কোনো সংবাদমাধ্যমে এ নিয়ে কোনো খবর তাঁর চোখে পড়েনি৷ এখন মিররেরই দয়িত্ব হলো নিজেদের রিপোর্ট প্রমাণ করা৷ তিনি অবশ্য মনে করেন, রেশমা সংক্রান্ত সব তথ্য প্রকাশ করলেই বিতর্কের অবসান ঘটবে৷ তিনি মনে করেন, এ নিয়ে যদি কেউ অনুসন্ধান করতে চান তাহলে সরকারের উচিত হবে সব ধরণের তথ্যে প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করা৷
এদিকে সাভার এনাম মেডিকেলের পরিচালক (জনসংযোগ) জাহিদুর রহমান ডয়চে ভেলেকে জানান যে, তারা রানা প্লাজা ধসের পর পর ১,৭০০ জনকে চিকিত্সা দিয়েছেন৷ ধসের পর জরুরি চিকিত্সার কারণে প্রথম দিকে অনেকের নাম-ঠিকানাই তারা ঠিকভাবে লিখতে পারেননি৷ তবে পরে যাঁদের নাম ঠিকানা ঠিকভাবে লেখা হয়েছে, তাঁদের মধ্যে রেশমা নামে কেউ নেই৷ আর যাঁদের নাম-ঠিকানা রাখা যায়নি, তাঁদের মধ্যে রেশমা নামে কেউ ছিলেন কিনা, তা তাদের পক্ষে বলা সম্ভব নয়৷
তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু বলেছেন, রেশমাকে উদ্ধার করা হয় সবার সামনে৷ কোনো কোনো টেলিভিশন চ্যানেল তা সরাসরি সম্প্রচারও করে৷ তাই এ নিয়ে কোনো লুকোচুরি বা গোপনীয়তার কিছু নেই৷
গত ২৪শে এপ্রিল রানা প্লাজা ধসের ঘটনায় মোট ১,১৩১ জন নিহত হন৷ ধসের ১৭ দিন পর ১০ই মে রেশমাকে উদ্ধারের ঘটনা বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বে আলোড়ন সৃষ্টি করে৷