হাইকোর্টের রায় হাতে পাওয়ার পর নির্বাচন কমিশন বৃহস্পতিবার বলেছে, জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল হয়ে গেছে৷ তারা নির্বাচনও করতে পারবে না৷ তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, জামায়াত স্বতন্ত্রভাবে বা অন্য দলের প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করতে পারে৷
বিজ্ঞাপন
গত ১লা আগস্ট হাইকোর্ট জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন অবৈধ এবং বেআইনি বলে রায় দেয়৷ হাইকোর্টের সেই রায়ের পর, নির্বাচন কমিশন পূর্ণাঙ্গ রায়ের জন্য অপেক্ষা করছিল৷ দুদিন আগে নির্বাচন কমিশন সেই রায় হাতে পায়৷ রায় পর্যালোচনার পর বৃহস্পতিবার নির্বাচন কমিশনার মোহাম্মদ শাহনেওয়াজ সাংবাদিকদের জানান, আদালত যে রায় দিয়েছে তাতে জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল হয়ে গেছে৷ রায়ে বলা হয়েছে, নির্বাচন কমিশন যে প্রক্রিয়ায় জামায়াতকে নিবন্ধন দিয়েছে সেটা অবৈধ৷ জামায়াতের নিবন্ধন বাতিলের ব্যাপারে আদালত কোনো নির্দেশনা দেয়নি৷ নির্বাচন কমিশনার বলেন, তাই এ ব্যাপারে কমিশন কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি৷ আদালতের যে আদেশ তাতেই জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল হয়ে গেছে৷
নির্বাচন কমিশনার শাহনেওয়াজ সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেন, দলটির এখন যেহেতু কোনো নিবন্ধন নেই, তাই তারা নির্বাচনেও অংশ নিতে পারবে না৷ এছাড়া, নির্বাচন কমিশনের ওয়েবসাইটে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল অংশে জামায়াতের ব্যাপারে বলা হয়েছে যে, হাইকোর্টের রায়ে জামায়াতের নিবন্ধন অবৈধ বলে ঘোষণা করা হয়েছে৷
জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন বাতিল
বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংগঠন জামায়েত ইসলামীর নিবন্ধন বাতিল করেছেন হাইকোর্ট৷ জামায়াত এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিলের ঘোষণা দিয়েছে৷ এদিকে দাবি উঠেছে, জামায়াতের রাজনীতি নিষিদ্ধ করার৷ এই বিষয়ে আমাদের ছবিঘর৷
ছবি: Strdel/AFP/Getty Images
‘‘জামায়াত একটি সন্ত্রাসী দল’’
বাংলাদেশ সময় বৃহস্পতিবার (০১.০৮.১৩) বিকেলে জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন বাতিল করেছেন হাইকোর্ট৷ বিচারপতি এম মোয়াজ্জেম হোসেন, ইনায়েতুর রহিম এবং কাজী রেজা-উল-হকের সমন্বয়ে হাইকোর্টের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ তাদের রায়ে জামায়াতের নিবন্ধন অবৈধ ঘোষণা করেন৷ রায়ে বলা হয়, ‘‘জামায়াতের গঠনতন্ত্র শুধু সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিকই নয়, জামায়াত একটি সন্ত্রাসী দল৷’’
ছবি: Munir Uz Zaman/AFP/Getty Images
২০০৯ সালের রিটের রায়
রাজনৈতিক দল হিসেবে জামায়াতের নিবন্ধনের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে কয়েকটি সংগঠন ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা হাইকোর্টে রিট করেন ২০০৯ সালে৷ রিটে জামায়াতের গঠনতন্ত্র সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক বলে উল্লেখ করা হয়, জানান ব্যারিস্টার তানিয়া আমীর৷ সেই রিটের প্রেক্ষিতে বৃহস্পতিবার রায় ঘোষণা করলেন আদালত৷
ছবি: Reuters
জামায়াতের প্রতিক্রিয়া
আদালতের রায়ের পর জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এবং এই মামলার আইনজীবী ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক জানান, রায়ের বিরুদ্ধে তারা আপিল করবেন৷ সেজন্য ইতিমধ্যে রায়ের কার্যকারিতার স্থগিতাদেশ চেয়ে সুপ্রিম কোর্টে আবেদন করা হয়েছে৷
ছবি: Strdel/AFP/Getty Images
স্বাধীনতার বিরুদ্ধে অবস্থান
১৯৭১ সালে তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের বিরুদ্ধে নয় মাসের রক্তক্ষয়ী লড়াইয়ের পর চূড়ান্ত স্বাধীনতা অর্জন করে বাংলাদেশ৷ বার্তাসংস্থা রয়টার্স জানিয়েছে, ‘‘জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে ছিল৷ তবে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে সেদলের কিছু নেতার হত্যা, ধর্ষণ এবং নির্যাতনের মতো অপরাধের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ অস্বীকার করেছে জামায়াত৷’’
ছবি: AP
ট্রাইব্যুনালে বিচার
জামায়াত যুদ্ধাপরাধের দায় অস্বীকার করলেও ২০১০ সালে গঠিত ঢাকার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে একের পর এক জামায়াত নেতার বিরুদ্ধে একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ প্রমাণ হচ্ছে৷ এই ছবিঘর তৈরির দিন (০১.০৮.১৩) অবধি ছয়জনের বিরুদ্ধে রায় ঘোষণা করেছেন ট্রাইব্যুনাল৷ সর্বশেষ আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধ মামলায় ফাঁসির রায় দেয়া হয়েছে৷
ছবি: Reuters
ট্রাইব্যুনাল নিয়ে বিতর্ক
একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিশ্চিত করতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার ২০১০ সালে ঢাকায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল প্রতিষ্ঠা করে৷ তবে সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিরোধী দল বিএনপি মনে করে, সরকার বিরোধী দলকে দুর্বল করতে এই ট্রাইব্যুনাল প্রতিষ্ঠা করেছে৷ আন্তর্জাতিক পর্যায়েও এই ট্রাইব্যুনাল নিয়ে বিতর্ক রয়েছে৷
ছবি: AP
জামায়াতের রাজনীতি নিষিদ্ধের দাবি
এদিকে জামায়াতের নিবন্ধন বাতিলের রায়ের পর দলটির রাজনীতি নিষিদ্ধের দাবি আরো জোরালো হয়েছে৷ অধ্যাপক মুনতাসির মামুন জামায়াতকে নিষিদ্ধ করার দাবি জানালেও সরকার এতটা সাহসী হবে বলে আশা করেন না৷ মুনতাসির মামুনের কথায়, ‘‘জামায়াত একটি যুদ্ধাপরাধী দল৷ ট্রাইব্যুনালের একাধিক রায়ে তা বলাও হয়েছে৷ তাই যুদ্ধাপরাধী দল হিসেবেও জামায়াতকে নিষিদ্ধ করা সম্ভব৷’’
ছবি: picture-alliance/dpa
ব্লগারদের সতর্ক প্রতিক্রিয়া
বৃহস্পতিবার আদালত রায় ঘোষণার আগেই ফেসবুকে আরিফ জিবতেক লিখেছেন, ‘‘হাইকোর্টের রায়টা কিন্তু জামায়াত নিষিদ্ধ নিয়া মামলা না৷ মামলাটা হচ্ছে নির্বাচন কমিশনে জামায়াত আইনসিদ্ধভাবে নিবন্ধিত হয়েছে কিনা, সেটা নিয়ে বিবেচনা৷’’ এই ব্লগার লিখেছেন, ‘‘যুদ্ধাপরাধী সংগঠন হিসেবে জামায়াতের বিচার চাই, নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধন নিয়া আমার মাথাব্যথা নাই৷’’
ছবি: privat
এই দাবি নতুন নয়
পরিসংখ্যান বলছে, ১৯৪১ সালে জামায়াত প্রতিষ্ঠার পর মোট তিনবার দলটি নিষিদ্ধ হয়েছে৷ ১৯৫৯ এবং ১৯৬৪ সালে পাকিস্তানে এবং ১৯৭২ সালে স্বাধীন বাংলাদেশে৷ ১৯৭৯ সালের ২৫শে মে জিয়াউর রহমানের শাসনামলে স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো জামায়াত প্রকাশ্যে রাজনীতি করার সুযোগ পায়৷
তবে জামায়াতে ইসলামীর আইনজীবী তাজুল ইসলাম ডয়চে ভেলেকে বলেন, জামায়াতের নিবন্ধন এখন আর নেই – নির্বাচন কমিশন এ ধরণের কথা বলতে পারে না৷ কারণ, রায়ের পর সংশ্লিষ্ট আদালতই আপিলের অনুমতি দিয়েছে৷ এরপর তাঁরা ‘লিভ টু আপিল' করেছেন৷ এখন পূর্ণাঙ্গ আপিল করবেন৷ তাঁর মতে, এটি এখনও একটি বিচারাধীন মামলা৷ তাই বিচার নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত জামায়াতের নিবন্ধন অবৈধ বলার সুযোগ নেই৷ তাঁর কথায়, জামায়াতের এখনও নির্বাচনে অংশ নেয়ার সুযোগ আছে এবং সংসদ সদস্যরাও তাঁদের পদে বহাল থাকবেন৷
এদিকে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক শ ম রেজাউল করিম ডয়চে ভেলেকে বলেন, জামায়াতের আপিল যদি সুপ্রিম কোর্ট শুনানির জন্য গ্রহণ করে হাইকোর্টের রায়ের ওপর স্থগিতাদেশ দেয়, তাহলে আপিল নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত জামায়াতের নিবন্ধন বৈধ বলে বিবেচিত হবে৷ তার আগ পর্যন্ত নয়৷ সেই বিবচনায় জামায়তের নিবন্ধন এখন বৈধ নয়৷ কারণ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে হাইকোর্টের রায় স্থগিত হয়নি৷ তাই জামায়াত দলীয়ভাবে এবং তাদের প্রতীক দাঁড়িপাল্লা নিয়ে নির্বাচনও করতে পারবে না৷ তবে তারা যে কেউ স্বতন্ত্রভাবে বা অন্য কোনো দলের প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করতে পারবেন৷ তাতে কোনো আইনগত বাধা নেই৷ তিনি জানান, জামায়াতের বর্তমান যেসব সংসদ সদস্য আছেন তাঁরা স্বপদেই বহাল থাকবেন৷ কারণ তাঁরা যখন নির্বাচিত হন, তখন জামায়াতের নিবন্ধন অবৈধ ঘোষিত হয়নি৷
উল্লেখ্য, ২০০৮ সালের ৪ঠা নভেম্বর জামায়তকে শর্ত সাপেক্ষ নিবন্ধন দেয় নির্বাচন কমিশন৷ জামায়াতের গঠনতন্ত্রে সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক বেশ কিছু ধারা রয়েছে৷ নির্বাচন কমিশন বেশ কয়েকবার সেই ধারাগুলো ঠিক করতে জামায়াতকে তাগাদা দিলেও, জামায়াত তা সংশোধন করেনি৷