সাতক্ষীরা জেলায় গত কয়েকমাস ধরে সহিংসতা চলার পর এখন পরিস্থিতি কিছুটা শান্ত৷ রবিবার যৌথবাহিনী অভিযান পরিচালনার পর সেখানকার জামায়াত অধ্যুষিত এলাকাগুলো পুরুষশূন্য হয়ে আছে বলে জানান স্থানীয় সাংবাদিক মোস্তাফিজুর রহমান উজ্জল৷
বিজ্ঞাপন
সাতক্ষীরায় গত ফেব্রুয়ারি মাস থেকেই সহিংসতা চলছিল৷ প্রশাসনের ভাষায়, এসব নাশকতা কিংবা সন্ত্রাসী হামলার শুরু হয় গত ২৮ ফেব্রুয়ারি, একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে জামায়াত নেতা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর মৃত্যুদণ্ডের রায় ঘোষণার পর থেকে৷ ২৮ ফেব্রুয়ারি থেকে ১৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়ের মধ্যে সেখানে রাজনৈতিক অস্থিরতায় প্রাণ হারিয়েছে বেশ কয়েকজন৷
সহিংসতায় সাতক্ষীরায় আওয়ামী লীগের ১৭ নেতাকর্মী নিহত হয়েছেন৷
আওয়ামী লীগের ‘১৭ নেতাকর্মী' নিহত
সাতক্ষীরার সাংবাদিক মোস্তাফিজুর রহমান উজ্জল মঙ্গলবার ডয়চে ভেলেকে জানান, ২৮ ফেব্রুয়ারির পর থেকে সহিংসতায় সাতক্ষীরায় আওয়ামী লীগের ১৭ নেতাকর্মী নিহত হয়েছেন৷ তিনি বলেন, ‘‘জামায়াত-শিবির এবং তাদের সহযোগীদের হাতে এপর্যন্ত আমরা প্রায় সতেরজন আওয়ামী লীগ সমর্থিত লোকজনকে নিহত হতে দেখেছি৷''
একই সময়ে পুলিশের বিভিন্ন অভিযানে, গোলাগুলিতে ত্রিশ ব্যক্তি নিহত হয়েছে, যাদের মধ্যে জামায়াতে ইসলামীর নেতাকর্মীসহ সাধারণ মানুষ এবং বিএনপির সমর্থক রয়েছে বলে জানান উজ্জল৷ তিনি বলেন, ‘‘পুলিশের গুলিতে এসব প্রাণহানি নিয়ে আমরা নিয়মিত রিপোর্ট করেছি৷ নিহতের সংখ্যার ক্ষেত্রে কিছুটা তারতম্য হতে পার, কিন্তু সবমিলিয়ে সংখ্যাটি কম নয়৷''
যৌথ অভিযানে প্রাণহানি
সাতক্ষীরার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রবিবার রাত থেকে যৌথ অভিযান শুরু করে পুলিশ, র্যাব ও বিজিবি৷ এই অভিযানে প্রাণহানির ঘটনা নিয়ে বিভিন্ন পক্ষ থেকে বিভিন্ন রকম তথ্য পাওয়া যাচ্ছে৷ সাতক্ষীরা প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক উজ্জল বলেন, ‘‘প্রথম দিনের অভিযানের ব্যাপারে সাতক্ষীরার নবাগত পুলিশ সুপার চৌধুরী মঞ্জুরুল কবির আমাদের বলেছিলেন, অভিযানে জামায়াত-শিবিরের পাঁচজন নেতাকর্মী নিহত হয়েছে৷ কিন্তু আমরা খোঁজখবর নিয়ে যা দেখলাম এবং জামায়াতের পক্ষ থেকে আমাদের যা জানানো হয়েছে তাতে এই অভিযানে তাদের একজন কর্মী নিহত হয়েছে এবং বেশ কয়েকজন কর্মী গুলিবিদ্ধ হয়েছে৷''
কাদের মোল্লার ফাঁসি পরবর্তী ২৪ ঘণ্টা
একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে ফাঁসিতে ঝোলা কাদের মোল্লাকে ইসলামপন্থিরা বলছেন ‘শহিদ৷’ এই শহিদের মৃত্যুর প্রতিবাদে বিভিন্ন জেলায় চলছে সহিংসতা৷ মোল্লার ফাঁসি পরবর্তী চব্বিশ ঘণ্টা নিয়ে আমাদের বিশেষ ছবিঘর৷
ছবি: AP
ইসলামপন্থিদের কাছে ‘শহিদ’
জামায়াতে ইসলামীর নেতাকর্মীরা কাদের মোল্লাকে মনে করছেন একজন ‘শহিদ৷’ যিনি ‘‘ইসলামি আন্দোলন করার কারণে’’ ফাঁসির দড়িতে ঝুলেছেন৷ এই ‘শহিদের’ মৃত্যুতে তাই শুক্রবার বিভিন্ন জেলায় গায়েবানা জানাজার আয়োজন করে জামায়াত-শিবির৷ মোল্লার জন্য পাকিস্তানেও গায়েবানা জানাজা অনুষ্ঠিত হয়েছে৷ ছবিটি সেখানকার৷
ছবি: Rizwan Tabassum/AFP/Getty Images
অনেকের কাছে ‘মিরপুরের কসাই’
তবে বাংলাদেশে অনেকেই কাদের মোল্লাকে মনে করেন ‘মিরপুরের কসাই,’ যিনি ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে মানবতাবিরোধী অপরাধের সঙ্গে জড়িত ছিলেন৷ ঢাকার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে তার বিরুদ্ধে আনা মানবতাবিরোধী ছয়টি অভিযোগের পাঁচটি প্রমাণিত হয়েছে৷ ফলে তাকে দেওয়া মৃত্যুদণ্ডের সাজা বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ সময় রাত দশটা এক মিনিটে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে কার্যকর হয়৷
ছবি: Mustafiz Mamun
মোল্লার পরিবার আক্রান্ত
জামায়াত নেতা কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকর হওয়ার পর ঢাকার মগবাজারে তার পরিবারের উপর হামলার অভিযোগ উঠেছে৷ কাদের মোল্লার ছেলে হাসান জামিল বাংলাদেশের একাধিক সংবাদপত্রের কাছে দাবি করেন, ‘‘কিছু ছাত্রলীগের নেতা পরিবারের সদস্যদের উপর হামলা চালায়৷’’ এসময় মোল্লা পরিবারের কয়েক সদস্যকে পুলিশ থানায় নিয়ে যায়৷
ছবি: Getty Images/Afp/Munir Uz Zaman
ফরিদপুরে শেষ ঠিকানা
বৃহস্পতিবার রাতে মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের পর মাইক্রোবাসে করে কাদের মোল্লার মরদেহ ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে বের করা হয়৷ বাংলাদেশে ডয়চে ভেলের কন্টেন্ট পার্টনার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম লিখেছে, ‘‘স্থানীয় সময় রাত ৪টার দিকে ফরিদপুরের আমিরাবাদ গ্রামে লাশ পৌঁছানোর পর জানাজা শেষে লাশ দাফন করা হয়৷’’
ছবি: Mustafiz Mamun
ফাঁসির রায় উদযাপন
একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে কাদের মোল্লার সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করতে গত ফেব্রুয়ারি মাসে ঢাকার শাহবাগে সমবেত হন অসংখ্য মানুষ৷ তাদের আন্দোলনের ফলে পরবর্তীতে আইন সংশোধন করে কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে দেয়া রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করা হয়৷ সেই আপিলে মৃত্যুদণ্ড নিশ্চিত হয় মোল্লার৷ রায় কার্যকরের পর স্বাভাবিকভাবেই তাই শাহবাগে আনন্দ মিছিল দেখা গেছে৷
ছবি: Mustafiz Mamun
ব্যাপক সহিংসতা
এদিকে, শুক্রবার বাংলাদেশে সহিংসতায় প্রাণ হারিয়েছেন কমপক্ষে পাঁচ ব্যক্তি৷ রাজধানী ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলায় সড়ক অবরোধ করে, সেতু ভেঙে, গাড়ি পুড়িয়ে চালানো হচ্ছে নাশকতা৷ এমতাবস্থায় সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল৷
ছবি: DW/M. Mamun
তবে সাঈদীর মতো নয়
নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ শাহেদুল আনাম খান এবং শরীফ এ কাফি অবশ্য ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘জামায়াত তার সহিংস তত্পরতা নিয়ে কতদূর এগোতে পারবে তাও দেখার বিষয় আছে৷ কারণ সাঈদীর ফাঁসির রায়ের পর তারা যে মাত্রায় সহিংসতা চালাতে সক্ষম হয়েছিল এবার এখন পর্যন্ত তারা সেই মাত্রায় যেতে পারেনি৷ এর কারণ আগের অভিজ্ঞতা থেকে সরকার পূর্ব-প্রস্তুতি নিয়েছে৷’’ তবে এই প্রস্তুতি যথেষ্ট নয় বলেই মনে করেন এই দুই বিশেষজ্ঞ৷
ছবি: DW/M. Mamun
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া
জামায়াত নেতা কাদের মোল্লাকে ফাঁসি না দিতে বাংলাদেশ সরকারকে অনুরোধ করেছিল জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশন এবং হিউম্যান রাইটস ওয়াচসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংগঠন৷ তবে মোল্লার ফাঁসির রায় কার্যকরের পর ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, আব্দুল কাদের মোল্লার মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের বিষয়টি বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়৷
ছবি: Reuters
মৃত্যুদণ্ড সমর্থন করে না জার্মানি
বৃহস্পতিবার জার্মানির মানবাধিকার বিষয়ক কমিশনার মার্কুস ল্যোনিং এক বিবৃতিতে কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকর না করতে বাংলাদেশ সরকারকে অনুরোধ জানিয়েছিলেন৷ তিনি বলেছিলেন, ‘‘জার্মানি নীতিগতভাবে মৃত্যুদণ্ড সমর্থন করে না৷’’ তাই ফাঁসির পরিবর্তে কারাদণ্ড দেবার অনুরোধ জানিয়েছিলেন তিনি৷
ছবি: dapd
ট্রাইব্যুনাল নিয়ে বিতর্ক
একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিশ্চিত করতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার ২০১০ সালে ঢাকায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল প্রতিষ্ঠা করে৷ তবে সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিরোধী দল বিএনপি মনে করে, সরকার বিরোধী দলকে দুর্বল করতে এই ট্রাইব্যুনাল প্রতিষ্ঠা করেছে৷ আন্তর্জাতিক পর্যায়েও এই ট্রাইব্যুনাল নিয়ে বিতর্ক রয়েছে৷
ছবি: AP
10 ছবি1 | 10
যৌথবাহিনীর অভিযান শুরুর পর থেকে বেশ কয়েকজন জামায়াত কর্মীর খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না বলে জেনেছেন মোস্তাফিজুর রহমান উজ্জল৷ তিনি ডয়চে ভেলেকে জানান, জামায়াত বলছে, তাদের বেশ কয়েকজন কর্মীকে পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে৷ তাদের খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না৷
‘এলাকা পুরুষশূন্য'
প্রসঙ্গত, সাতক্ষীরায় জামায়াত নেতা আবদুল খালেকের বাড়ি বুলডোজার চালিয়ে গুড়িয়ে দেয়া হয়েছে বলে একটি খবর ফেসবুকে ছবিসহ ছড়ানো হচ্ছে৷ এই বিষয়ে উজ্জল বলেন, ‘‘জেলা জামায়াতের আমীর এবং সাবেক সংসদ সদস্য আব্দুল খালেক মন্ডলের বাড়িতে ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে৷ পুলিশ আমাদের বলেছে যে, এটি আসলে বিক্ষুব্ধ জনতার আক্রোশের প্রতিফলন৷''
তিনি বলেন, ‘‘আমরা পুলিশের কাছে জানতে চেয়েছি, বুলডোজারতো সাধারণ মানুষ ব্যবহার করতে পারে না৷ তারা আমাদের এই প্রশ্ন এড়িয়ে গেছে৷''
এদিকে, যৌথ অভিযান শুরুর পর থেকে জামায়াত অধ্যুষিত এলাকাগুলো পুরুষশূন্য হয়ে আছে বলে জানান উজ্জল৷ তিনি বলেন, ‘‘পুলিশের অভিযান অব্যাহতভাবে চলায় এলাকাগুলোতে পুরুষের উপস্থিতি আমরা দিনের বেলায় দেখতে পাচ্ছি না৷ পুরুষরা বিভিন্ন জায়গায় আত্মগোপনে আছে৷''
সাতক্ষীরায় ফেব্রুয়ারি মাস থেকে চলা সহিংসতায় সাংবাদিকরাও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন বলে জানান মোস্তাফিজুর রহমান উজ্জল৷ তিনি মনে করেন, আসন্ন নির্বাচন নিয়ে সাতক্ষীরায় তেমন কোনো উত্তাপ না থাকলেও নির্বাচন পরিচালনা করতে হলে নিরাপত্তা বাহিনীর শক্ত উপস্থিতি থাকতে হবে৷ সেক্ষেত্রে যৌথবাহিনীর অভিযান চালিয়ে যাওয়া উচিত বলে মনে করেন মাছরাঙ্গা টেলিভিশন এবং আমাদের সময়ের এই সাতক্ষীরা প্রতিনিধি৷ যৌথ অভিযান থেমে গেলে জামায়াত আবারো প্রতিশোধ নিতে সক্রিয় হতে পারে বলে শঙ্কা তাঁর৷