‘দায়ীদের শাস্তি পেতেই হবে’
১ এপ্রিল ২০১৬আরও একটি ক্ষেত্রে ভেঙে পড়েছিল একটি উড়ালপথ৷ ২০১৩ সালে, পূর্ব কলকাতার উল্টোডাঙায়৷ কিন্তু দুর্ঘটনাটি অনেক সকালে ঘটেছিল, উড়ালপথে প্রায় কোনো ট্রাফিক ছিল না, ফলে এড়ানো গিয়েছিল বড় মাপের প্রাণহানি৷ কিন্তু এবার কলকাতা উত্তর-পশ্চিমের বিবেকানন্দ রোডে নির্মীয়মাণ সেতুপথটি দিনের ব্যস্ত সময়ে রাস্তায় ভেঙে পড়ার ঘটনা ধ্বংসের ব্যাপকতায় এবং প্রাণহানির হিসেবে অনেক বেশি আতঙ্ক ছড়িয়েছে জনমানসে৷
যথারীতি দুর্ঘটনার সঙ্গে সঙ্গেই শুরু হয়ে গেছে রাজনৈতিক চাপানউতোর৷ বিরোধী বামেরা বলছেন, ২০১০ সালে কলকাতার স্টিফেন কোর্টে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় তখনকার মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের পদত্যাগ দাবি করেছিলেন বিরোধী নেত্রী মমতা ব্যানার্জি৷ সেই যুক্তিতে এখন মমতারও পদত্যাগ করা উচিত৷
ক্ষমতাসীন দল তৃণমূল কংগ্রেস বলছে, তাদের আমলে নয়, এই উড়ালপথের নকশা অনুমোদন এবং কাজের বরাত দেওয়া হয়েছিল পূর্বতন বামফ্রন্ট সরকারের আমলে৷ অন্যদিকে রাজ্যের তৃতীয় বিরোধী দল বিজেপি বলছে, আগের বাম সরকার এবং এখনকার তৃণমূল সরকারের সঙ্গে ঠিকাদার সংস্থাগুলির যে অনৈতিক যোগসাজশ, সেটাই এই দুর্ঘটনার কারণ৷
এর মধ্যে বেফাঁস মন্তব্য করে দল তথা সরকারকে বেকায়দায় ফেলেছেন তৃণমূলের সাংসদ সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়৷ দুর্ঘটনার পরদিন ওই এলাকায় গিয়ে সুদীপ সাংবাদিকদের বলেন, সেতুপথের নকশায় ত্রুটি ছিল৷ কিন্তু যেহেতু নির্মাণকাজ ৫০ শতাংশের বেশি হয়ে গিয়েছিল, তাই আর নকশা বদল করার কথা ভাবা হয়নি, কারণ, সেক্ষেত্রে খরচ বাড়ত, যার চাপ গিয়ে পড়ত রাজ্য সরকারের তহবিলে৷ সঙ্গে সঙ্গেই প্রশ্ন ওঠে, তা হলে সরকার জানত যে সেতুর নকশায় এবং নির্মাণে ত্রুটি আছে? তার পরেও কেন কাজ চালিয়ে যাওয়া হলো?
মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি আগের দিনই বলেছেন, এই ঘটনার জন্য যারা দায়ী, তাদের শাস্তি পেতে হবে৷ হায়দরাবাদের যে ঠিকাদার সংস্থা এই সেতু তৈরির দায়িত্বে ছিল, ঘটনার পরই তাদের হায়দরাবাদের সদর দপ্তর এবং কলকাতার শাখা অফিসে তালা ঝুলিয়ে কর্তা এবং কর্মীরা গা ঢাকা দিয়েছে৷ সংস্থার অন্যতম কর্ণধার কে পি রাও আগের দিন দাবি করেন, নির্মাণে বা মালমশলায় কোনো গলদ ছিল না৷ পুরোটাই ভগবানের হাত৷ সরকার যদিও এই দায় এড়ানো মন্তব্যে খুশি নয়৷
ঘটনার পরদিনই কলকাতা পুলিশের একটি দল হায়দরাবাদ রওনা হয়েছে ঠিকাদার সংস্থার কর্তাব্যক্তিদের জিজ্ঞাসাবাদ করতে৷ উল্লেখ্য, এই সংস্থাটি আগে ভারতীয় রেলসহ প্রচুর সরকারি কাজের ঠিকাদারির কার্যাদেশ পেতো৷ কিন্তু তাদের কাজের মান পড়ে যাওয়ায় রেল মন্ত্রকসহ বেশ কিছু রাজ্য সরকার সংস্থাটিকে কালো তালিকাভুক্ত করে৷ তার পরেও কেন ওই সংস্থাটিকেই বহাল রাখা হলো সেই প্রশ্নও উঠছে৷
এদিকে একের পর এক সরকারি কাজ হাতছাড়া হওয়ার ফলে সংস্থাটির প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা লোকসান হয়, যার জেরে ২০১৪ সালের বেশ কিছু সময় কলকাতার এই সেতুপথের কাজ বন্ধ হয়ে ছিল৷ জমি অধিগ্রহণ সংক্রান্ত জটিলতার জেরেও বার বার বন্ধ থেকেছে ওই সেতুর কাজ৷ ফলে যে কাজ ২০১০ সালে শেষ হয়ে যাওয়ার কথা ছিল, তা ছ বছর পরেও শেষ হয়নি৷
সম্প্রতি মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি তাগাদা দেন, আগস্ট মাসের মধ্যেই কাজ শেষ করতে৷ বিরোধীরা এখন সরব হয়েছে, সেই কারণে তাড়াহুড়ো করে কাজ শেষ করতে গিয়েই নাকি বিপত্তি৷ জানা গেছে, আগের রাতেই সেতুর ভেঙে পড়া অংশে ঢালাইয়ের কাজ হয়েছে৷ পরদিন সকালেই বিপত্তি৷
বাস্তুবিদদের ধারণা, দীর্ঘদিন ধরে কাজ বন্ধ থাকা, নিয়মিত নজরদারির অভাব এবং কাজ করার ক্ষেত্রে যেসব নিয়ম-বিধি মেনে চলতে হয়, তা অবহেলা করার কারণেই এই বিপর্যয়৷ কলকাতার মতো জনবহুল শহরে যা অবশ্যপালনীয় ছিল৷ অনেকেই তাই মনে করছেন, সময় থাকতে সাবধান না হয়ে এখন রাজনৈতিক তরজা শুরু করা অর্থহীন৷ বরং শিক্ষা নেওয়া উচিত বাস্তব পরিস্থিতি থেকে৷ নতুন সেতুপথ বানিয়ে হাততালি কুড়নোই হোক, বা সেতু ভেঙে পড়ার পর তার থেকে রাজনৈতিক ফায়দা তোলা – তার থেকে অনেক বেশি জরুরি সাধারণ মানুষের জানমালের নিরাপত্তা নিয়ে সচেতন থাকা, দায়িত্বশীল থাকা৷ সেই মানসিকতা এখনও কারও মধ্যে দেখা যাচ্ছে না৷