জামায়াত-শিবিরের রাজনীতি নিষিদ্ধের দাবিতে এবার মাঠে নামছে নাগরিক সমাজ৷ তারা আগামী বিশে এপ্রিল ঢাকায় এই দাবিতে জাতীয় সম্মেলন করবেন৷ অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল ডয়চে ভেলেকে জানান, জামায়াত-শিবিরের রাজনীতি নিষিদ্ধ করার এখনই সময়৷
বিজ্ঞাপন
‘রুখে দাঁড়াও বাংলাদেশ' এই নামে একটি সংগঠনের ব্যানারে ঐক্যবদ্ধ হয়েছেন নাগরিক সমাজে প্রতিনিধিরা৷ এখানে সব পেশা ও শ্রেণির মানুষের সমাবেশ ঘটানো হয়েছে৷ আগামী ২০শে এপ্রিল জামায়াত-শিবিরের রাজনীতি নিষিদ্ধের দাবিতে তারা সম্মেলন করবেন ঢাকার ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে৷ পর্যায়ক্রমে ঢাকার বাইরে বিভাগীয় শহরগুলোতেও সম্মেলন করা হবে৷
সাঈদীকে ফাঁসির রায়, জামায়াতের তাণ্ডব
একাত্তরে যুদ্ধাপরাধের একাধিক অভিযোগ প্রমাণ হওয়ায় বৃহস্পতিবার দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে ফাঁসির আদেশ দিয়েছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল৷ এই রায় ঘোষণার পর গোটা বাংলাদেশে তাণ্ডব চালিয়েছে জামায়াত-শিবির৷ এতে হতাহত অনেক৷
ছবি: AFP/Getty Images
ট্রাইব্যুনালের রায়
দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর বিরুদ্ধে ২০টি অভিযোগে গণহত্যা, হত্যা, ধর্ষণ, লুটতরাজসহ মানবতা বিরোধী অপরাধের কথা বলা হয়েছে৷ কয়েকটি অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ হওয়ায় ট্রাইব্যুনাল-১ এর প্রধান বিচারপতি এটিএম ফজলে কবীরের নেতৃত্বে ৩ সদস্যের আদালত মৃত্যুদণ্ডের রায় ঘোষণা করেন৷ অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম জানান, তার বিরুদ্ধে মানবতা বিরোধী ২০টি অভিযোগের ৮টি সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ হয়েছে৷
ছবি: AP
রায়ের পরই তাণ্ডব
সাঈদীকে মৃত্যুদণ্ডের রায় ঘোষণার পরপরই রাজধানী ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলায় সক্রিয় হয়ে ওঠে জামায়াত-শিবির৷ শুধু বৃহস্পতিবার বিভিন্ন স্থানে সংঘর্ষে প্রাণ হারিয়েছে কমপক্ষে ৩৫ ব্যক্তি৷ বার্তাসংস্থা এএফপি এবং আমাদের কন্টেন্ট পার্টনার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম নিশ্চিত করেছে এই তথ্য৷ তবে শুক্রবার মৃতের সংখ্যা আরো বেড়েছে৷
ছবি: Reuters
আক্রান্ত পুলিশ
বৃহস্পতিবার জামায়াতের তাণ্ডবে প্রাণ হারান চার পুলিশ সদস্য৷ এদের মধ্যে তিনজন নিহত হন গাইবান্ধা জেলায়৷ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোরডটকম জানিয়েছে, ‘পুলিশ ফাঁড়িতে পিটিয়ে মারা হয় তাদের’৷ অপর একজন প্রাণ হারান চট্টগ্রামের লোহাগড়ায় সংঘর্ষের সময়৷ বার্তাসংস্থা এএফপি জানিয়েছে, আহত এক পুলিশ সদস্য শুক্রবার প্রাণ হারান৷ সবমিলিয়ে সাঈদীর রায় ঘোষণার পর শুক্রবার দুপুর অবধি পুলিশ সদস্য নিহতের সংখ্যা ৫৷
ছবি: STR/AFP/Getty Images
‘অধিকাংশই জামায়াত-শিবির কর্মী’
জামায়াত দাবি করেছে, ‘‘পুলিশের গুলিতে তাদের ৫০ জন ‘নিরপরাধ’ সমর্থক নিহত হয়েছে৷ পুলিশ তাদেরকে ‘পাখির মতো গুলি করে’ হত্যা করেছে৷’’ তবে মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের প্রধান সুলতানা কামাল পুলিশের উপর সন্ত্রাসী হামলার জন্য জামায়াতকে দায়ী করেছেন৷
ছবি: AFP/Getty Images
প্রাণ হারাচ্ছে নিরীহ মানুষও
জামায়াতের তাণ্ডবে পুলিশ সদস্য প্রাণ হারিয়েছেন, নিহত হয়েছেন আওয়ামী লীগ সমর্থকও৷ তবে সাধারণ মানুষও মরছে এই তাণ্ডবে৷ ঢাকায় বৃহস্পতিবার প্রাণ হারান এক পথচারী, নোয়াখালি এবং বাঁশখালীতে নিহত হন হিন্দু সম্প্রদায়ের দুই ব্যক্তি৷ শুক্রবারও গাইবান্ধায় এক রিকশা চালক নিহত হয়েছেন ক্ষমতাসীন দলের এবং জামায়াতের সমর্থকদের মধ্যকার সংঘর্ষের মাঝে পড়ে৷ নিরীহ প্রাণহানির এরকম খবর আরো শোনা যাচ্ছে৷
ছবি: AFP/Getty Images
‘ফেসবুক বন্ধ’
সাঈদীর বিরুদ্ধে রায় ঘোষণার সময় বাংলাদেশ থেকে কম্পিউটার ব্যবহার করে স্বাভাবিক উপায়ে ফেসবুকে প্রবেশ করা যাচ্ছিল না৷ নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিটিআরসি’র ভাইস চেয়ারম্যান গিয়াসউদ্দিন আহমেদ জানান, ‘কারিগরি সমস্যার জন্য এমনটা হয়েছে’৷ তবে তথ্য প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ জাকারিয়া স্বপন বলেন, ‘বৃহস্পতিবার তারা (বিটিআরসি) কিছুক্ষণের জন্য ফেসবুক বন্ধ করে দিয়েছিল এবং পুনরায় আবারো চালু করেছে৷’
সতর্ক নিরাপত্তা বাহিনী
জামায়াত-শিবির তাণ্ডব আর নাশকতা রুখতে গোটা দেশে সতর্ক রয়েছে নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা৷ বৃহস্পতিবার রাতেই বিভিন্ন এলাকায় মোতায়েন করা হয়েছে বিজিবি৷
ছবি: Reuters
ভিন্ন চিত্র
তবে সাঈদীর ফাঁসির রায়ে সামগ্রিকভাবে সন্তুষ্ট সাধারণ মানুষ৷ বৃহস্পতিবার এই রায় ঘোষণার পর উল্লাসে ফেটে পড়েন শাহবাগে অবস্থানরতরা৷ বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় মিষ্টি বিতরণ করা হয়৷ ফেসবুকে প্রতিক্রিয়া জানান অগুনতি মানুষ৷
ছবি: Reuters
‘শহীদের আত্মা শান্তি পাবে’
সাঈদীর বিরুদ্ধে একটি মামলার বাদি ও প্রথম সাক্ষী মাহবুবুল আলম হাওলাদার৷ রায় ঘোষণার পরে ডয়চে ভেলেকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘সাঈদীর ফাঁসির আদেশ হওয়ায় দেশমাতৃকা কিছুটা পাপমুক্ত হয়েছে, যুদ্ধাপরাধীদের শাস্তির জন্য ৪২ বছরের অপেক্ষার অবসান হতে চলেছে৷’
ছবি: DW/Harun Ur Rashid
আরো রায় বাকি
এখন পর্যন্ত তিন যুদ্ধাপরাধীর বিরুদ্ধে রায় ঘোষণা করছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল৷ বাকি আছে আরো যুদ্ধাপরাধীর বিচার৷ মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের শক্তি অপেক্ষায় আছে সব যুদ্ধাপরাধীর বিচার দেখার৷ বর্তমান তরুণ প্রজন্মও তাই জেগে আছে প্রজন্ম চত্বরে৷
ছবি: AP
10 ছবি1 | 10
বৃহস্পতিবার এক সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, এছাড়াও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ত্বরান্বিত করা, সাম্প্রতিক সহিংসতা প্রতিহত ও আক্রান্তদের পাশে দাঁড়ানো, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় দেশকে এগিয়ে নেয়া, মুক্তচিন্তার পথ খোলা রাখা, বাংলাদেশকে তালেবানি রাষ্ট্র বানানোর পাঁয়তারা প্রতিহত এবং নারীর অধিকার সমুন্নত রাখা তাদের অন্যতম দাবি৷
সংবাদ সম্মেলনে দেশের বিশিষ্ট নাগরিকরা উপস্থিত ছিলেন৷ অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল ডয়চে ভেলেকে জানান, জামায়াত-শিবির সাংগঠনিকভাবে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাই শুধু করেনি তাঁরা গণহত্যা, ধর্ষণ ও লুটপাটের মত মানবতা বিরোধী অপরাধ করেছে৷ তাই শুধু যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নয়, সংগঠন হিসেবে জামায়াত-শিবিরের বিচার করতে হবে৷
আর সাম্প্রতিক সময়ে তারা যে সহিংসতা করেছে তা ক্ষমার অযোগ্য৷ তারা মানুষ খুন করেছে, পুলিশের ওপর হামলা চালিয়েছে, সংখ্যালঘুদের বাড়ি-ঘর পুড়িয়ে দিয়ে তাদের নির্যাতন করেছে৷ তাদের হামলার লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছে নারী, সংখ্যালঘু এবং পুলিশ৷ তাই এ ধরণের একটি সংগঠনকে কোনোভাবেই বাংলাদেশে রাজনীতি করতে দেয়া যায়না বলে তিনি মনে করেন৷
সংগঠকদের আরেকজন সুচিন্তা ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক মো. এ আরাফাত ডয়চে ভেলেকে জানান, জামায়াত-শিবির সন্ত্রাসী এবং জঙ্গি সংগঠন৷ তারা তাদের সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ডে তা প্রমাণ করেছে৷ তাই একাত্তরের অপরাধ বাদ দিলেও একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে জামায়াতের রাজনীতি চলতে পারেনা৷
আরাফাত আরও জানান, ঢাকার এই সম্মেলনে সারাদেশ থেকে নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা অংশ নেবেন৷ সম্মেলনে খ্যাতনামা শিক্ষাবিদ, গণমাধ্যম ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব এবং বুদ্ধিজীবীরা থাকবেন৷ সম্মেলনের পর তাদের সামাজিক আন্দোলন সারা দেশে ছড়িয়ে দেয়া হবে৷ তিনি বলেন, জামায়াত-শিবিরকে প্রতিহত করা সরকারের দায়িত্ব৷ কিন্তু নাগরিক হিসেবেও আমাদের দায়িত্ব আছে৷ তাই মানুষের মধ্যে গণসচেতনতা গড়ে তুলতে তারা কাজ করবেন৷