যুদ্ধাপরাধীর ফাঁসি কার্যকর করে থেমে থাকলে হবে না, সব যুদ্ধাপরাধীর ফাঁসি কার্যকর করতে হবে৷ নিষিদ্ধ করতেই হবে জামায়াতে ইসলামীকে৷ মহান স্বাধীনতার ৪৩ বছর পূর্তি ও জাতীয় দিবস উপলক্ষ্যে বুধবার সমস্বরে উচ্চারিত হয়েছে এ সব দাবি৷
বিজ্ঞাপন
জাতীয় স্মৃতিসৌধে ফুল দেয়ার পর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, ‘‘জামায়াত নিষিদ্ধের বিষয়টি রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত মাত্র৷ খুব শিগগিরই তা বাস্তবায়ন করা হবে৷ আর যখন হবে তখন আপনাদের জানানো হবে৷'' এর একদিন আগে মঙ্গলবার যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালে জামায়াত নিষিদ্ধের আবেদন করে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিয়েছে তদন্তকারী সংস্থা৷ এখন যে কোনো সময় তদন্ত প্রতিবেদনের উপর ভিত্তি করে বিচার শুরু হবে৷
জাতীয় স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আব্দুল মঈন খান সাংবাদিকদের বলেন, গণতন্ত্রের যে আদর্শ নিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছিল সে গণতন্ত্র এখন আর এ দেশে নেই৷ তবে সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টির (জাপা) চেয়ারম্যান এইচএম এরশাদ বলেছেন, ‘‘সবাই এগিয়ে যাচ্ছে, আমরাও এগিয়ে যাব৷'' আর বিরোধী দলীয় নেতা রওশন এরশাদ বললেন, ‘‘জামায়াতের ব্যাপারে দেশ ও জনগণের নেয়া সিদ্ধান্ত জাতীয় পার্টি (এ) মেনে নেবে৷ আমরা দেশবাসীর সঙ্গেই আছি৷''
স্মৃতিসৌধে আসা মুক্তিযোদ্ধা রহমত আলী নিজের অভিজ্ঞতা জানিয়ে ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘১৯৭১ সালে যে ভয়াবহ দৃশ্য দেখেছি, তা ভোলার নয়৷ অসুস্থ শরীর নিয়েও এসেছি শহীদদের স্মরণে৷ রাজাকারের বিচার চাই৷'' তবে তিনি মনে করেন, স্বাধীনতার ৪৩ বছরেও দেশে হানাহানি বন্ধ হয়নি৷ এখনো জীবনের নিরাপত্তা নেই৷ রাজনীতিবিদদের শুধু ফুল দিয়ে গেলেই চলবে না৷ দেশে হানাহানি বন্ধ করার প্রতিজ্ঞা করতে হবে৷
জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন বাতিল
বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংগঠন জামায়েত ইসলামীর নিবন্ধন বাতিল করেছেন হাইকোর্ট৷ জামায়াত এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিলের ঘোষণা দিয়েছে৷ এদিকে দাবি উঠেছে, জামায়াতের রাজনীতি নিষিদ্ধ করার৷ এই বিষয়ে আমাদের ছবিঘর৷
ছবি: Strdel/AFP/Getty Images
‘‘জামায়াত একটি সন্ত্রাসী দল’’
বাংলাদেশ সময় বৃহস্পতিবার (০১.০৮.১৩) বিকেলে জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন বাতিল করেছেন হাইকোর্ট৷ বিচারপতি এম মোয়াজ্জেম হোসেন, ইনায়েতুর রহিম এবং কাজী রেজা-উল-হকের সমন্বয়ে হাইকোর্টের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ তাদের রায়ে জামায়াতের নিবন্ধন অবৈধ ঘোষণা করেন৷ রায়ে বলা হয়, ‘‘জামায়াতের গঠনতন্ত্র শুধু সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিকই নয়, জামায়াত একটি সন্ত্রাসী দল৷’’
ছবি: Munir Uz Zaman/AFP/Getty Images
২০০৯ সালের রিটের রায়
রাজনৈতিক দল হিসেবে জামায়াতের নিবন্ধনের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে কয়েকটি সংগঠন ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা হাইকোর্টে রিট করেন ২০০৯ সালে৷ রিটে জামায়াতের গঠনতন্ত্র সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক বলে উল্লেখ করা হয়, জানান ব্যারিস্টার তানিয়া আমীর৷ সেই রিটের প্রেক্ষিতে বৃহস্পতিবার রায় ঘোষণা করলেন আদালত৷
ছবি: Reuters
জামায়াতের প্রতিক্রিয়া
আদালতের রায়ের পর জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এবং এই মামলার আইনজীবী ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক জানান, রায়ের বিরুদ্ধে তারা আপিল করবেন৷ সেজন্য ইতিমধ্যে রায়ের কার্যকারিতার স্থগিতাদেশ চেয়ে সুপ্রিম কোর্টে আবেদন করা হয়েছে৷
ছবি: Strdel/AFP/Getty Images
স্বাধীনতার বিরুদ্ধে অবস্থান
১৯৭১ সালে তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের বিরুদ্ধে নয় মাসের রক্তক্ষয়ী লড়াইয়ের পর চূড়ান্ত স্বাধীনতা অর্জন করে বাংলাদেশ৷ বার্তাসংস্থা রয়টার্স জানিয়েছে, ‘‘জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে ছিল৷ তবে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে সেদলের কিছু নেতার হত্যা, ধর্ষণ এবং নির্যাতনের মতো অপরাধের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ অস্বীকার করেছে জামায়াত৷’’
ছবি: AP
ট্রাইব্যুনালে বিচার
জামায়াত যুদ্ধাপরাধের দায় অস্বীকার করলেও ২০১০ সালে গঠিত ঢাকার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে একের পর এক জামায়াত নেতার বিরুদ্ধে একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ প্রমাণ হচ্ছে৷ এই ছবিঘর তৈরির দিন (০১.০৮.১৩) অবধি ছয়জনের বিরুদ্ধে রায় ঘোষণা করেছেন ট্রাইব্যুনাল৷ সর্বশেষ আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধ মামলায় ফাঁসির রায় দেয়া হয়েছে৷
ছবি: Reuters
ট্রাইব্যুনাল নিয়ে বিতর্ক
একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিশ্চিত করতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার ২০১০ সালে ঢাকায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল প্রতিষ্ঠা করে৷ তবে সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিরোধী দল বিএনপি মনে করে, সরকার বিরোধী দলকে দুর্বল করতে এই ট্রাইব্যুনাল প্রতিষ্ঠা করেছে৷ আন্তর্জাতিক পর্যায়েও এই ট্রাইব্যুনাল নিয়ে বিতর্ক রয়েছে৷
ছবি: AP
জামায়াতের রাজনীতি নিষিদ্ধের দাবি
এদিকে জামায়াতের নিবন্ধন বাতিলের রায়ের পর দলটির রাজনীতি নিষিদ্ধের দাবি আরো জোরালো হয়েছে৷ অধ্যাপক মুনতাসির মামুন জামায়াতকে নিষিদ্ধ করার দাবি জানালেও সরকার এতটা সাহসী হবে বলে আশা করেন না৷ মুনতাসির মামুনের কথায়, ‘‘জামায়াত একটি যুদ্ধাপরাধী দল৷ ট্রাইব্যুনালের একাধিক রায়ে তা বলাও হয়েছে৷ তাই যুদ্ধাপরাধী দল হিসেবেও জামায়াতকে নিষিদ্ধ করা সম্ভব৷’’
ছবি: picture-alliance/dpa
ব্লগারদের সতর্ক প্রতিক্রিয়া
বৃহস্পতিবার আদালত রায় ঘোষণার আগেই ফেসবুকে আরিফ জিবতেক লিখেছেন, ‘‘হাইকোর্টের রায়টা কিন্তু জামায়াত নিষিদ্ধ নিয়া মামলা না৷ মামলাটা হচ্ছে নির্বাচন কমিশনে জামায়াত আইনসিদ্ধভাবে নিবন্ধিত হয়েছে কিনা, সেটা নিয়ে বিবেচনা৷’’ এই ব্লগার লিখেছেন, ‘‘যুদ্ধাপরাধী সংগঠন হিসেবে জামায়াতের বিচার চাই, নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধন নিয়া আমার মাথাব্যথা নাই৷’’
ছবি: privat
এই দাবি নতুন নয়
পরিসংখ্যান বলছে, ১৯৪১ সালে জামায়াত প্রতিষ্ঠার পর মোট তিনবার দলটি নিষিদ্ধ হয়েছে৷ ১৯৫৯ এবং ১৯৬৪ সালে পাকিস্তানে এবং ১৯৭২ সালে স্বাধীন বাংলাদেশে৷ ১৯৭৯ সালের ২৫শে মে জিয়াউর রহমানের শাসনামলে স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো জামায়াত প্রকাশ্যে রাজনীতি করার সুযোগ পায়৷
আরেকজন মুক্তিযোদ্ধা আবুল কাশেম ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘এতদিন পর মনে হচ্ছে স্বাধীনতার চেতনা বাস্তবায়নে কাজ শুরু হয়েছে৷ লাখো কণ্ঠে গাওয়া হচ্ছে জাতীয় সংগীত, প্রায় ২৭ হাজার মানুষ একসঙ্গে মাথার উপর তুলে ধরছে জাতীয় পতাকা, একজন যুদ্ধাপরাধীর ফাঁসি কার্যকর হয়েছে, অন্যদেরও বিচার হচ্ছে – এগুলো চেতনা বাস্তবায়নেরই অংশ৷ তবে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়া আরো দ্রুত করতে হবে৷ আর জামায়াত নিষিদ্ধ করার কথা শুধু মুখে বললেই হবে না, বাস্তবে উদ্যোগও নিতে হবে৷'' আওয়ামী লীগ সরকারের ৫ বছরেরও বেশি সময়ে জামায়াত কেন নিষিদ্ধ হয়নি – এমন প্রশ্নও তোলেন এই মুক্তিযোদ্ধা৷
স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষ্যে শ্রদ্ধাবনত জাতি ফুলে ফুলে ভরে দেয় সাভারস্থ জাতীয় স্মৃতিসৌধ, ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি এবং টুঙ্গিপাড়ার বঙ্গবন্ধুর মাজারের বেদিমূল৷ লাল-সবুজ পতাকা হাতে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে শিশু থেকে বৃদ্ধ সকলের কণ্ঠেই ধ্বনিত হয়েছে একই স্লোগান – ‘সব যুদ্ধাপরাধীর ফাঁসি চাই, স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াত-শিবিরের রাজনীতি নিষিদ্ধ করতে হবে৷'
সত্যিই এক নতুন রূপে ও চেতনায় ৪৪তম স্বাধীনতা দিবস পালন করল দেশবাসী৷ বিশ্বরেকর্ড সৃষ্টির প্রচেষ্টার পাশাপাশি ৪৩ বছর ধরে যার জন্য অপেক্ষা করেছিল গোটা দেশ, সেই একাত্তরের ঘৃণ্য যুদ্ধাপরাধী কাদের মোল্লার ফাঁসির রায় গত ১২ই ডিসেম্বর কার্যকর হওয়ায় বাঙালির জীবনে এবার যেন নতুন করে এসেছিল স্বাধীনতা দিবস৷ সবার চোখে-মুখে ছিল স্বস্তির ছাপ, রক্তের ঋণ শোধ করার গর্ব, নিষ্ঠুরতার বিচার করতে পারার এক ধরনের তৃপ্তি৷ ‘রুখে দাঁড়াও পরাজিত শক্তির হুংকার, যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসি এবার' – এমন স্লোগান নিয়ে জাতীয় স্মৃতিসৌধে ছিল নতুন প্রজন্মের বাঁধভাঙ্গা স্রোত৷ সারাদেশেই নতুন প্রজন্মের অভূতপূর্ব জাগরণ নতুন মাত্রা যোগ করে৷
এদিকে স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষ্যে গণজাগরণ মঞ্চের রাজপথ সংলাপে অংশ নিয়ে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল বলেছেন, ‘‘বাংলাদেশের তরুণরা মিলে আন্দোলন করে রাষ্ট্রীয় আইন সংশোধন করতে সরকারকে বাধ্য করেছে৷ একজন যুদ্ধাপরাধীর রায় পরিবর্তন করিয়ে তাকে ফাঁসির দড়িতে ঝোলাতে বাধ্য করেছে৷ পৃথিবীর ইতিহাসে এমন দৃষ্টান্ত আর একটাও খুঁজে পাওয়া যাবে না৷ তরুণরাই আমাদের গ্লানিমুক্ত বাংলাদেশ উপহার দিয়েছে৷''
সংলাপের শুরুতে ‘যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, গণজাগরণ মঞ্চের ৬ দফা ও আমরা কোথায়' শীর্ষক প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন গণজাগরণ মঞ্চের মুখপাত্র ডা. ইমরান এইচ সরকার৷ প্রবন্ধে তিনি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কার্যক্রমের বিভিন্ন দিক তুলে ধরে এ প্রক্রিয়াকে আরো দ্রুত করার আহ্বান জানান৷ প্রয়োজনে তিনি ‘ট্রাইব্যুনাল সংখ্যা বাড়ানোর কথা বলেন৷