বাংলাদেশে জামায়াতের রাজনীতি নিষিদ্ধ হবে না এটা নিয়ে রাজনীতি হবে – এই প্রশ্নই বড় করে দেখা দিচ্ছে৷ সরকারের পক্ষ থেকে জামায়াতের রাজনীতির বিরোধিতা থাকলেও নিষিদ্ধের কোনো ইঙ্গিত নেই৷ আছে বিএনপির ওপর জামায়াতকে ছাড়ার চাপ৷
বিজ্ঞাপন
বিএনপির নেতৃত্বে ১৮ দলের গত এক বছরের সরকার বিরোধী আন্দোলনে জামায়াতে ইসলামী মাঠের শক্তি হিসেবে কাজ করেছে৷ বিশেষ করে সহিংস আন্দোলনের জন্য বার বার জামায়াতকেই দায়ী করা হয়েছে৷ তাই বিদেশি কূটনীতিকরা সমঝোতা বা সংলাপের সঙ্গে সঙ্গে সহিংসতার বিরুদ্ধেও তাঁদের অবস্থান স্পষ্ট করেছেন৷ ফলে বিএনপি জামায়াত নিয়ে কিছুটা বেকায়দায় আছে৷ বিএনপির চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া তাই বিদেশি সংবাদমাধ্যম এবং কূটনীতিকদের জানিয়েছেন যে, জামায়াতের সঙ্গে বিএনপির সম্পর্ক অস্থায়ী৷ তাদের মধ্যে আদর্শিক কোনো মিল নেই৷ তবে বিএনপি জামায়াতকে ছাড়বে কিনা – সে ব্যাপারে কিছু স্পষ্ট করেননি বিএনপির চেয়ারপার্সন৷
অন্যদিকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিএনপিকে জামায়াতের সঙ্গ ত্যাগ করে সংলাপ এবং সমঝোতায় আসার কথা বলছেন বার বার৷ জামায়াতের সঙ্গ না ছাড়লে যে আলোচনা হবে না, তা তিনি স্পষ্ট করেই বুঝিয়ে দিয়েছেন৷ তবে জামায়াতকে সন্ত্রাসী সংগঠন বললেও জামায়তকে নিষিদ্ধ করতে আদালতের সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করার কথা বলেছেন প্রধানমন্ত্রী৷ তবে সরকার জামায়াতকে নিষিদ্ধ করার কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি৷
অধ্যাপক মুনতাসির মামুন ডয়চে ভেলেকে বলেন, এখানেই রাজনীতির বড় বৈপরীত্য৷ তিনি মনে করেন, আওয়ামী লীগ জামায়াত বিরোধী হলেও দলটি আন্তর্জাতিক চাপকে উপেক্ষা করতে পারছে না৷ অ্যামেরিকা, ইউরোপ এবং মধ্যপ্রাচ্যের প্রভাবশালী দেশ জামায়াতের পক্ষে৷ তাদের অনেকে যুদ্ধাপরাধের বিচার করলেও বাংলাদেশের বিচার নিয়ে স্বচ্ছতার প্রশ্ন তুলে তা বাধাগ্রস্ত করতে চায়৷ আবার জামায়াতের মতো যুদ্ধাপরাধীদের দল তারা নিষিদ্ধ করলেও জামায়াত বাংলাদেশে নিষিদ্ধ হোক, এটা হয়ত তারা চায় না৷ আওয়ামী লীগের পক্ষে সেই চাপ মোকাবেলা করা আপাতত সম্ভব নয়৷ আবার আওয়ামী লীগ মনে করে যে, জামায়াতকে নিষিদ্ধ না করে বিএনপি থেকে আলাদা করলে ভোটে সুবিধা পাওয়া যায়৷
প্রতিহিংসা আর ধ্বংসের নির্মম রাজনীতি আর কতকাল
বাংলাদেশে হরতাল, অবরোধ নতুন কিছু নয়৷ বড় দুটো দলতো বটেই, অনেক ছোট দলও অতীতে এমন কর্মসূচি দিয়েছে৷ জনদুর্ভোগ বেড়েছে, সম্পদ বিনষ্ট এবং প্রাণহানিও হয়েছে৷ তবে সাম্প্রতিক হরতাল, অবরোধগুলো দুঃস্বপ্নকেও হার মানিয়েছে৷
ছবি: JEWEL SAMAD/AFP/Getty Images
হামলার শিকার সাংবাদিক
বাংলাদেশে সাংবাদিক নির্যাতন এবং হত্যার ঘটনা আগেও ঘটেছে৷ এখনো সাগর-রুনি হত্যার বিচার হয়নি৷ তবে বিরোধী দলের কর্মসূচিতে সাংবাদিকের আহত হওয়ার ঘটনা চলমান আন্দোলনেই প্রথম ঘটছে৷ এ বছর হেফাজত-এ-ইসলামের সমাবেশে প্রহৃত হন সাংবাদিক নাদিয়া শারমিন৷ গত দুই সপ্তাহে হরতাল এবং অবরোধের সময় ককটেল হামলায় আহত হয়েছেন বেশ কয়েকজন সাংবাদিক৷ ছবিতে নাদিয়া শারমিনের ওপর হামলার প্রতিবাদ জানাতেচ্ছেন নারী সংগঠন কর্মীরা৷
ছবি: picture-alliance/dpa
যানবাহনে আগুন, রেললাইন উপড়ানো
হরতাল-অবরোধ মানেই রাস্তায় যানচলাচল বন্ধ৷ কর্মসূচির এ লক্ষ্য পূরণের পথে বাধা হলে গাড়ি ভাঙচুর এবং আগুন লাগানো বাংলাদেশে অনেক দিন ধরেই স্বাভাবিক ঘটনা৷ তবে গত এক বছরে জ্বালাও-পোড়াওয়ের এই ধ্বংসলীলা অন্য মাত্রা পেয়েছে৷ হরতালের আগের রাতেই শুরু হয়ে যায় ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ৷ তাই বিরোধী দল ঘোষণা অনুযায়ী কর্মসূচি পালন শুরুর আগেই জনমনে ছড়িয়ে পড়ে আতঙ্ক৷ ছবিতে মোটর সাইকেলে পেট্রোল ঢালছেন জামায়াত কর্মীরা৷
ছবি: Reuters/Andrew Biraj
শিশুরাও অসহায়, নিরাপত্তাহীন
যানবাহনে ঘুমন্ত চালক, হেল্পার বা চালকের সন্তানের আগুনে ঝলসে মৃত্যুর ঘটনাও ঘটছে৷ ঢাকা শহর দেখতে এসে লাশ হয়ে বাড়ি ফিরেছে কাভার্ডভ্যান চালকের সন্তান মুনির৷ এমন হতভাগ্যদের তালিকায় আরো নাম যোগ হয়েছে৷ স্কুলে, রাস্তায়, এমনকি বাড়িতেও শিশুদের জীবন সংকটাপন্ন দেখে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে ইউনিসেফ৷ছবিতে সর্বশেষ অবরোধ কর্মসূচির প্রথম দিনে রাস্তায় আগুন জ্বালিয়ে স্লোগানরত জামায়াত কর্মীরা৷
ছবি: Reuters/Andrew Biraj
নিরাপত্তা কর্মীদেরও নিরাপত্তার অভাব
একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের কারণে রায় ঘোষণার পর নেতাদের শাস্তির আদেশ প্রত্যাহার এবং মুক্তির দাবিতে জামায়াত-ই-ইসলামী ও ইসলামী ছাত্র শিবির পুলিশের ওপর ব্যাপক হামলা চালিয়েছে৷ হামলায় নিহত হয়েছেন বেশ কয়েকজন পুলিশ কর্মী৷ রাজশাহীতে দায়িত্ব পালনের সময় পুলিশ সদস্যের মাথা ইটের আঘাতে থেতলে দেয়া হয়৷ বিরোধী দলের সর্বশেষ অবরোধ কর্মসূচিতেও কর্মরত পুলিশ ও বিজিবি সদস্য প্রাণ হারিয়েছেন দায়িত্বরত অবস্থায়৷
ছবি: Getty Images/Afp/Munir uz ZAMAN
সংখ্যালঘুদের বাড়ি-মন্দিরে আগুন
সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার ঘটনায় স্থানীয়ভাবে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদেরও জড়িত থাকার অভিযোগ উঠেছে অনেক সময়৷ তবে শীর্ষ নেতাদের শাস্তি ঘোষণার পর জামায়াত ও শিবিরের কর্মীরা সংখ্যালঘুদের বাড়ি-ঘর-মন্দির-ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে ব্যাপক হামলা চালায়৷ ছবিতে নিজের শিশুসন্তান কোলে সাতক্ষিরার অমিয় দাশ৷ ঘরবাড়িতে লুটপাট, অগ্নিসংযোগের সময় শিশুটিকে আগুনে ছুড়ে মারতে চেয়েছিল শিবির কর্মীরা৷
ছবি: Shayantani Twisha
কবে হবে অবসান!
প্রধান বিরোধীদল বিএনপির নেতৃত্বাধীন ১৮ দলের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবিকে অগ্রাহ্য করে আওয়ামী লীগ জাতীয় পার্টি ও মহাজোটের শরিক কয়েকটি দল নিয়ে নির্বাচনকালীন সরকার গঠন করেছে৷ ফলে রাজনীতির মাঠে উত্তেজনা বেড়েছে৷ ৫ জানুয়ারি সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের পরিকল্পনা নিয়ে তফশিল ঘোষণা করেছে নির্বাচন কমিশন৷ তারপর থেকে বিরোধী দলের হরতাল, অবরোধ চলছে প্রায় বিরামহীনভাবে৷
ছবি: JEWEL SAMAD/AFP/Getty Images
6 ছবি1 | 6
অন্যদিকে বিএনপি জাময়াতকে ছাড়তে পারবেনা বলে মনে করেন তিনি৷ তাঁর মতে, বিএনপির সঙ্গে জামায়াতের ঐতিহাসিক এবং আদর্শিক সম্পর্ক আছে৷ এছাড়া সাম্প্রতিক সময় বিএনপির ব্যাপক জামায়াত নির্ভরতা জামায়াতকেই শক্তিশালী করেছে৷ মুনতাসির মামুন মনে করেন, বিএনপি যদি জামায়াত থেকে প্রকাশ্যে আলদাও হয়ে যায় তাহলেও তাদের সম্পর্ক শেষ হবে না৷ তাই তিনি মনে করেন, জামায়াত নিয়ে যতই কথা হোক তারা ভালোভাবেই টিকে আছে৷ আর বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতায় জামায়াতকে বাদ দেয়া সম্ভব হচ্ছে না৷
আদালতের রায়ে জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল হলেও তা ফিরে পেতে জামায়াত আবার আদালতে আবেদন করেছে৷ মুনতাসির মামুন বলেন, আদালতের দিকে তাকিয়ে না থেকে সরকার নির্বাহী আদেশেই ‘সন্ত্রাসী সংগঠন' হিসেবে জামায়াতকে নিষিদ্ধ করতে পারে৷ সুশীল সমাজ সে জন্যই সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করছে৷ তবে তা সফল হবে কিনা তা নির্ভর করছে ভবিষ্যত রাজনীতির গতিপ্রকৃতির ওপর৷
এদিকে জামায়াতের কোনো নেতাকে পাওয়া না যাওয়ায় তাঁদের মতামত জানা যায়নি৷ তবে জামায়াতের ওয়েবসাইটে দেয়া বিৃবতিতে নেতারা সহিংসতা এবং সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতনের জন্য সরকারি দলের লোকজনকেই দায়ী করেছেন৷