জামায়াতে ইসলামীসহ দলটির সব স্তরের নেতৃত্ব, সকল আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও দলটির মুখপাত্র দৈনিক সংগ্রামকে নিষিদ্ধ করতে অপরাধ ট্রাইব্যুনালকে সুপারিশ করেছে তদন্ত সংস্থা৷ মঙ্গলবার তারা প্রধান প্রসিকিউটরের কাছে রিপোর্ট জমা দিয়েছে৷
বিজ্ঞাপন
রাজধানীর ধানমণ্ডির তদন্ত কার্যালয়ের সেইফ হোমে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনের তদন্ত প্রতিবেদনের বিস্তারিত তুলে ধরা হয়৷ তদন্ত দলের প্রধান আব্দুল হান্নান খান ডয়চে ভেলেকে জানান, ‘‘তদন্ত সংস্থার কাছে প্রমাণিত হয়েছে ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ থেকে ১৬ই ডিসেম্বর পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পুরো বাংলাদেশে সংগঠিত সকল মানবতা বিরোধী অপরাধের জন্য দায়ী জামায়াতে ইসলামী৷'' এছাড়াও দলটির তত্কালীন ছাত্রসংগঠন ছাত্র সংঘ, শান্তি কমিটি, রাজাকার, আলবদর, আলশামস ও দৈনিক সংগ্রামকে দায়ী করা হয় তদন্ত প্রতিবেদনে৷ ৩৭৩ পৃষ্ঠার তদন্ত প্রতিবেদন তার বিস্তারিত তথ্য প্রমাণ আছে বলে জানান তিনি৷
কাদের মোল্লার ফাঁসি পরবর্তী ২৪ ঘণ্টা
একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে ফাঁসিতে ঝোলা কাদের মোল্লাকে ইসলামপন্থিরা বলছেন ‘শহিদ৷’ এই শহিদের মৃত্যুর প্রতিবাদে বিভিন্ন জেলায় চলছে সহিংসতা৷ মোল্লার ফাঁসি পরবর্তী চব্বিশ ঘণ্টা নিয়ে আমাদের বিশেষ ছবিঘর৷
ছবি: AP
ইসলামপন্থিদের কাছে ‘শহিদ’
জামায়াতে ইসলামীর নেতাকর্মীরা কাদের মোল্লাকে মনে করছেন একজন ‘শহিদ৷’ যিনি ‘‘ইসলামি আন্দোলন করার কারণে’’ ফাঁসির দড়িতে ঝুলেছেন৷ এই ‘শহিদের’ মৃত্যুতে তাই শুক্রবার বিভিন্ন জেলায় গায়েবানা জানাজার আয়োজন করে জামায়াত-শিবির৷ মোল্লার জন্য পাকিস্তানেও গায়েবানা জানাজা অনুষ্ঠিত হয়েছে৷ ছবিটি সেখানকার৷
ছবি: Rizwan Tabassum/AFP/Getty Images
অনেকের কাছে ‘মিরপুরের কসাই’
তবে বাংলাদেশে অনেকেই কাদের মোল্লাকে মনে করেন ‘মিরপুরের কসাই,’ যিনি ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে মানবতাবিরোধী অপরাধের সঙ্গে জড়িত ছিলেন৷ ঢাকার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে তার বিরুদ্ধে আনা মানবতাবিরোধী ছয়টি অভিযোগের পাঁচটি প্রমাণিত হয়েছে৷ ফলে তাকে দেওয়া মৃত্যুদণ্ডের সাজা বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ সময় রাত দশটা এক মিনিটে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে কার্যকর হয়৷
ছবি: Mustafiz Mamun
মোল্লার পরিবার আক্রান্ত
জামায়াত নেতা কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকর হওয়ার পর ঢাকার মগবাজারে তার পরিবারের উপর হামলার অভিযোগ উঠেছে৷ কাদের মোল্লার ছেলে হাসান জামিল বাংলাদেশের একাধিক সংবাদপত্রের কাছে দাবি করেন, ‘‘কিছু ছাত্রলীগের নেতা পরিবারের সদস্যদের উপর হামলা চালায়৷’’ এসময় মোল্লা পরিবারের কয়েক সদস্যকে পুলিশ থানায় নিয়ে যায়৷
ছবি: Getty Images/Afp/Munir Uz Zaman
ফরিদপুরে শেষ ঠিকানা
বৃহস্পতিবার রাতে মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের পর মাইক্রোবাসে করে কাদের মোল্লার মরদেহ ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে বের করা হয়৷ বাংলাদেশে ডয়চে ভেলের কন্টেন্ট পার্টনার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম লিখেছে, ‘‘স্থানীয় সময় রাত ৪টার দিকে ফরিদপুরের আমিরাবাদ গ্রামে লাশ পৌঁছানোর পর জানাজা শেষে লাশ দাফন করা হয়৷’’
ছবি: Mustafiz Mamun
ফাঁসির রায় উদযাপন
একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে কাদের মোল্লার সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করতে গত ফেব্রুয়ারি মাসে ঢাকার শাহবাগে সমবেত হন অসংখ্য মানুষ৷ তাদের আন্দোলনের ফলে পরবর্তীতে আইন সংশোধন করে কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে দেয়া রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করা হয়৷ সেই আপিলে মৃত্যুদণ্ড নিশ্চিত হয় মোল্লার৷ রায় কার্যকরের পর স্বাভাবিকভাবেই তাই শাহবাগে আনন্দ মিছিল দেখা গেছে৷
ছবি: Mustafiz Mamun
ব্যাপক সহিংসতা
এদিকে, শুক্রবার বাংলাদেশে সহিংসতায় প্রাণ হারিয়েছেন কমপক্ষে পাঁচ ব্যক্তি৷ রাজধানী ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলায় সড়ক অবরোধ করে, সেতু ভেঙে, গাড়ি পুড়িয়ে চালানো হচ্ছে নাশকতা৷ এমতাবস্থায় সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল৷
ছবি: DW/M. Mamun
তবে সাঈদীর মতো নয়
নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ শাহেদুল আনাম খান এবং শরীফ এ কাফি অবশ্য ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘জামায়াত তার সহিংস তত্পরতা নিয়ে কতদূর এগোতে পারবে তাও দেখার বিষয় আছে৷ কারণ সাঈদীর ফাঁসির রায়ের পর তারা যে মাত্রায় সহিংসতা চালাতে সক্ষম হয়েছিল এবার এখন পর্যন্ত তারা সেই মাত্রায় যেতে পারেনি৷ এর কারণ আগের অভিজ্ঞতা থেকে সরকার পূর্ব-প্রস্তুতি নিয়েছে৷’’ তবে এই প্রস্তুতি যথেষ্ট নয় বলেই মনে করেন এই দুই বিশেষজ্ঞ৷
ছবি: DW/M. Mamun
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া
জামায়াত নেতা কাদের মোল্লাকে ফাঁসি না দিতে বাংলাদেশ সরকারকে অনুরোধ করেছিল জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশন এবং হিউম্যান রাইটস ওয়াচসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংগঠন৷ তবে মোল্লার ফাঁসির রায় কার্যকরের পর ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, আব্দুল কাদের মোল্লার মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের বিষয়টি বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়৷
ছবি: Reuters
মৃত্যুদণ্ড সমর্থন করে না জার্মানি
বৃহস্পতিবার জার্মানির মানবাধিকার বিষয়ক কমিশনার মার্কুস ল্যোনিং এক বিবৃতিতে কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকর না করতে বাংলাদেশ সরকারকে অনুরোধ জানিয়েছিলেন৷ তিনি বলেছিলেন, ‘‘জার্মানি নীতিগতভাবে মৃত্যুদণ্ড সমর্থন করে না৷’’ তাই ফাঁসির পরিবর্তে কারাদণ্ড দেবার অনুরোধ জানিয়েছিলেন তিনি৷
ছবি: dapd
ট্রাইব্যুনাল নিয়ে বিতর্ক
একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিশ্চিত করতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার ২০১০ সালে ঢাকায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল প্রতিষ্ঠা করে৷ তবে সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিরোধী দল বিএনপি মনে করে, সরকার বিরোধী দলকে দুর্বল করতে এই ট্রাইব্যুনাল প্রতিষ্ঠা করেছে৷ আন্তর্জাতিক পর্যায়েও এই ট্রাইব্যুনাল নিয়ে বিতর্ক রয়েছে৷
ছবি: AP
10 ছবি1 | 10
প্রতিবেদনে জামায়াতের ৭ ধরনের অপরাধের কথা বলা হয়েছে৷ অভিযোগগুলো হল: ১. মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ ২. গণহত্যা ৩. যুদ্ধাপরাধ ৪. জেনেভা কনভেনশন বিরোধী অপরাধ ৫. আন্তর্জাতিক আইনে মানবতা বিরোধী অপরাধ ৬. অপরাধের ষড়যন্ত্র ও সহযোগিতা এবং ৭. অপরাধ প্রতিরোধে কোন ব্যবস্থা না নেওয়া৷ সংগঠন হিসাবে জামায়াতের সব স্তরের কর্মী এই অপরাধে অংশ নিয়েছে৷ আর তাদের সহযোগী সংগঠন এবং মুখপাত্র দৈনিক সংগ্রামও একই অপরাধে জড়িত ছিল৷ তাই প্রতিবেদনে জামায়াতসহ দলটির কেন্দ্র থেকে সব স্তরের নেতাদের অভিযুক্ত করে তাঁদের নিষিদ্ধ করার দাবি জানানো হয়েছে৷ সাক্ষী রাখা হয়েছে ৭০ জন৷
মঙ্গলবার সকালেই প্রধান প্রসিকিউটরের কাছে এই তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়া হয়৷ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর রানা দাসগুপ্ত ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘চিফ প্রসিকিউটর তদন্ত প্রতিবেদন এখন পর্যালোচনা করে দেখবেন৷ প্রতিবেদনে যদি জামায়াতের বিরুদ্ধে মানবতা বিরোধী অপরাধের প্রমাণ পাওয়া যায়, তা হলে ট্রাইব্যুনালে অভিযোগ গঠনের আবেদন করা হবে৷ আর ট্রাইব্যুনাল শুনানি করে সন্তুষ্ট হলে অভিযোগ গঠন এবং বিচার কাজ শুরু করবেন৷''
তিনি আরও বলেন, ‘‘ট্রাইব্যুনালের আইন সংশোধন করে ব্যক্তির পাশাপাশি সংগঠনের বিচারের বিধান করা হয়েছে৷ ট্রাইব্যুনাল আইনের ২০ ধারায় বলা হয়েছে মানবতাবিরোধী অপরাধের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড অথবা ট্রাইব্যুনাল যে রকম শাস্তি দেয়া যৌক্তিক মনে করেন৷ তাই বিচারে জামায়াত দোষী প্রমাণিত হলে দলটি নিষিদ্ধ হতে পারে৷ দলের সব ধরনের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত হতে পারে৷ জামায়াতের সঙ্গে জড়িতরাও নিষিদ্ধ হতে পারেন৷''
গত বছরের ১লা আগস্ট জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন অবৈধ ঘোষণা করেন হাইকোর্ট৷ কিন্তু জামায়াত এখনো নিষিদ্ধ নয়৷ তবে এর আগে তিনবার নিষিদ্ধ হয়েছিল জামায়াতে ইসলামী৷ ১৯৫৯ এবং ১৯৬৪ সালে পাকিস্তানে নিষিদ্ধ হয় জামায়াত৷ আর বাংলাদেশে নিষিদ্ধ হয় ১৯৭২ সালে৷ জিয়াউর রহমানের শাসনামলে আমলে ১৯৭৯ সালের ২৫শে মে বাংলাদেশে রাজনীতি করার সুযোগ পায় জামায়াতে ইসলামী৷