জুন মাসের মধ্যে বাংলাদেশ সরকার জাময়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধ করবে বলে জানান মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী এ কে এম মোজাম্মেল হক৷ তবে এ দল নিষিদ্ধ হবে কিনা, তা নির্ভর করছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের ওপর, সরকারের ওপর নয়৷
বিজ্ঞাপন
মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী এ কে এম মোজাম্মেল হক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এক অনুষ্ঠানে শুক্রবার বলেন, ‘‘ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলো নিষিদ্ধের কোনো পরিকল্পনা সরকারের নেই৷ তবে যুদ্ধাপরাধের দায়ে চলতি বছরের জুন মাসের মধ্যেই সরকার জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করার পরিকল্পনা করছে৷''
গত বছরের ১লা আগস্ট জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন অবৈধ ঘোষণা করে হাইকোর্ট৷ অর্থাৎ, এ আদেশের ছয় মাসেরও বেশি সময় পর দলটি নিষিদ্ধের বিষয়ে সরকারের এ পরিকল্পনার কথা বললেন মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী৷
তবে ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির নির্বাহী সভাপতি শাহরিয়ার কবির ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে জামায়াত নিষিদ্ধ হবে কিনা, তা মন্ত্রী বলতে পারেন না৷ এটা মানবতাবিরোধী আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বিষয়৷ তাদের রায়ের ওপরই আসলে নির্ভর করছে জামায়াত যুদ্ধাপরাধের দায়ে নিষিদ্ধ হবে কিনা – সেই প্রশ্ন৷ তবে এমনটা হলে তা কখন, কোনো মাসে হবে– তা আদালতই বলতে পারে৷'' তিনি বলেন, ‘‘মানবতাবিরোধী অপরাধের সঙ্গে জড়িত থাকার দায়ে ইতিমধ্যেই সংগঠন হিসেবে জামায়াতের বিচারের সিদ্ধান্ত হয়েছে ট্রাইব্যুনালে৷ আমরা যতদূর জানি, এর তদন্ত শেষ হয়েছে৷ তাই যে কোনো সময় ট্রাইব্যুনালে জামায়াতের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করবেন প্রসিকিউটররা৷ তারপর হবে বিচার৷ এখানে সরকারের কিছু করার নেই, পুরোটাই আদালতের এখতিয়ার৷''
জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন বাতিল
বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংগঠন জামায়েত ইসলামীর নিবন্ধন বাতিল করেছেন হাইকোর্ট৷ জামায়াত এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিলের ঘোষণা দিয়েছে৷ এদিকে দাবি উঠেছে, জামায়াতের রাজনীতি নিষিদ্ধ করার৷ এই বিষয়ে আমাদের ছবিঘর৷
ছবি: Strdel/AFP/Getty Images
‘‘জামায়াত একটি সন্ত্রাসী দল’’
বাংলাদেশ সময় বৃহস্পতিবার (০১.০৮.১৩) বিকেলে জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন বাতিল করেছেন হাইকোর্ট৷ বিচারপতি এম মোয়াজ্জেম হোসেন, ইনায়েতুর রহিম এবং কাজী রেজা-উল-হকের সমন্বয়ে হাইকোর্টের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ তাদের রায়ে জামায়াতের নিবন্ধন অবৈধ ঘোষণা করেন৷ রায়ে বলা হয়, ‘‘জামায়াতের গঠনতন্ত্র শুধু সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিকই নয়, জামায়াত একটি সন্ত্রাসী দল৷’’
ছবি: Munir Uz Zaman/AFP/Getty Images
২০০৯ সালের রিটের রায়
রাজনৈতিক দল হিসেবে জামায়াতের নিবন্ধনের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে কয়েকটি সংগঠন ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা হাইকোর্টে রিট করেন ২০০৯ সালে৷ রিটে জামায়াতের গঠনতন্ত্র সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক বলে উল্লেখ করা হয়, জানান ব্যারিস্টার তানিয়া আমীর৷ সেই রিটের প্রেক্ষিতে বৃহস্পতিবার রায় ঘোষণা করলেন আদালত৷
ছবি: Reuters
জামায়াতের প্রতিক্রিয়া
আদালতের রায়ের পর জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এবং এই মামলার আইনজীবী ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক জানান, রায়ের বিরুদ্ধে তারা আপিল করবেন৷ সেজন্য ইতিমধ্যে রায়ের কার্যকারিতার স্থগিতাদেশ চেয়ে সুপ্রিম কোর্টে আবেদন করা হয়েছে৷
ছবি: Strdel/AFP/Getty Images
স্বাধীনতার বিরুদ্ধে অবস্থান
১৯৭১ সালে তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের বিরুদ্ধে নয় মাসের রক্তক্ষয়ী লড়াইয়ের পর চূড়ান্ত স্বাধীনতা অর্জন করে বাংলাদেশ৷ বার্তাসংস্থা রয়টার্স জানিয়েছে, ‘‘জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে ছিল৷ তবে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে সেদলের কিছু নেতার হত্যা, ধর্ষণ এবং নির্যাতনের মতো অপরাধের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ অস্বীকার করেছে জামায়াত৷’’
ছবি: AP
ট্রাইব্যুনালে বিচার
জামায়াত যুদ্ধাপরাধের দায় অস্বীকার করলেও ২০১০ সালে গঠিত ঢাকার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে একের পর এক জামায়াত নেতার বিরুদ্ধে একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ প্রমাণ হচ্ছে৷ এই ছবিঘর তৈরির দিন (০১.০৮.১৩) অবধি ছয়জনের বিরুদ্ধে রায় ঘোষণা করেছেন ট্রাইব্যুনাল৷ সর্বশেষ আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধ মামলায় ফাঁসির রায় দেয়া হয়েছে৷
ছবি: Reuters
ট্রাইব্যুনাল নিয়ে বিতর্ক
একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিশ্চিত করতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার ২০১০ সালে ঢাকায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল প্রতিষ্ঠা করে৷ তবে সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিরোধী দল বিএনপি মনে করে, সরকার বিরোধী দলকে দুর্বল করতে এই ট্রাইব্যুনাল প্রতিষ্ঠা করেছে৷ আন্তর্জাতিক পর্যায়েও এই ট্রাইব্যুনাল নিয়ে বিতর্ক রয়েছে৷
ছবি: AP
জামায়াতের রাজনীতি নিষিদ্ধের দাবি
এদিকে জামায়াতের নিবন্ধন বাতিলের রায়ের পর দলটির রাজনীতি নিষিদ্ধের দাবি আরো জোরালো হয়েছে৷ অধ্যাপক মুনতাসির মামুন জামায়াতকে নিষিদ্ধ করার দাবি জানালেও সরকার এতটা সাহসী হবে বলে আশা করেন না৷ মুনতাসির মামুনের কথায়, ‘‘জামায়াত একটি যুদ্ধাপরাধী দল৷ ট্রাইব্যুনালের একাধিক রায়ে তা বলাও হয়েছে৷ তাই যুদ্ধাপরাধী দল হিসেবেও জামায়াতকে নিষিদ্ধ করা সম্ভব৷’’
ছবি: picture-alliance/dpa
ব্লগারদের সতর্ক প্রতিক্রিয়া
বৃহস্পতিবার আদালত রায় ঘোষণার আগেই ফেসবুকে আরিফ জিবতেক লিখেছেন, ‘‘হাইকোর্টের রায়টা কিন্তু জামায়াত নিষিদ্ধ নিয়া মামলা না৷ মামলাটা হচ্ছে নির্বাচন কমিশনে জামায়াত আইনসিদ্ধভাবে নিবন্ধিত হয়েছে কিনা, সেটা নিয়ে বিবেচনা৷’’ এই ব্লগার লিখেছেন, ‘‘যুদ্ধাপরাধী সংগঠন হিসেবে জামায়াতের বিচার চাই, নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধন নিয়া আমার মাথাব্যথা নাই৷’’
ছবি: privat
এই দাবি নতুন নয়
পরিসংখ্যান বলছে, ১৯৪১ সালে জামায়াত প্রতিষ্ঠার পর মোট তিনবার দলটি নিষিদ্ধ হয়েছে৷ ১৯৫৯ এবং ১৯৬৪ সালে পাকিস্তানে এবং ১৯৭২ সালে স্বাধীন বাংলাদেশে৷ ১৯৭৯ সালের ২৫শে মে জিয়াউর রহমানের শাসনামলে স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো জামায়াত প্রকাশ্যে রাজনীতি করার সুযোগ পায়৷
তবে শাহরিয়ার কবির বলেন, ‘‘সরকার চাইলে অবশ্য সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে জামায়াতকে নিষিদ্ধ করতে পারে৷ ট্রাইব্যুনালের একাধিক রায়ে জামায়াতকে সন্ত্রাসী সংগঠন বলা হয়েছে৷ এছাড়া গত কয়েক বছরে জামায়াত সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবেই নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করেছে৷ সংবিধনের ৩৮ নং অনুচ্ছেদ, বিশেষ ক্ষমতা আইন এবং সন্ত্রাস দমন আইন – এর যে কোনোটি ব্যবহার করে সরকার জামায়াতকে নির্বাহী আদেশেই নিষিদ্ধ করতে পারে৷ তার জন্য জুন মাস পর্যন্ত বসে থাকার দরকার নেই৷'' এ জন্য সংসদে আলোচনারও কোনো প্রয়োজন নেই বলে তিনি মনে করেন৷
এদিকে ট্রাইব্যুনালের প্রসিকউটর রানা দাসগুপ্ত গত শনিবার ডয়চে ভেলেকে জানান, ‘‘ট্রাইব্যুনাল আইনে সংগঠনের বিচারের কথা বলা হলেও, সুনির্দিষ্টভাবে শাস্তি কী হবে তা বলা হয়নি৷ ব্যক্তি এবং সংগঠনের ব্যাপারে বলা হয়েছে যে, সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড ও আদালত যা যৌক্তিক মনে করে৷ তবে সংগঠনকে তো আর মৃত্যদণ্ড দেয়া যায় না৷ তাই অপরাধী প্রামাণিত হলে এবং আদালত ইচ্ছে করলে জামায়ত নিষিদ্ধ ও জামায়াতের সব ধরণের সম্পদ বাজেয়াপ্ত করতে পারে৷''