যুদ্ধাপরাধ মামলায় জামায়াতে ইসলামীর শীর্ষ নেতা গোলাম আযমসহ দু’জনের বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনাল রায় ঘোষণা করবে যে কোনো দিন৷ তাই এ নিয়ে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী অতীত অভিজ্ঞতার আলোকে সর্বোচ্চ সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নিচ্ছে৷
বিজ্ঞাপন
জামায়াতের সাবেক আমির এবং মূল থিংক ট্যাংক গোলাম আযমের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধ মামলার যুক্তি তর্ক এবং দুই পক্ষেরই সমাপনী বক্তব্য শেষ হয়েছে বুধবার৷ ট্রাইব্যুনাল-১ এখন মামলাটি রায়ের অপেক্ষায় রেখেছে৷ যে কোনো দিন রায় দেয়া হবে৷
গোলাম আযমকে গত বছরের ১১ই জানুয়ারি গ্রেপ্তার করা হয়৷ অন্যদিকে জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধ মামলার যুক্তি তর্ক এবং উভয় পক্ষের সমাপনী বক্তব্য শেষ হয় মঙ্গলবার৷ ট্রাইব্যুনাল-২ এই মামলাটিও রায়ের অপেক্ষায় রেখেছে৷ তাকে ২০১০ সালের ১৩ই জুলাই গ্রেপ্তার করা হয়েছিল৷
এর আগে ট্রাইব্যুনালের প্রথম রায়ে জামায়াতের সাবেক নেতা মাওলানা আবুল কালাম আজাদকে পলাতক অবস্থায় ফাঁসির দণ্ড দেয়া হয়৷ তিনি এখনও পলাতক আছেন৷ দ্বিতীয় রায়ে জামায়াত নেতা কাদের মোল্লাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং তৃতীয় রায়ে জামায়াতের নায়েবে আমির মাওলানা দেলোয়ার হোসেন সাঈদীকে ফাঁসির আদেশ দেয় ট্রাইব্যুনাল৷
সাঈদীকে ফাঁসির রায়, জামায়াতের তাণ্ডব
একাত্তরে যুদ্ধাপরাধের একাধিক অভিযোগ প্রমাণ হওয়ায় বৃহস্পতিবার দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে ফাঁসির আদেশ দিয়েছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল৷ এই রায় ঘোষণার পর গোটা বাংলাদেশে তাণ্ডব চালিয়েছে জামায়াত-শিবির৷ এতে হতাহত অনেক৷
ছবি: AFP/Getty Images
ট্রাইব্যুনালের রায়
দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর বিরুদ্ধে ২০টি অভিযোগে গণহত্যা, হত্যা, ধর্ষণ, লুটতরাজসহ মানবতা বিরোধী অপরাধের কথা বলা হয়েছে৷ কয়েকটি অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ হওয়ায় ট্রাইব্যুনাল-১ এর প্রধান বিচারপতি এটিএম ফজলে কবীরের নেতৃত্বে ৩ সদস্যের আদালত মৃত্যুদণ্ডের রায় ঘোষণা করেন৷ অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম জানান, তার বিরুদ্ধে মানবতা বিরোধী ২০টি অভিযোগের ৮টি সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ হয়েছে৷
ছবি: AP
রায়ের পরই তাণ্ডব
সাঈদীকে মৃত্যুদণ্ডের রায় ঘোষণার পরপরই রাজধানী ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলায় সক্রিয় হয়ে ওঠে জামায়াত-শিবির৷ শুধু বৃহস্পতিবার বিভিন্ন স্থানে সংঘর্ষে প্রাণ হারিয়েছে কমপক্ষে ৩৫ ব্যক্তি৷ বার্তাসংস্থা এএফপি এবং আমাদের কন্টেন্ট পার্টনার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম নিশ্চিত করেছে এই তথ্য৷ তবে শুক্রবার মৃতের সংখ্যা আরো বেড়েছে৷
ছবি: Reuters
আক্রান্ত পুলিশ
বৃহস্পতিবার জামায়াতের তাণ্ডবে প্রাণ হারান চার পুলিশ সদস্য৷ এদের মধ্যে তিনজন নিহত হন গাইবান্ধা জেলায়৷ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোরডটকম জানিয়েছে, ‘পুলিশ ফাঁড়িতে পিটিয়ে মারা হয় তাদের’৷ অপর একজন প্রাণ হারান চট্টগ্রামের লোহাগড়ায় সংঘর্ষের সময়৷ বার্তাসংস্থা এএফপি জানিয়েছে, আহত এক পুলিশ সদস্য শুক্রবার প্রাণ হারান৷ সবমিলিয়ে সাঈদীর রায় ঘোষণার পর শুক্রবার দুপুর অবধি পুলিশ সদস্য নিহতের সংখ্যা ৫৷
ছবি: STR/AFP/Getty Images
‘অধিকাংশই জামায়াত-শিবির কর্মী’
জামায়াত দাবি করেছে, ‘‘পুলিশের গুলিতে তাদের ৫০ জন ‘নিরপরাধ’ সমর্থক নিহত হয়েছে৷ পুলিশ তাদেরকে ‘পাখির মতো গুলি করে’ হত্যা করেছে৷’’ তবে মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের প্রধান সুলতানা কামাল পুলিশের উপর সন্ত্রাসী হামলার জন্য জামায়াতকে দায়ী করেছেন৷
ছবি: AFP/Getty Images
প্রাণ হারাচ্ছে নিরীহ মানুষও
জামায়াতের তাণ্ডবে পুলিশ সদস্য প্রাণ হারিয়েছেন, নিহত হয়েছেন আওয়ামী লীগ সমর্থকও৷ তবে সাধারণ মানুষও মরছে এই তাণ্ডবে৷ ঢাকায় বৃহস্পতিবার প্রাণ হারান এক পথচারী, নোয়াখালি এবং বাঁশখালীতে নিহত হন হিন্দু সম্প্রদায়ের দুই ব্যক্তি৷ শুক্রবারও গাইবান্ধায় এক রিকশা চালক নিহত হয়েছেন ক্ষমতাসীন দলের এবং জামায়াতের সমর্থকদের মধ্যকার সংঘর্ষের মাঝে পড়ে৷ নিরীহ প্রাণহানির এরকম খবর আরো শোনা যাচ্ছে৷
ছবি: AFP/Getty Images
‘ফেসবুক বন্ধ’
সাঈদীর বিরুদ্ধে রায় ঘোষণার সময় বাংলাদেশ থেকে কম্পিউটার ব্যবহার করে স্বাভাবিক উপায়ে ফেসবুকে প্রবেশ করা যাচ্ছিল না৷ নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিটিআরসি’র ভাইস চেয়ারম্যান গিয়াসউদ্দিন আহমেদ জানান, ‘কারিগরি সমস্যার জন্য এমনটা হয়েছে’৷ তবে তথ্য প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ জাকারিয়া স্বপন বলেন, ‘বৃহস্পতিবার তারা (বিটিআরসি) কিছুক্ষণের জন্য ফেসবুক বন্ধ করে দিয়েছিল এবং পুনরায় আবারো চালু করেছে৷’
সতর্ক নিরাপত্তা বাহিনী
জামায়াত-শিবির তাণ্ডব আর নাশকতা রুখতে গোটা দেশে সতর্ক রয়েছে নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা৷ বৃহস্পতিবার রাতেই বিভিন্ন এলাকায় মোতায়েন করা হয়েছে বিজিবি৷
ছবি: Reuters
ভিন্ন চিত্র
তবে সাঈদীর ফাঁসির রায়ে সামগ্রিকভাবে সন্তুষ্ট সাধারণ মানুষ৷ বৃহস্পতিবার এই রায় ঘোষণার পর উল্লাসে ফেটে পড়েন শাহবাগে অবস্থানরতরা৷ বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় মিষ্টি বিতরণ করা হয়৷ ফেসবুকে প্রতিক্রিয়া জানান অগুনতি মানুষ৷
ছবি: Reuters
‘শহীদের আত্মা শান্তি পাবে’
সাঈদীর বিরুদ্ধে একটি মামলার বাদি ও প্রথম সাক্ষী মাহবুবুল আলম হাওলাদার৷ রায় ঘোষণার পরে ডয়চে ভেলেকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘সাঈদীর ফাঁসির আদেশ হওয়ায় দেশমাতৃকা কিছুটা পাপমুক্ত হয়েছে, যুদ্ধাপরাধীদের শাস্তির জন্য ৪২ বছরের অপেক্ষার অবসান হতে চলেছে৷’
ছবি: DW/Harun Ur Rashid
আরো রায় বাকি
এখন পর্যন্ত তিন যুদ্ধাপরাধীর বিরুদ্ধে রায় ঘোষণা করছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল৷ বাকি আছে আরো যুদ্ধাপরাধীর বিচার৷ মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের শক্তি অপেক্ষায় আছে সব যুদ্ধাপরাধীর বিচার দেখার৷ বর্তমান তরুণ প্রজন্মও তাই জেগে আছে প্রজন্ম চত্বরে৷
ছবি: AP
10 ছবি1 | 10
কাদের মোল্লার যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের প্রতিবাদে এবং ফাঁসির দাবিতে শাহবাগে গণজাগরণের ফল গণজাগরণ মঞ্চ৷ এই মামলায় সরকার এবং আসামি উভয় পক্ষ সুপ্রিম কোর্টে আপিল করেছে ইতিমধ্যেই৷
ওদিকে, ২৮শে ফেব্রুয়ারি মাওলানা দেলোয়ার হোসেন সাঈদীর ফাঁসির রায় ঘোষণা করার পর এর প্রতিবাদে জামায়াত শিবির সারা দেশে ব্যাপক তাণ্ডব এবং সহিংসতা চালায়৷ সপ্তাহ জুড়ে চলা এই সহিংসতায় থানা ও পুলিশ ফাঁড়িতে হামলা, পুলিশের ওপর হামলা, সংখ্যালঘুদের নির্যাতন ও তাদের বাড়ি-ঘরে হামলা, মন্দিরে হামলার মধ্য দিয়ে দেশে এক বিভীষিকাময় পরিস্থিতি সৃষ্টি করা হয়৷ আর এই তাণ্ডবে সাতজন পুলিশসহ ১২০ জন নিহত হন৷ হামলা আর তাণ্ডবের মাত্রা কিছুটা কমে এলেও থামেনি৷ বরং সর্বশেষ ফটিকছড়িতে তিনজন আওয়ামী লীগ কর্মীকে আটক করে মধ্যযুগীয় কায়দায় কুপিয়ে হত্যার ঘটনায় পুরো জাতি স্তম্ভিত হয়েছে৷
তাই গোলাম আযম এবং কামারুজ্জামানের রায় নিয়ে জনমনে ইতিমধ্যেই তৈরি হয়েছে আতঙ্ক৷ ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির ভারপ্রপাপ্ত সভাপতি শহরিয়ার কবির ডয়চে ভেলেকে জানান, জামায়াত-শিবির ঘোষণা দিয়েই মাঠে নেমেছে৷ তারা দেড় মাস আগে যে তাণ্ডব চালিয়েছে সেই তাণ্ডব আবারো চালাতে চাইবে৷ কিন্তু আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী নিকট অতীতের অভিজ্ঞতার আলোকে প্রস্তুতি নিলে তাদের মোকাবেলা করা সম্ভর হবে বলে মনে করেন তিনি৷ তিনি জানান, ভয়ের ব্যাপার হলো জামায়াত কমান্ডো স্টাইলে হামলা করে৷ তাদের নেতা-কর্মীরা ছদ্মবেশে বিভিন্ন স্থানে অবস্থান করছে৷ এমনকি রিকশাওয়ালার বেশেও আছে তারা৷ তাই তাদের কার্যকরভাবে মোকাবেলা করতে হলে গোয়েন্দা নেটওয়ার্ক শক্তিশালী করতে হবে৷ তিনি মনে করেন, এখানে সামাজিক শক্তিকেও ভূমিকা রাখতে হবে৷ তাদের ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে এবং সৃষ্টি করতে হবে সচেতনতা৷
এদিকে, পুলিশের আইজি হাসান মাহমুদ খন্দকার ডয়চে ভেলেকে জানান, তারা এ ব্যাপারে সতর্ক আছেন৷ দুটি মামলার রায় ঘোষণা নিয়ে ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া কিভাবে মোকাবেলা করা হবে – তা তারা অবশ্যই দেখছেন৷ পুলিশ সদর দপ্তর থেকে জানা গেছে যে, এবার পুরো পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করবে পুলিশসহ আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী৷ অতীতের ঘটনা ফের যাতে না ঘটে তার ব্যবস্থা নেয়া হবে৷ বর্তমানে এ নিয়ে বিস্তারিত কাজ চলছে৷