বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের সময় যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে বিচারের মুখোমুখি হতে যাচ্ছে জামায়াতে ইসলামী৷ জামায়াতের বিরুদ্ধে তদন্ত শেষ হয়েছে৷ এ মাসেই মানবতাবিরোধী আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে তদন্ত রিপোর্ট দাখিল করবে প্রসিকিউশন৷
বিজ্ঞাপন
তদন্ত কর্মকর্তা মতিউর রহমান ডয়চে ভেলেকে জানান, জামায়াতে ইসলামীকে একটি ‘ক্রিমিনাল সংগঠন' হিসেবে চিহ্নিত করেছেন তাঁরা৷ ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় সারা দেশে যে সব মানবতা বিরোধী অপরাধ সংগঠিত হয়েছে, তার সাথে জামায়াতের সম্পৃক্ততা রয়েছে৷ তাঁরা এই অপরাধ প্রমাণের জন্য বিভিন্ন ডকুমেন্ট, তথ্য ও দলটির অর্গানোগ্রামসহ অন্যান্য তথ্য সংগ্রহ করেছেন৷ তিনি আরও জানান, মুক্তিযুদ্ধকালীন এই দলটির যুদ্ধাপরাধ পরবর্তী সময়ে দলটির নানা কার্যক্রমও তদন্ত হচ্ছে৷
মতিউর রহমান বলেন, ‘‘তদন্তে প্রমাণিত হয়েছে ১৯৭১ সালে জামায়াতে ইসলামী দলীয়ভাবে সিদ্ধান্ত নিয়ে মুক্তিযুদ্ধ এবং স্বাধীনতার বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়৷ শুধু তাই নয়, বাংলাদেশে গণহত্যা, ধর্ষণ, লুটতরাজসহ আরো অনেক অপরাধ হয়েছে জামায়াতের সাংগঠনিক সিদ্ধান্তে৷ দলীয় সিদ্ধান্ত নিয়ে জামায়াত পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে সহায়তা করে এবং এজন্য রাজাকার, আলবদর ও আল শামসসহ নানা বাহিনীও গঠন করে৷ আর এসব বাহিনীর নেতৃত্বে ও মাঠ পর্যায়ে জামায়াতের নেতা-কর্মীরা ছিলেন৷ এর বিনিময়ে জামায়াত আর্থিক সহায়তাও নিয়েছে৷'' তদন্ত কর্মকর্তা বলেন, তাঁদের কাছে জামায়াতের দলীয় সিদ্ধান্তের তথ্যপ্রমাণ এবং কাগজপত্র আছে৷
জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন বাতিল
বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংগঠন জামায়েত ইসলামীর নিবন্ধন বাতিল করেছেন হাইকোর্ট৷ জামায়াত এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিলের ঘোষণা দিয়েছে৷ এদিকে দাবি উঠেছে, জামায়াতের রাজনীতি নিষিদ্ধ করার৷ এই বিষয়ে আমাদের ছবিঘর৷
ছবি: Strdel/AFP/Getty Images
‘‘জামায়াত একটি সন্ত্রাসী দল’’
বাংলাদেশ সময় বৃহস্পতিবার (০১.০৮.১৩) বিকেলে জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন বাতিল করেছেন হাইকোর্ট৷ বিচারপতি এম মোয়াজ্জেম হোসেন, ইনায়েতুর রহিম এবং কাজী রেজা-উল-হকের সমন্বয়ে হাইকোর্টের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ তাদের রায়ে জামায়াতের নিবন্ধন অবৈধ ঘোষণা করেন৷ রায়ে বলা হয়, ‘‘জামায়াতের গঠনতন্ত্র শুধু সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিকই নয়, জামায়াত একটি সন্ত্রাসী দল৷’’
ছবি: Munir Uz Zaman/AFP/Getty Images
২০০৯ সালের রিটের রায়
রাজনৈতিক দল হিসেবে জামায়াতের নিবন্ধনের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে কয়েকটি সংগঠন ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা হাইকোর্টে রিট করেন ২০০৯ সালে৷ রিটে জামায়াতের গঠনতন্ত্র সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক বলে উল্লেখ করা হয়, জানান ব্যারিস্টার তানিয়া আমীর৷ সেই রিটের প্রেক্ষিতে বৃহস্পতিবার রায় ঘোষণা করলেন আদালত৷
ছবি: Reuters
জামায়াতের প্রতিক্রিয়া
আদালতের রায়ের পর জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এবং এই মামলার আইনজীবী ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক জানান, রায়ের বিরুদ্ধে তারা আপিল করবেন৷ সেজন্য ইতিমধ্যে রায়ের কার্যকারিতার স্থগিতাদেশ চেয়ে সুপ্রিম কোর্টে আবেদন করা হয়েছে৷
ছবি: Strdel/AFP/Getty Images
স্বাধীনতার বিরুদ্ধে অবস্থান
১৯৭১ সালে তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের বিরুদ্ধে নয় মাসের রক্তক্ষয়ী লড়াইয়ের পর চূড়ান্ত স্বাধীনতা অর্জন করে বাংলাদেশ৷ বার্তাসংস্থা রয়টার্স জানিয়েছে, ‘‘জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে ছিল৷ তবে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে সেদলের কিছু নেতার হত্যা, ধর্ষণ এবং নির্যাতনের মতো অপরাধের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ অস্বীকার করেছে জামায়াত৷’’
ছবি: AP
ট্রাইব্যুনালে বিচার
জামায়াত যুদ্ধাপরাধের দায় অস্বীকার করলেও ২০১০ সালে গঠিত ঢাকার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে একের পর এক জামায়াত নেতার বিরুদ্ধে একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ প্রমাণ হচ্ছে৷ এই ছবিঘর তৈরির দিন (০১.০৮.১৩) অবধি ছয়জনের বিরুদ্ধে রায় ঘোষণা করেছেন ট্রাইব্যুনাল৷ সর্বশেষ আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধ মামলায় ফাঁসির রায় দেয়া হয়েছে৷
ছবি: Reuters
ট্রাইব্যুনাল নিয়ে বিতর্ক
একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিশ্চিত করতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার ২০১০ সালে ঢাকায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল প্রতিষ্ঠা করে৷ তবে সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিরোধী দল বিএনপি মনে করে, সরকার বিরোধী দলকে দুর্বল করতে এই ট্রাইব্যুনাল প্রতিষ্ঠা করেছে৷ আন্তর্জাতিক পর্যায়েও এই ট্রাইব্যুনাল নিয়ে বিতর্ক রয়েছে৷
ছবি: AP
জামায়াতের রাজনীতি নিষিদ্ধের দাবি
এদিকে জামায়াতের নিবন্ধন বাতিলের রায়ের পর দলটির রাজনীতি নিষিদ্ধের দাবি আরো জোরালো হয়েছে৷ অধ্যাপক মুনতাসির মামুন জামায়াতকে নিষিদ্ধ করার দাবি জানালেও সরকার এতটা সাহসী হবে বলে আশা করেন না৷ মুনতাসির মামুনের কথায়, ‘‘জামায়াত একটি যুদ্ধাপরাধী দল৷ ট্রাইব্যুনালের একাধিক রায়ে তা বলাও হয়েছে৷ তাই যুদ্ধাপরাধী দল হিসেবেও জামায়াতকে নিষিদ্ধ করা সম্ভব৷’’
ছবি: picture-alliance/dpa
ব্লগারদের সতর্ক প্রতিক্রিয়া
বৃহস্পতিবার আদালত রায় ঘোষণার আগেই ফেসবুকে আরিফ জিবতেক লিখেছেন, ‘‘হাইকোর্টের রায়টা কিন্তু জামায়াত নিষিদ্ধ নিয়া মামলা না৷ মামলাটা হচ্ছে নির্বাচন কমিশনে জামায়াত আইনসিদ্ধভাবে নিবন্ধিত হয়েছে কিনা, সেটা নিয়ে বিবেচনা৷’’ এই ব্লগার লিখেছেন, ‘‘যুদ্ধাপরাধী সংগঠন হিসেবে জামায়াতের বিচার চাই, নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধন নিয়া আমার মাথাব্যথা নাই৷’’
ছবি: privat
এই দাবি নতুন নয়
পরিসংখ্যান বলছে, ১৯৪১ সালে জামায়াত প্রতিষ্ঠার পর মোট তিনবার দলটি নিষিদ্ধ হয়েছে৷ ১৯৫৯ এবং ১৯৬৪ সালে পাকিস্তানে এবং ১৯৭২ সালে স্বাধীন বাংলাদেশে৷ ১৯৭৯ সালের ২৫শে মে জিয়াউর রহমানের শাসনামলে স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো জামায়াত প্রকাশ্যে রাজনীতি করার সুযোগ পায়৷
ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর এ্যাডভোকেট রাণা দাসগুপ্ত ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘জামায়াত নেতাদের বিচারের একাধিক রায়ে জামায়াতকে ক্রিমিনাল অর্গানাইজেশন হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে৷ বলা হয়েছে, জামায়াত পাকিস্তানি বাহিনীর সহযোগী শক্তি হিসেবে কাজ করেছে৷ আর ট্রাইব্যুনালের আইন সংশোধন করে ব্যক্তির পাশাপাশি সংগঠনের বিচারের বিধান করা হয়েছে৷ ট্রাইব্যুনাল আইনের ২০ ধারায় বলা হয়েছে, মানবতাবিরোধী অপরাধের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড অথবা ট্রাইব্যুনাল যে রকম শাস্তি দেয়া যৌক্তিক মনে করেন৷'' তাহলে জামায়াতের বিচার হলে চেইন অব কমান্ডেরও বিচার হবে কিনা? এমন প্রশ্নের জবাবে প্রসিকিউটর বলেন, ‘‘না, এখানে শুধু সংগঠনের বিচার হবে৷ জামায়াতের জড়িত নেতাদের বিচারতো চলছেই৷ তাদের ব্যক্তিগত অপরাধের বিচার ব্যক্তিগতভাবে করার বিধান আছে আইনে৷ এখানে শুধু সংগঠনের বিচার হবে৷'' সংগঠনের শাস্তি কী হতে পারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘‘আইনে বিচারকদের ক্ষমতা দেয়া আছে৷ তাঁরা যা যৌক্তিক মনে করবেন, সেই শাস্তি দিতে পারবেন৷ কিন্তু সংগঠনকে তো আর মৃত্যুদণ্ড দেয়া যায়না৷ তাই বিচারে জামায়াত দোষী প্রমাণিত হলে দলটি নিষিদ্ধ হতে পারে৷ দলের সব ধরনের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত হতে পারে৷'
উল্লেখ্য, ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি অনেক আগে থেকেই দল হিসেবে জামায়াতের বিচার দাবি করে আসছিল৷ আর গণজাজরণ মঞ্চও জামায়াতের বিচারের দাবি জানায়৷