সন্ত্রাসবিরোধী আইনে যাত্রাবাড়ী থানায় দায়ের করা জঙ্গি মামলায় জামায়াতে ইসলামির আমির ডা. শফিকুর রহমানকে সাত দিনের রিমান্ড দিয়েছেন ঢাকার একটি আদালত৷
বিজ্ঞাপন
এর আগে, ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিটের পরিদর্শক ও মামলার তদন্ত কর্মকর্তা মো. আবুল বাশার ১০ দিনের রিমান্ড আবেদন করেন৷
রিমান্ড আবেদনে বলা হয়, শফিকুর রহমান দেশে নাশকতামূলক কর্মকাণ্ড সৃষ্টিতে নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন আনসার আল ইসলামের সদস্যদের সহায়তার সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত ছিলেন। নতুন জঙ্গি সংগঠন জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়ার সঙ্গেও তার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। এছাড়া, তিনি তার ছেলের (ড. রাফাত চৌধুরী) জঙ্গি কার্যকলাপের বিষয়েও অবগত ছিলেন। তাই এ ঘটনা নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পেতে তাকে রিমান্ডে নেওয়া দরকার।
জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমানকে গ্রেপ্তার করার কথা জানিয়েছে পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট-সিটিটিসি৷ এক মাস আগে ডা.শফিকুর রহমানের ছেলেকে জঙ্গিবাদে জড়িত থাকার অভিযোগে গ্রেপ্তার হয়৷
সোমবার রাত ১টার দিকে ঢাকার বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার বাসা থেকে শফিকুর রহমানকে আটক করে নিয়ে যাওয়া হয় বলে জামায়াত নেতাদের ভাষ্য৷
কোন মামলায় তাকে আটক করা হয়েছে জানতে চাইলে সিটিটিসি প্রধান মো. আসাদুজ্জামান মঙ্গলবার সকালে ডয়চে ভেলের কনটেন্ট পার্টনার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, "উনাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে৷ বাকি বিষয়ে আমরা পরে বিস্তারিত জানাব৷”
জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ থেকে ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা এটিএম মা'ছুম গণমাধ্যমে বিবৃতি পাঠিয়ে তাদের আমিরের গ্রেপ্তারের প্রতিবাদ ও নিন্দা জানিয়েছেন৷
বিবৃতিতে বলা হয়, "অবিলম্বে জামায়াতে ইসলামীরআমীর ডা. শফিকুর রহমানসহ গ্রেপ্তারকৃত জামায়াতের সকল নেতা-কর্মী এবং গ্রেপ্তারকৃত অন্যান্য রাজনৈতিক দলের সকল নেতৃবৃন্দকে নিঃশর্তভাবে মুক্তি দেওয়ার জন্য আমি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের প্রতি আহবান জানাচ্ছি৷”
এর আগে গত ৯ নভেম্বর শফিকুর রহমানের ছেলে রাফাত সাদিক সাইফুল্লাহকে নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন আনসার আল ইসলামের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে সিলেট থেকে গ্রেপ্তার করে সিটিটিসি৷
সিটিটিসি প্রধান আসাদুজ্জামান সে সময় বলেছিলেন,ঢাকার যাত্রাবাড়ী থানা এলাকা থেকে গ্রেপ্তার আনসার আল ইসলামের তিন সদস্য আদালতে যে জবানবন্দি দিয়েছেন, সেখানে রাফাতের নাম আসে৷
"তারা বলেছে, রাফাত তাদের এই সংগঠনের সাথে সম্পৃক্ত করতে দাওয়াত দিয়েছিল৷ এই তিনজনসহ প্রায় ১১জন এই রাফাতের দাওয়াতে হিজরতের উদ্দেশ্যে ঘর ছেড়েছিল৷”
রাফাত ওই জঙ্গি সংগঠনটির ‘সিলেট অঞ্চলের প্রধান সমন্বয়কের' দায়িত্বে রয়েছেন জানিয়ে আসাদুজ্জামান সে সময় বলেছিলেন, "রাফাতের বিরুদ্ধে আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (আরসা) এবং রোহিঙ্গা সলিডারিটি অরগানাইজেশনের (আরএসও) যোগাযোগের তথ্য পাওয়া গেছে৷”
জামায়াত আমির শফিকুর রহমান একসময় তাদের দলের ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্র শিবিরের সিলেট শাখার সভাপতি ছিলেন৷ তার বাড়ি মৌলভীবাজারের কুলাউড়া উপজেলায়৷ ১৯৮৩ সালে তিনি সিলেট মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাস করেন৷
একাত্তরের যুদ্ধাপরাধের দায়ে জামায়াতের শীর্ষ নেতাদের মৃত্যুদণ্ড হওয়ার পর বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতাকারী এ দলের নেতৃত্বে আসেন শফিকুর৷ ২০১১ সালের সেপ্টেম্বর থেকে জামায়াতের ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল এবং ২০১৭ সাল থেকে তিনি সেক্রেটারি জেনারেলের দায়িত্ব পালন করেন৷ পরে ২০১২ সালের নভেম্বরে পান আমির পদ৷
গত একাদশ সংসদ নির্বাচনে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের প্রার্থী হয়ে ধানের শীষ প্রতীকে ঢাকা-১৫ আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে শফিকুর হেরে যান৷
১৯৪১ সালের ২৬ আগস্ট জামায়াতে ইসলামী হিন্দ নামে উপমহাদেশে জামায়াতে ইসলামীর যাত্রা শুরু হয়৷ দলটির প্রতিষ্ঠাতা সায়েদ আবুল আলা মওদুদী৷ এরপর ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর গঠিত হয় জামায়াতে ইসলামী পাকিস্তান৷ বাংলাদেশ অংশের নাম হয় পূর্ব পাকিস্তান জামায়াতে ইসলামী, যার প্রধান ছিলেন গোলাম আযম৷ ১৯৬৪ সালে পাকিস্তানে জামায়াতে ইসলামী নিষিদ্ধ হয়৷ তবে কয়েকমাস পরই নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়া হয়েছিল৷
ছবি: Jamaat-e-islami.org
সুবিধাবাদী দল
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষক মামুন আল মোস্তফা সম্প্রতি এক প্রবন্ধে লিখেছেন, ‘‘১৯৪১ সালে কার্যক্রম শুরুর পর থেকে বিভিন্ন বিষয়ে নিজেদের অবস্থান সুবিধা পেলেই বদলে ফেলেছে জামায়াত৷’’ তিনি বলেন, অন্য অনেক দলের মতোই যেখানে লাভ দেখেছে, বিনা দ্বিধায় সে পথে গেছে দলটি৷ ‘‘জামায়াত পাকিস্তানের বিরোধিতা করলেও ১৯৪৭ সালে দেশভাগের সময় দলটির শীর্ষ নেতৃত্ব পাকিস্তানে চলে যায়৷’’ আরও জানতে ক্লিক ‘+’৷
ছবি: picture-alliance/ZUMA Press/Z.H. Chowdhury
মুক্তিযুদ্ধে বিরোধিতা
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করে জাময়াতে ইসলামী৷ শুধু বিরোধিতা নয়, গণহত্যা, ধর্ষণ, লুটতরাজসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ আছে দলটির বিরুদ্ধে৷
ছবি: National Monument of Savar
বাংলাদেশে নিষিদ্ধ, তারপর আবার...
স্বাধীন হওয়ার পর বাংলাদেশে জামায়াতে ইসলামী নিষিদ্ধ হয়৷ তবে ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার পর জামায়াতে ইসলামী রাজনীতিতে সক্রিয় হয়৷ ১৯৭৬ সালে জিয়াউর রহমান সুযোগ করে দিলে ইসলামিক ডেমোক্র্যাটিক পার্টি নামে জামায়াত কাজ শুরু করে৷ বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার আগেই পালিয়ে যাওয়া গোলাম আযম ১৯৭৯ সালে বাংলাদেশে ফিরে এলে জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ নামে কাজ শুরু করে৷
ছবি: picture-alliance/epa/Ahmad Fayyaz
নির্বাচনি রাজনীতিতে জামায়াত
জামায়াত বাংলাদেশে প্রথম নির্বাচনে অংশ নেয় ১৯৮৬ সালের তৃতীয় সংসদ নির্বাচনে৷ সেই বার তারা ১০টি আসন পায়৷ এরপর ১৯৯৬ সালে ৩টি, ২০০১ সালে বিএনপির সঙ্গে ঐক্য করে ১৭টি আর ২০০৮ সালে দু’টি আসন লাভ করে৷ এর মধ্যে ২০০১ থেকে ২০০৬ পর্যন্ত জামায়াতের দু’জন নেতা মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন৷
ছবি: AFP/Getty Images
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুন্যাল গঠন
নির্বাচনি প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী, ২০১০ সালে ২৫শে মার্চ যুদ্ধাপরাধের বিচারে মানবতাবিরোধী আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠন করে আওয়ামী লীগ সরকার৷ ট্রাইব্যুনালের রায়ে জামায়াত নেতাদের দণ্ড ছাড়াও দলটিকেও যুদ্ধাপরাধী রাজনৈতিক দল হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে৷
ছবি: AP
মীর কাসেমের ফাঁসি বড় ধাক্কা
যুদ্ধাপরাধের বিচার বানচালের জন্য জামায়াত সবসময়ই সক্রিয় ছিল৷ এ লক্ষ্যে প্রচুর অর্থ খরচ করে বিচার বন্ধ ও জামায়াত নেতাদের রক্ষায় আন্তর্জাতিক লবিস্ট নিয়োগ করা হয়৷ এই কাজের নেতৃত্বে ছিলেন মীর কাসেম আলী৷ তিনি মূলত জামায়াতের ব্যবসা-বাণিজ্য এবং শিল্প প্রতিষ্ঠান দেখভাল করতেন৷ মীর কাসেম আলির ফাঁসি কার্যকর হওয়ায় জামায়াতের অর্থনৈতিক ভিত্তিতে আঘাত লেগেছে বলে মনে করা হচ্ছে৷
ছবি: STRINGER/AFP/Getty Images
নিবন্ধন বাতিল হয়েছে, দল নয়
সর্বোচ্চ আদালতের নির্দেশে নির্বাচন কমিশন জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল করেছে৷ ফলে দলটি এখন আর দলীয়ভাবে এবং দাঁড়িপাল্লা ব্যবহার করে নির্বাচনে অংশ নেয়ার সুযোগ পাচ্ছে না৷ তবে দল হিসেবে জামায়াত এখনও বৈধ একটি রাজনৈতিক সংগঠন৷
ছবি: DW
নতুন আমির কে হচ্ছেন?
যুদ্ধাপরাধের দায়ে দলের শীর্ষ কয়েকজন নেতার ফাঁসি কার্যকর হওয়ায় নতুন নেতৃত্ব গঠনের প্রক্রিয়া শুরু হয়৷ বর্তমানে মকবুল আহমেদই দলটির আমিরের দায়িত্ব পালন করছেন৷