সেই ব্যক্তি বা সংগঠনই স্বতন্ত্র মর্যাদা নিয়ে বিকশিত হয় – গুরুত্বপূর্ণ সময়ে যারা সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারে৷ প্রশ্ন হচ্ছে, জামায়াতে ইসলামী কি সেই সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছে?
বিজ্ঞাপন
১.
বিতর্কিত মওদুদীর বিতর্কিত তত্ত্বের ওপর প্রতিষ্ঠিত জামায়াত কখনো সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি৷ জামায়াতের নেতারা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময়ে, সবচেয়ে ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছেন৷ ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড করেছেন৷ মানুষ হত্যা, লুট, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগের মতো ভয়াবহ অপরাধ করেছেন৷ অপরাধী বাহিনী রাজাকার, আল-বদর, আল-শামস গঠন করেছেন৷ জামায়াত নেতারা নেতৃত্বে থেকে মানবতাবিরোধী অপরাধ করিয়েছেন৷
বলছি ১৯৭১ সালের কথা, বাংলাদেশের জন্ম সময়ের কথা৷ এত বড় অপরাধ করেও জামায়াত কখনো অনুশোচনা করেনি৷ দাম্ভিকতা দেখিয়েছে৷ সামরিক শাসকদের সহায়তা তাদের দাম্ভিকতা প্রদর্শনে সহায়তা করেছে৷
২.
স্বাধীনতার এত বছর পরে এসে জামায়াত এখন সত্যিকারের বিপদের মুখে৷ বড় নেতারা মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত হয়ে মৃত্যুদণ্ডের শিকার হয়েছেন, হচ্ছেন৷ অনেকে দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন৷ কারাগারে আছেন অনেকে৷ ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে আপস রফা করে আছেন কেউ কেউ৷ কিছু সংখ্যক নেতাকর্মী আবার আওয়ামী লীগে যোগও দিয়েছেন৷
প্রশ্ন উঠেছে জামায়াতের অস্তিত্ব নিয়ে৷ জামায়াত কি টিকে থাকবে না হারিয়ে যাবে? টিকে থাকার ক্ষেত্রে জামায়াতের একটি বড় শক্তি আর্থিক সামর্থ্য৷ আবার এই আর্থিক সামর্থ্যই তাদের টিকে থাকার অন্তরায়৷ মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার শুরু হওয়ার পর থেকেই জামায়াত দেশে-বিদেশে তাদের অর্থ খরচ করছে বিচার প্রক্রিয়ায় বাধা সৃষ্টির জন্য৷ ইউরোপকে ঘিরে লন্ডন থেকে তারা বিচারবিরোধী কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছে৷ সক্রিয় রয়েছে অ্যামেরিকাতেও৷ ডলার দিয়ে লবিস্ট নিয়োগ দিয়েছে, যা দৃশ্যমান৷
বাংলাদেশে জঙ্গি হামলার শিকার যারা
চলতি বছর ইসলামপন্থিরা একের পর এক হামলা চালিয়ে বাংলাদেশকে কাঁপিয়ে দিয়েছে৷ এতে প্রাণ হারিয়েছেন বেশ কয়েকজন৷ চলুন জানা যাক ২০১৫ সালের কবে, কারা হামলার শিকার হয়েছেন...৷
ছবি: Getty Images/AFP/Uz Zaman
বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ব্লগার খুন
একুশে বইমেলা থেকে ফেরার পথে ২৭ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে খুন হন ব্লগার এবং লেখক অভিজিৎ রায়৷ কমপক্ষে দুই দুর্বৃত্ত তাঁকে কুপিয়ে হত্যা করে৷ এসময় তাঁর স্ত্রী বন্যা আহমেদও গুরুতর আহত হন৷ বাংলাদেশি মার্কিন এই দুই নাগরিককে হত্যার দায় স্বীকার করেছে নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি গোষ্ঠী ‘আনসারুল্লাহ বাংলা টিম’৷ পুলিশ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত সন্দেহে একাধিক ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করেছে৷
ছবি: Getty Images/AFP/M. Uz Zaman
বাড়ির সামনে খুন
ব্লগার ওয়াশিকুর রহমান বাবুকে হত্যা করা হয় ঢাকায়, গত ৩০ মার্চ৷ তিন দুর্বৃত্ত মাংস কাটার চাপাতি দিতে তাঁকে কোপায়৷ সেসেময় কয়েকজন হিজরে সন্দেহভাজন দুই খুনিকে ধরে ফেলে, তৃতীয়জন পালিয়ে যায়৷ আটকরা জানায়, তারা মাদ্রাসার ছাত্র ছিল এবং বাবুকে হত্যার নির্দেশ পেয়েছিল৷ কে বা কারা এই হত্যার নির্দেশ দিয়েছে জানা যায়নি৷ বাবু ফেসবুকে ধর্মীয় উগ্রপন্থিদের বিরুদ্ধে লিখতেন৷
ছবি: Munir Uz Zaman/AFP/Getty Images
সিলেটে আক্রান্ত মুক্তমনা ব্লগার
শুধু ঢাকায় নয়, ঢাকার বাইরে ব্লগার হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে৷ গত ১২ মে সিলেটে নিজের বাসার কাছে খুন হন নাস্তিক অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট এবং ব্লগার অনন্ত বিজয় দাস৷ ভারত উপমহাদেশের আল-কায়েদা, যাদের সঙ্গে ‘আনসারুল্লাহ বাংলা টিম’-এর সম্পর্ক আছে ধারণা করা হয়, এই হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করেছে৷ দাস ডয়চে ভেলের দ্য বব্স জয়ী মুক্তমনা ব্লগের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন৷
ছবি: picture-alliance/EPA/Str
বাড়ির মধ্যে জবাই
ব্লগার নিলয় চট্টোপাধ্যায়কে, যিনি নিলয় নীল নামেই বেশি পরিচিত ছিলেন, হত্যা করা হয় ঢাকায় তাঁর বাড়ির মধ্যে৷ একদল যুবক বাড়ি ভাড়ার আগ্রহ প্রকাশ করে ৮ আগস্ট তাঁর বাড়িতে প্রবেশ করে এবং তাঁকে কুপিয়ে হত্যা করে৷ নিজের উপর হামলা হতে পারে, এমন আশঙ্কায় পুলিশের সহায়তা চেয়েছিলেন নিলয়৷ কিন্তু পুলিশ তাঁকে সহায়তা করেনি৷ ‘আনসারুল্লাহ বাংলা টিম’ এই হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করেছে, তবে তার সত্যতা যাচাই করা যায়নি৷
ছবি: Getty Images/AFP/Uz Zaman
জগিংয়ের সময় গুলিতে খুন বিদেশি
গত ২৮ সেপ্টেম্বর রাতে জগিং করার সময় ঢাকার কূটনৈতিক এলাকায় খুন হন ইটালীয় এনজিও কর্মী সিজার তাবেলা৷ তাঁকে পেছন থেকে পরপর তিনবার গুলি করে দুর্বৃত্তরা৷ জঙ্গি গোষ্ঠী ইসলামিক স্টেট বা আইএস এই হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করেছে বলে দাবি করেছে জিহাদিদের অনলাইন কর্মকাণ্ডের দিকে নজর রাখা একটি সংস্থা৷ তবে বাংলাদেশে সরকার এই দাবি অস্বীকার করে বলেছে ‘এক বড় ভাইয়ের’ তাঁকে হত্যা করেছে দুর্বৃত্তরা৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/ A.M. Ahad)
রংপুরে নিহত এক জাপানি
গত ৩ অক্টোবর রংপুরে খুন হন জাপানি নাগরিক হোশি কুনিও৷ মুখোশধারী খুনিরা তাঁকে গুলি করার পর মোটরসাইকেলে করে পালিয়ে যায়৷ ইসলামিক স্টেট এই হত্যাকাণ্ডেরও দায় স্বীকার করেছে, তবে সরকার তা অস্বীকার করেছে৷ বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিশ্বাস করেন না যে তাঁর দেশে আন্তর্জাতিক জঙ্গি গোষ্ঠীটির উপস্থিতি রয়েছে৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo
হোসনি দালানে বিস্ফোরণ, নিহত ১
গত ২৪ অক্টোবর ঢাকার ঐতিহ্যবাহী হোসনি দালানে শিয়া মুসলমানদের আশুরার প্রস্তুতির সময় বিস্ফোরণে এক কিশোর নিহত এবং শতাধিক ব্যক্তি আহত হন৷ বাংলাদেশে এর আগে কখনো শিয়াদের উপর এরকম হামলায় হয়নি৷ এই হামলারও দায় স্বীকার করেছে ইসলামিক স্টেট, তবে সরকার সে দাবি নাকোচ করে দিয়ে হামলাকারীরা সম্ভবত নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি গোষ্ঠী জেএমবি-র সদস্য৷ সন্দেহভাজনদের একজন ইতোমধ্যে ক্রসফায়ারে মারা গেছে৷
ছবি: Getty Images/AFP/M. Zaman
ঢাকায় প্রকাশক খুন
গত ৩১ অক্টোবর ঢাকায় দু’টি স্থানে কাছাকাছি সময়ে দুর্বৃত্তরা হামলা চালায়৷ এতে খুন হন এক ‘সেক্যুলার’ প্রকাশক এবং গুরুতর আহত হন আরেক প্রকাশক ও দুই ব্লগার৷ নিহত প্রকাশক ফয়সাল আরেফিন দীপনের সঙ্গে ঢাকায় খুন হওয়া ব্লগার অভিজিৎ রায়ের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল৷ জঙ্গি গোষ্ঠী ‘আনসার-আল-ইসলাম’ হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করেছে৷
ছবি: Getty Images/AFP/M. Uz Zaman
প্রার্থনারত শিয়াদের গুলি, নিহত ১
গত ২৭ নভেম্বর বাংলাদেশের বগুড়ায় অবস্থিত একটি শিয়া মসজিদের ভেতরে ঢুকে প্রার্থনারতদের উপর গুলি চালায় কমপক্ষে পাঁচ দুর্বৃত্ত৷ এতে মসজিদের মুয়াজ্জিন নিহত হন এবং অপর তিন ব্যক্তি আহত হন৷ তথকথিত ইসলামিক স্টেট-এর সঙ্গে নিজেদের সম্পৃক্ততা দাবি করা স্থানীয় একটি গোষ্ঠী হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করেছে৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo
9 ছবি1 | 9
শুধু তাই নয়, দেশের ভেতরেও নানাভাবে অর্থ খরচ করছে৷ বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতারা বিশেষ করে ক্ষমতাসীন দলের নেতারা জামায়াত নিয়ন্ত্রিত ইসলামী ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছেন৷ নিয়েছেন ঠিক না, দেয়া হয়েছে নিজেরা বাঁচার জন্যে৷ কারণে, অকারণে প্রধানমন্ত্রীর হাতে অর্থ তুলে দিতে দেখা গেছে ইসলামী ব্যাংককে৷ কিন্তু এ সব আর্থিক কর্মকাণ্ডে খুব একটা উপকার হয়েছে বলে মনে হয় না৷ দেশের ভেতরে যারা অর্থ নিয়েছেন, কাজ করেননি৷ দেশের বাইরে অর্থ খরচ করে বিতর্ক তৈরি করা গেলেও ‘ফাঁসি' আটকানো যায়নি৷
৩.
জামায়াতের অর্থ-সম্পদের ওপর অনেকের নজর আছে৷ বর্তমান সরকার চায় না জামায়াত বর্তমান ধারায় আরও বিকশিত হোক৷ বিএনপির সঙ্গে জামায়াতকে জড়িয়ে রাজনৈতিক সুবিধা নিতে চায় ক্ষমতাসীনরা৷ তারা এটাও খুব ভালো করে জানে যে, জামায়াতের ভোট কোনো দিন আওয়ামী লীগ পাবে না৷
দেশের ৩ থেকে ৫ শতাংশ মানুষ জামায়াতকে সমর্থন করে৷ তবে সংখ্যায় কম হলেও তাদের একটি শক্তিশালী কর্মী-ক্যাডার বাহিনী আছে৷ সুযোগ পেলে তারা অরাজকতা করার ক্ষমতা রাখে৷ অর্থ এবং কর্মী-ক্যাডার বাহিনীর সম্মিলন যদি আবার ঘটে, তবে তা সরকারের জন্যে চিন্তার কারণ হতে পারে৷ সরকারের টার্গেট জামায়াতের আর্থিক সামর্থ্য দুর্বল করে দেয়া৷ কর্মী-ক্যাডারদের দমন-পীড়ন করে কোণঠাসা করে রাখা৷ এ পথে সরকার অনেকটা সফল হয়েছে৷
সরকার জামায়াতের সম্পদ, জামায়াতের হাত থেকে নিয়ে নিতে চায়৷ নেয়ার কর্মপরিকল্পনা বলতে এখন পর্যন্ত কিছু দৃশ্যমান নয়৷ প্রথম পর্যায়ে আওয়ামী লীগ নেতা ও মতাদর্শের অনুসারীরা ব্যাংকসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ঢুকতে পারে৷ একটা অরাজকতার সম্ভাবনা প্রবল৷ সুন্দরভাবে কাজটি সরকার করতে পারবে বলে মনে হয় না৷ আর সাংগঠনিকভাবে জামায়াত পুরোপুরি নির্মুল হয়ে যাক সরকার এটাও চায় না৷ নিষিদ্ধ যদি করাও হয়, সরকার চাইবে জামায়াত অন্য নামে রাজনীতিতে ফিরে আসুক৷
সরকারের মাথাব্যথা জামায়াতকে নিয়ে নয়৷ সরকারের যাবতীয় চিন্তা বিএনপিকে নিয়ে৷ সরকারের চাওয়া রাজনেতিক দল আওয়ামী লীগ থাকবে, নিয়ন্ত্রিত অর্থ-সম্পদহীন জামায়াত থাকবে, নিয়ন্ত্রিত জঙ্গি থাকবে, দুর্বল জাতীয় পার্টি থাকবে, বিএনপি থাকবে না৷ বিএনপিকে পুরোপুরি নির্মূল করতে চায় সরকার৷ সে অনুযায়ী সব কর্মপরিকল্পনা চলছে৷ সরকারের কর্মকৌশলের অংশ হিসেবেই জামায়াত টিকে থাকবে, হয়ত অন্য কোনো নামে৷ থাকবে না বর্তমানের শক্তি ও অর্থ-সম্পদ৷ বিএনপি না থাকলে জামায়াতকে নিয়ন্ত্রণ করা খুব সহজ৷ যদিও রাজনীতি কখনো এত পরিকল্পনা অনুযায়ী চলে না৷
গোলাম মোর্তোজার সঙ্গে আপনি কী একমত? লিখুন নীচের মন্তব্যের ঘরে৷