জাতীয় সরকারের দাবিতে আন্দোলন, পারবে কি ঐক্যফ্রন্ট?
হারুন উর রশীদ স্বপন ঢাকা
২৯ সেপ্টেম্বর ২০১৯
সরকারের পদত্যাগ এবং জাতীয় সরকারের দাবিতে আন্দোলনে যাচ্ছে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট৷ তারা মনে করছে দেশে এখন জাতীয় সরকারের কোনো বিকল্প নেই৷ কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট এই দাবি আদায়ে আন্দোলন কতটুকু জমাতে পারবে?
বিজ্ঞাপন
শনিবার বৈঠকের পর এক বিবৃতিতে ঐক্যফ্রন্ট সরকারের পদত্যাগ এবং জাতীয় সরকার গঠনের দাবি জানিয়েছে৷ সেই সঙ্গে খালেদা জিয়ার মুক্তি এবং শাসনতান্ত্রিক সংকট নিরসনে জাতীয় সংলাপের দাবিও করা হয়৷ কিন্তু এই বৈঠকে বিএনপির কোনো প্রতিনিধি ছিলেন না৷ তবে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর টেলিফোনে যুক্ত ছিলেন বলে ঐক্যফ্রন্টের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে৷
৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনের পর ঐক্যফ্রন্ট কোনো আন্দোলন গড়ে তুলকে পারেনি৷ এমনকি ফ্রন্টের অন্তর্ভূক্ত দল থেকে যারা নির্বাচিত হয়েছেন তাদের শপথ না নেয়ার সিদ্ধান্ত থাকলেও শেষ পর্যন্ত মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ছাড়া আর সবাই শপথ নিয়েছেন৷ ফ্রন্টের শরীক দলগুলোর মধ্যে দূরত্বও বাড়ছে৷ কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ ফ্রন্টে আর আছে কিনা তা স্পষ্ট নয়৷ এই অবস্থায় সরকারের পদত্যাগ ও জাতীয় সরকারের দাবি নিয়ে কতটুকু তারা যেতে পারবেন? প্রশ্নের জবাবে ঐক্যফ্রন্টের অন্যতম নেতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনের পর আমরা সরকারকে সময় দিয়েছি৷ আমরা দেশে রক্তস্রোত বয়ে যাক সেটা চাইনি৷ আমরা চেয়েছি দেশে একটা শান্তিপূর্ণ অবস্থা বজায় থাকুক দেশের মানুষ শান্তিতে থাকুক৷ আমরা চেয়েছি শান্তিপূর্ণভাবে সমস্যার সমাধান৷''
ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী
তিনি বলেন, ‘‘এখন তো সব কিছু বেরিয়ে আসছে৷ দুর্নীতি অপকর্ম সব প্রকাশ পাচ্ছে৷ আমরা যা বলেছিলাম তাই হয়েছে৷ দেখা যাচ্ছে পুলিশও এসব অপরাধে জড়িয়ে পড়েছে৷ হাসিনা সরকার এখন গন্ধ দূর করতে চাইছে৷ তাই লোক দেখানো অভিযান চালানো হচ্ছে৷ আসলে এতে পরিস্থিতির উন্নতি হবেনা৷ তাই আমরা চাই সরকার পদত্যাগ করুক৷ একটি জাতীয় সরকার গঠন করে এইসব বিষয়ের সমাধান করতে হবে৷''
বিএনপিও মনে করে আন্দোলন তীব্র করার সময় এসেছে৷ এখন দেশের যা পরিস্থিতি তাতে আন্দোলন বেগবান করার কোনো বিকল্প নাই৷ সেটা কীভাবে করা যায় তা নিয়ে বিএনপিও সমমনা দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করছে৷ সামনে যেকোনো একটা ইস্যুতে এর প্রকাশ ঘটাতে চাচ্ছে তারা৷ তাই চলমান ক্যাসিনো বিরোধী অভিযান তারা সতর্কতার সঙ্গে পর্যবেক্ষণ করছে৷ বিএনপি'র ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদু ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘এই অভিযানে স্পষ্ট যে, যারা দুর্নীতিতে জড়িত তারা সবাই আওয়ামী লীগের৷ ফলে এই সরকার দিয়ে দেশ পরিচালনা সম্ভব নয়৷ ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচন কোনো নির্বাচন নয়৷ তারপরও তারা ক্ষমতা ধরে আছে৷ এর অবসান হওয়া প্রয়োজন৷''
ড. রেজা কিবরিয়া
তিনি বলেন,‘ ঐক্যফ্রন্ট জাতীয় সরকারের কথা বলছে৷ আমরা শুরু থেকেই নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের কথা বলছি৷ বিএনপি ঐক্যফ্রন্টের শরীক দল৷ শনিবারের বৈঠকে আমাদের কেউ উপস্থিত না থাকলেও তারা যে দাবি দিয়েছে তার সঙ্গে আমরা একমত৷ সামনে আমাদের সাথে আরো আলোচনা হবে৷ আমরা আন্দোলনকে আরো কীভাবে বেগবান করতে পারি তার কৌশল নির্ধারণ করা হবে৷ বিএনপিতো আন্দোলনে আছেই৷ এখন এটাকে ঐক্যফ্রন্টকে সাথে নিয়ে আরো কীভাবে গতি আনা যায় তা নিয়ে কাজ হচ্ছে৷ সরকারের সাথে আগে আলোচনাও হতে পারে৷''
আর গণফোরামের সাধারণ সম্পাদক ড. রেজা কিবরিয়া বলেন, ‘‘আমরা মাঠে নামছি না বলে কথা আছে৷ কিন্তু আমাদের নেতা-কর্মীদের মামলা দিয়ে, নির্যাতন চালিয়ে হয়রানি করা হচ্ছে৷ সাদ্দামের সময়, গাদ্দাফির সময়ও লোকজনকে রাস্তায় নামতে দেয়া হতো না৷ এই সরকার একটা স্বৈরাচারী সরকার৷ মানুষকে অত্যাচার করে ক্ষমতা দখল করে আছে৷ এজন্য আমাদের আন্দোলন করতে সময় লাগবে, কিন্তু আমরা সেটা করবো৷ এখন সমাবেশের অনুমতি দেয়া হয় না৷ দিলেও দু'ঘণ্টা আগে৷ আমাদের সমাবেশ করতে দেয়া হোক, দেখবেন লাখ লাখ লোক রাস্তায় নেবে আসবে৷''
তিনি কর্মসূচি প্রসঙ্গে বলেন, ‘‘আমরা সব এখনই বলছি না৷ তবে দ্রুতই তা দৃশ্যমান হবে৷''
মামলা যখন হয়রানির জন্য
কেউ অপরাধ করলে তার বিরুদ্ধে মামলা হবে৷ সে অনুযায়ী তদন্ত ও বিচার হবে এমনটাই স্বাভাবিক৷ কিন্তু এর ব্যতিক্রমও হয়৷ অপরাধ না করেও মামলায় ফাঁসছেন অনেকে৷ এমন অনেক অভিযোগ আছে৷ অনেক মামলার অভিযোগ হাস্যরসও তৈরি করে৷
ছবি: bdnews24.com
হাস্যকর মামলার একাল-সেকাল
জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় আসার পর বঙ্গভবনের কাপ, পিরিচ চুরির মামলা দেন মোশতাকের বিরুদ্ধে৷ ট্রাইব্যুনালের বিচারে তাঁর তিন বছরের জেল ও এক লাখ টাকা জরিমানা হয়৷ অব্যাহতি পান ১৯৭৯ সালে ৷ জোট সরকারের আমলে আওয়ামী লীগ নেতা সাবের হোসেন চৌধুরীর বিরুদ্ধে দেয়া হয়েছিল প্লেট চুরির মামলা৷ শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী এহসানুল হক মিলনের বিরুদ্ধে ভ্যানিটি ব্যাগ, স্বর্ণের নেকলেস ছিনতাইয়ের অভিযোগ আনা হয়েছিল মহাজোট সরকারের আমলে৷
ছবি: Fotolia/Mehmet Dilsiz
মৃত ব্যক্তিও আসামি!
২০১৭ সালে ডেঙ্গুতে মারা যান চট্টগ্রামের বিএনপি কর্মী জসিম৷ ২০১৮ সালের অক্টোবরে পুলিশের উপর ককটেল ছুড়ে মারার মামলা হয় তাঁর বিরুদ্ধে৷ ঢাকার চকবাজার থানা বিএনপির আহবায়ক আব্দুল আজিজুল্লাহ মারা গেছেন ২০১৬ সালের মে মাসে৷ প্রায় আড়াই বছর পর তাঁর বিরুদ্ধেও ককটেল ছোড়ার অভিযোগ আনে পুলিশ৷
ছবি: bdnews24.com
অন্ধ প্রবীণের অগ্নিসংযোগ, পঙ্গু ব্যক্তির হামলা!
৭০ বছর বয়স, নেই দৃষ্টিশক্তি৷ তবুও জাতীয় নির্বাচনের আগে ময়মনসিংহের মুক্তাগাছায় গাড়ি পোড়ানো মামলার আসামি করা হয়েছিল কেরামত আলীকে৷ শারীরিক প্রতিবন্ধী সুনামগঞ্জের তারা মিয়ার বিরুদ্ধেও চাপাতি হকস্টিক নিয়ে পুলিশের বিরুদ্ধে হামলার অভিযোগে মামলা করা হয়েছিল প্রায় একই সময়ে৷ ভোটকেন্দ্র দখলের অভিযোগ আনা হয়েছে আশি বছরের প্রৌঢ়ের বিরুদ্ধেও৷ নির্বাচনের আগে পরে এমন অনেক মামলার খবরই এসেছে বাংলাদেশের গণমাধ্যমে৷
ছবি: Reuters
অজ্ঞাতনামা মামলা
কোনো একটি ঘটনা ঘটলে সেখানে চিহ্নিত ব্যক্তিদের পাশাপাশি নামহীন সংখ্যা দিয়েও অনেককে আসামি করা হয়, যা পরিচিত অজ্ঞাতনামা মামলা হিসেবে৷ সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে এমন অনেক মামলা হয়েছে৷ এধরণের মামলায় বিরোধী দলের কর্মীসহ সাধারণ মানুষকে হয়রানি ও পুলিশের বিরুদ্ধে বাণিজ্যের অভিযোগ আছে৷
ছবি: picture alliance/ZUMA Press/Shariful Islam
নির্বাচনের আগে মামলা
সবশেষ জাতীয় নির্বাচনের আগে বিরোধী দলের বিরুদ্ধে ৪,৪২৯টি মামলা করা হয়েছে৷ যাতে ৪ লাখ ৩৪ হাজার ৯৭৫ জনকে আসামি করা হয় বলে অভিযোগ করেছে বিএনপি৷
ছবি: AFP/Getty Images/M. Uz Zaman
কোটা বিরোধী আন্দোলন
সরকারি চাকরিতে কোটা পদ্ধতির সংস্কারের দাবিতে ২০১৮ সালে আন্দোলন তুঙ্গে উঠে বাংলাদেশে৷ এসময় ৭০০ জনের বিরুদ্ধে অজ্ঞাত মামলা করা হয় বলে খবর বের হয় গণমাধ্যমে৷ পরে অনেককে গ্রেপ্তারও করে পুলিশ৷
ছবি: bdnews24
সড়ক নিরাপত্তার আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের হয়রানি
স্কুল ছাত্রীর মৃত্যুকে কেন্দ্র করে সড়কে নিরাপত্তার দাবিতে আন্দোলনে নেমেছিলেন শিক্ষার্থীরা৷ এই আন্দোলন ঘিরে সহিংসতা, বিশৃঙ্খলা নিয়ে ঢাকা মহানগরে ৪৩টি সহ ৯৫টি মামলা দায়েরের বিষয়ে খবর বের হয় গণমাধ্যমে৷ এই সময়ে গ্রেপ্তার করা হয় প্রখ্যাত ফটোগ্রাফার শহীদুল আলমকে৷ তাঁর বিরুদ্ধে তথ্যপ্রযুক্তি আইনে মামলা করে পুলিশ৷
ছবি: bdnews24
অজ্ঞাত মামলা পোশাক শ্রমিকদের বিরুদ্ধে
ন্যূনতম মজুরি কাঠামোর সমন্বয়ের দাবিতে ২০১৯ সালের জানুয়ারিতে রাস্তায় নামেন তৈরি পোশাক কারখানার শ্রমিকরা৷ পুলিশের সাথে সংঘর্ষে এসময় এক শ্রমিকের মৃত্যুও হয়৷ এই ঘটনায় ২৯টি মামলা করা হয়েছে৷ যেখানে ৫৫১ জনের নামে আর ৩,০০০ অজ্ঞাতনামা শ্রমিককে আসামি করা হয়, যা নিয়ে উদ্বেগ জানিয়ে বিবৃতি প্রকাশ করেছিল হিউম্যান রাইটস ওয়াচ৷
ছবি: AFP/Getty Images
মিথ্যা মামলা, সাজানো আসামি
অনেক সময় নাটক সাজিয়েও অনেককে আসামি বানিয়েছে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী৷ যার সবচেয়ে বড় উদাহরণ একুশে আগস্ট মামলায় গ্রেপ্তার হওয়া জজ মিয়া৷ সাতটি মামলায় ভুয়া পরোয়ানায় এক কৃষকের ১০০ দিন হাজতবাসের খবরও সম্প্রতি গণমাধ্যমে বেরিয়েছে৷