মঙ্গল ও বুধবার জামায়াতের ডাকা টানা ৪৮ ঘণ্টার হরতালে এখনো সমর্থন দেয়নি বিএনপি৷ শেষ পর্যন্ত সমর্থন দেবেনা বলেই মনে হচ্ছে৷ তবে বিএনপি কোনো রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ বা তার নিবন্ধন বাতিলের বিরুদ্ধে৷
বিজ্ঞাপন
বিএনপি’র স্থায়ী কমিটির সদস্য হান্নান শাহ ডয়চে ভেলেকে এসব কথা জানিয়েছেন৷
ঈদের ছুটি শেষ হয়েছে শনিবার৷ রবিবার থেকে সরকারি অফিস আদালত খোলা৷ আর মঙ্গল ও বুধবার সারাদেশে জামায়াতে ইসলামীর লাগাতার ৪৮ ঘণ্টার হরতাল৷ হাইকোর্ট জামায়াতের নিবন্ধন অবৈধ ঘোষণা করায় ঈদের আগেই তারা এই হরতাল ডাকে৷ এই হরতাল নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা হলেও জামায়াত তা প্রত্যাহার করেনি৷ একদিন পিছিয়েছে মাত্র৷ তবে এই হরতাল নিয়ে জামায়াত নেতাদের হাইকোর্টে তলব করা হয়েছে৷ হাইকোর্ট জানতে চেয়েছে আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে হরতাল, কেন আদালত অবমাননা হবেনা৷ জামায়াত নেতারা এ ব্যাপারে কথা বলতে রাজি হননি৷ তবে তাদের ওয়েবসাইটে দেশবাসীকে হরতাল পালনের আহবান জানানো হয়েছে৷ আর জামায়াতের আইনজীবী আ্যডভোকেট তাজুল ইসলাম ডয়চে ভেলেকে বলেন, জামায়াতের হরতাল নিয়ে যেহেতু হাইকোর্ট একটি কারণ দর্শানোর নোটিশ দিয়েছেন তাই এ নিয়ে কোনো কথা বলা ঠিক হবেনা৷
জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন বাতিল
বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংগঠন জামায়েত ইসলামীর নিবন্ধন বাতিল করেছেন হাইকোর্ট৷ জামায়াত এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিলের ঘোষণা দিয়েছে৷ এদিকে দাবি উঠেছে, জামায়াতের রাজনীতি নিষিদ্ধ করার৷ এই বিষয়ে আমাদের ছবিঘর৷
ছবি: Strdel/AFP/Getty Images
‘‘জামায়াত একটি সন্ত্রাসী দল’’
বাংলাদেশ সময় বৃহস্পতিবার (০১.০৮.১৩) বিকেলে জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন বাতিল করেছেন হাইকোর্ট৷ বিচারপতি এম মোয়াজ্জেম হোসেন, ইনায়েতুর রহিম এবং কাজী রেজা-উল-হকের সমন্বয়ে হাইকোর্টের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ তাদের রায়ে জামায়াতের নিবন্ধন অবৈধ ঘোষণা করেন৷ রায়ে বলা হয়, ‘‘জামায়াতের গঠনতন্ত্র শুধু সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিকই নয়, জামায়াত একটি সন্ত্রাসী দল৷’’
ছবি: Munir Uz Zaman/AFP/Getty Images
২০০৯ সালের রিটের রায়
রাজনৈতিক দল হিসেবে জামায়াতের নিবন্ধনের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে কয়েকটি সংগঠন ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা হাইকোর্টে রিট করেন ২০০৯ সালে৷ রিটে জামায়াতের গঠনতন্ত্র সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক বলে উল্লেখ করা হয়, জানান ব্যারিস্টার তানিয়া আমীর৷ সেই রিটের প্রেক্ষিতে বৃহস্পতিবার রায় ঘোষণা করলেন আদালত৷
ছবি: Reuters
জামায়াতের প্রতিক্রিয়া
আদালতের রায়ের পর জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এবং এই মামলার আইনজীবী ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক জানান, রায়ের বিরুদ্ধে তারা আপিল করবেন৷ সেজন্য ইতিমধ্যে রায়ের কার্যকারিতার স্থগিতাদেশ চেয়ে সুপ্রিম কোর্টে আবেদন করা হয়েছে৷
ছবি: Strdel/AFP/Getty Images
স্বাধীনতার বিরুদ্ধে অবস্থান
১৯৭১ সালে তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের বিরুদ্ধে নয় মাসের রক্তক্ষয়ী লড়াইয়ের পর চূড়ান্ত স্বাধীনতা অর্জন করে বাংলাদেশ৷ বার্তাসংস্থা রয়টার্স জানিয়েছে, ‘‘জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে ছিল৷ তবে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে সেদলের কিছু নেতার হত্যা, ধর্ষণ এবং নির্যাতনের মতো অপরাধের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ অস্বীকার করেছে জামায়াত৷’’
ছবি: AP
ট্রাইব্যুনালে বিচার
জামায়াত যুদ্ধাপরাধের দায় অস্বীকার করলেও ২০১০ সালে গঠিত ঢাকার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে একের পর এক জামায়াত নেতার বিরুদ্ধে একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ প্রমাণ হচ্ছে৷ এই ছবিঘর তৈরির দিন (০১.০৮.১৩) অবধি ছয়জনের বিরুদ্ধে রায় ঘোষণা করেছেন ট্রাইব্যুনাল৷ সর্বশেষ আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধ মামলায় ফাঁসির রায় দেয়া হয়েছে৷
ছবি: Reuters
ট্রাইব্যুনাল নিয়ে বিতর্ক
একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিশ্চিত করতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার ২০১০ সালে ঢাকায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল প্রতিষ্ঠা করে৷ তবে সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিরোধী দল বিএনপি মনে করে, সরকার বিরোধী দলকে দুর্বল করতে এই ট্রাইব্যুনাল প্রতিষ্ঠা করেছে৷ আন্তর্জাতিক পর্যায়েও এই ট্রাইব্যুনাল নিয়ে বিতর্ক রয়েছে৷
ছবি: AP
জামায়াতের রাজনীতি নিষিদ্ধের দাবি
এদিকে জামায়াতের নিবন্ধন বাতিলের রায়ের পর দলটির রাজনীতি নিষিদ্ধের দাবি আরো জোরালো হয়েছে৷ অধ্যাপক মুনতাসির মামুন জামায়াতকে নিষিদ্ধ করার দাবি জানালেও সরকার এতটা সাহসী হবে বলে আশা করেন না৷ মুনতাসির মামুনের কথায়, ‘‘জামায়াত একটি যুদ্ধাপরাধী দল৷ ট্রাইব্যুনালের একাধিক রায়ে তা বলাও হয়েছে৷ তাই যুদ্ধাপরাধী দল হিসেবেও জামায়াতকে নিষিদ্ধ করা সম্ভব৷’’
ছবি: picture-alliance/dpa
ব্লগারদের সতর্ক প্রতিক্রিয়া
বৃহস্পতিবার আদালত রায় ঘোষণার আগেই ফেসবুকে আরিফ জিবতেক লিখেছেন, ‘‘হাইকোর্টের রায়টা কিন্তু জামায়াত নিষিদ্ধ নিয়া মামলা না৷ মামলাটা হচ্ছে নির্বাচন কমিশনে জামায়াত আইনসিদ্ধভাবে নিবন্ধিত হয়েছে কিনা, সেটা নিয়ে বিবেচনা৷’’ এই ব্লগার লিখেছেন, ‘‘যুদ্ধাপরাধী সংগঠন হিসেবে জামায়াতের বিচার চাই, নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধন নিয়া আমার মাথাব্যথা নাই৷’’
ছবি: privat
এই দাবি নতুন নয়
পরিসংখ্যান বলছে, ১৯৪১ সালে জামায়াত প্রতিষ্ঠার পর মোট তিনবার দলটি নিষিদ্ধ হয়েছে৷ ১৯৫৯ এবং ১৯৬৪ সালে পাকিস্তানে এবং ১৯৭২ সালে স্বাধীন বাংলাদেশে৷ ১৯৭৯ সালের ২৫শে মে জিয়াউর রহমানের শাসনামলে স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো জামায়াত প্রকাশ্যে রাজনীতি করার সুযোগ পায়৷
এদিকে হরতালে বিএনপি এখনো কোনো সমর্থন দেয়নি৷ বিএনপি'র নেতৃত্বে ১৮ দলীয় জোটের অন্যকম শরিক জামায়াতে ইসলামী৷ বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য হান্নান শাহ ডয়চে ভেলেকে বলেন জামায়াত দলীয়ভাবে হরতাল ডেকেছে৷ তাই বিএনপি এই হরতালে সমর্থন দেয়নি৷ অতীতেও যুদ্ধাপরাধের বিচার বন্ধসহ নানা ইস্যুতে জামায়াত হরতাল করেছে৷ সেইসব হরতালেও সমর্থন দেয়নি বিএনপি৷ তিনি বলেন জামায়াত ১৮ দলীয় জোটের শরিক৷ তাই বলে তার সবধরণের দলীয় বিষয়ে বিএনপি'র সমর্থন থাকবে এটা যৌক্তিক নয়৷ আর জোটের কর্মসূচি জোটগতভাবে দেয়া হয়৷ তারপরও যদি জোটের সঙ্গে যুক্ত কোনো দলের হরতালসহ অন্যান্য কর্মসূচিতে জোটের রাজনৈতিক স্বার্থ প্রতিফলিত হয় তাহলে সেই কর্মসূচিতে বিএনপিসহ জোটভুক্ত অন্যান্য দল সমর্থন দিতে পারে৷
তবে হান্নান শাহ মনে করেন সরকার আদালতকে তার রাজনৈতিক উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে ব্যবহার করছে৷ তিনি বলেন পৃথিবীর কোনো দেশে রাজনৈতিক বিষয়ে আদালত সিদ্ধান্ত দেয়না৷ রাজনৈতিক বিষয়ে রাজনৈতিকভাবেই সিদ্ধান্ত হয়৷ তিনি বলেন জামায়াতকে নিবন্ধন দিয়েছে নির্বাচন কমিশন৷ আর এই নিবন্ধন প্রক্রিয়া চলমান৷ কোনো ভুল হলে তা সংশোধনের সুযোগ আছে৷ নিবন্ধন বাতিল করার ক্ষমতাও নির্বাচন কমিশনের৷ তাই এটাকে আদালতে টেনে নেয়ার কোনো যৌক্তিক কারণ নেই৷
হান্নান শাহ বলেন দেশদ্রোহী কার্যকলাপ ছাড়া অন্যকোনো কারণে কোনো দলের নিবন্ধন বাতিল বা দল নিষিদ্ধের বিরুদ্ধে বিএনপি৷ বিএনপি একটি উদার গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় বিশ্বাসী৷ সেখানে ভিন্নমতের সুযোগ থাকতে হবে৷
এদিকে হরতালে ১৮ দলের অন্য কোনো শরিকের সমর্থনও জামায়াত জোগাড় করতে পারছেনা বলে জানা গেছে৷ পয়লা আগস্ট জামায়াতের নিবন্ধন অবৈধ বলে দেয়া হাইকোর্টের রায়ের পর তাৎক্ষণিকভাবে কোনো প্রতিক্রিয়া জানায়নি বিএনপি৷ জামায়াতের ভারপ্রাপ্ত আমীর মকবুল আহমদের অনুরোধে একদিন পর বিএনপি প্রতিক্রিয়া জানায়৷ সেই প্রতিক্রিয়ায় সরাসরি জামায়াতের নাম উল্লেখ না করে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘‘কোনো রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন বাতিল বা দল নিষিদ্ধের বিরুদ্ধে বিএনপি৷''