জামিন নামঞ্জুর, উচ্চ আদালতে যাবেন চিন্ময় দাসের আইনজীবীরা
২ জানুয়ারি ২০২৫বৃহস্পতিবার সাড়ে ১১টার দিকে চট্টগ্রাম মহানগর দায়রা জজ মো. সাইফুল ইসলাম উভয় পক্ষের শুনানি শেষে জামিনের আবেদন নামঞ্জুর করেন।
আদালতের আদেশের পর চিন্ময় দাসের ১১ জন আইনজীবী প্রতিনিধি দল বলেন, তারা ন্যায়বিচার বঞ্চিত হয়েছেন। হতাশা প্রকাশ করে তারা বলেন, ভিত্তিহীন মামলায় জামিন না হওয়া হতাশার। চট্টগ্রাম দায়েরা জজ আদালতের রায়ের কপি পেলেই উচ্চ আদালতে জামিনের আবেদন করবেন বলেও জানিয়েছেন তারা৷
চট্টগ্রাম মহানগর দায়রা জজ আদালতে শুনানিতে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী মফিজুল হক ভূইঁয়া যুক্তি তুলে ধরে বলেন, ‘‘রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা জামিন-অযোগ্য। এই মামলায় তার যাবজ্জীবন সাজা হতে পারে। ফলে তার জামিন পাওয়ার কোনো সুযোগ নেই।'' এরপর শুনানি শেষে আদালত চিন্ময় দাসের জামিন নামঞ্জুরের আদেশ দেন।
বৃহস্পতিবার চিন্ময় দাসকে আদালতে হাজির করা হয়নি। আদালতে আইনজীবীর উপস্থিতিতেআসামির ভার্চুয়াল হাজিরায় জামিন শুনানি হয়। আদালত প্রাঙ্গনে অতিরিক্ত আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য মোতায়েন করা হয়। আদালত কক্ষেও যাতে কোনো ধরনের অপ্রীতিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি না হয় সে ব্যাপারে নির্দেশনা দেন আদালত। আইনজীবী আদালতের কর্মকর্তা-কর্মচারী ছাড়া কাউকে আদালত ভবনে প্রবেশ করতে দেওয়া হয়নি।
ঢাকার ১১ আইনজীবী চট্টগ্রামে
চিন্ময় দাসের জামিন শুনানিতে অংশ নেন ঢাকা থেকে যাওয়া ১১ জন আইনজীবী। শুনানিতে অংশ নেন অ্যাডভোকেট অপূর্ব কুমার ভট্টাচার্য। তিনি সুপ্রিম কোর্টের পাশাপাশি চট্টগ্রাম বারেরও সদস্য। ফলে এদিন স্থানীয় কোনো আইনজীবীর ওকালতনামা লাগেনি। তবে চিন্ময় দাসের নিয়মিত আইনজীবী চট্টগ্রাম বারের কোনো সদস্য সেখানে উপস্থিত ছিলেন না।
অপূর্ব কুমার ভট্টাচার্য ডয়চে ভেলেকে বলেন, "চিন্ময় প্রভুর বিরুদ্ধে পতাকা অবমাননার অভিযোগে যে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা দায়ের করা হয়েছে, তা ভিত্তিহীন। প্রথমত, সমাবেশের ভিডিওতে ইস্কনের পতাকার নিচে যে পতাকাটি ওড়ানো হয়েছে, সেটি আসলে পাঁচটি চাঁদ-তারাখচিত পতাকা, অর্থাৎ, সেটা বাংলাদেশের পতাকা না। সেইসাথে পতাকা অবমাননার কোনো ধারা বাদী মামলার সাথে সংযুক্ত করেননি এবং যে পতাকাটি অবমাননার কথা বলা হয়েছে সেটাও জব্দ তালিকায় নাই। ফলে তার যুক্তি এর ফলে অভিযোগ যথাযথভাবে প্রমাণ হচ্ছে না।”
মামলাটি যথাযথ প্রক্রিয়ায় করা হয়নি দাবি করে অপূর্ব ভট্রাচার্য বলেন, "বাংলাদেশের ফৌজদারি কার্যবিধির ১৯৬ ধারা অনুযায়ী রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে মামলা নেওয়ার ক্ষেত্রে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আনুষ্ঠানিক অনুমোদন নেওয়ার কথা উল্লেখ থাকলেও, চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের ক্ষেত্রে তা মানা হয়নি। কোনো ব্যক্তি রাষ্ট্রের অনুমতি ছাড়া রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা করতে পারেন না। এ ধরনের মামলা আমলে নেওয়ারও কোনো এখতিয়ার নেই। সব মিলিয়ে মামলায় পদ্ধতিগত ত্রুটি রয়েছে। তার মানে, এই মামলা ভিত্তিহীন। এমন অবস্থায় চিন্ময়কৃষ্ণ জামিন পাওয়ার হকদার। তার নির্দিষ্ট ঠিকানা আছে, তাই জামিন পেলে তার পালিয়ে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। সেক্ষেত্রে আমরা নিয়মিতভাবে ট্রায়াল ফেইস করবো। তারপরও আদালত জামিন দেননি। ফলে আইনগত প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে আমরা তার জামিনের জন্য উচ্চ আদালতে যাবো।”
তবে বৃহস্পতিবার জামিনের বিরোধিতা করা পাবলিক প্রসিকিউটার অ্যাডভোকেট মফিজুল হক ভূইঁয়া ডয়চে ভেলেকে বলেন, "রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা জামিন অযোগ্য, ফলে চিন্ময় দাসের জামিন পাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। আসামিপক্ষ বলছে, তিনি এই অপরাধ করেননি, কিন্তু আমরা বলছি, তিনি অপরাধ করেছেন। তাহলে মামলাটি যেহেতু তদন্তাধীন, ফলে কোনো তথ্যই নিশ্চিত হওয়ার সুযোগ নেই। তদন্ত শেষেই বোঝা যাবে আসলে তিনি দোষী, না নির্দোষ। আমরা বলেছি, এটি একটি রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা, যার শাস্তি সর্বোচ্চ যাবজ্জীবন এবং মামলাটি যেহেতু তদন্তাধীন, এক্ষেত্রে আমরা জামিনের বিরোধিতা করেছি। আদালত আমাদের আর্জি শুনে জামিন নামঞ্জুর করেন।”
আদালত চত্ত্বরে ভয়ের বাতাবরণ, রাষ্ট্রপক্ষের অস্বীকার
ঢাকা থেকে চিন্ময় দাসের পক্ষে জামিন শুনানিতে অংশ নিতে যাওয়া ১১ জন আইনজীবীর একজন সুমন কুমার রায় ডয়চে ভেলেকে বলেন, "আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর অধিক সদস্যের উপস্থিতিতে এক ধরনের ভয়ের বাতাবরণ তৈরি করা হয়েছে, যাতে চিন্ময় দাসের পক্ষে কেউ উচ্চবাচ্য করার সাহস না পান। আসলে পরিস্থিতি এমন ছিল যে, আমরা তেমন কিছু বললে হয়রানির শিকার হতে পারতাম। এই ভয়ের কারণেই কিন্তু চট্টগ্রাম বারের কোনো আইনজীবী এদিন আমাদের সঙ্গে শুনানিতে অংশ নিতে পারেনি।”
তবে পাবলিক প্রসিকিউটার মফিজুল হক ভূইঁয়া ডয়চে ভেলেকে বলেন, "আপনি যদি জঙ্গলের মধ্য দিয়ে যান, তাহলে এক ধরনের ভীতিকর অবস্থা তো লাগবেই। ভাববেন, এই মনে হয় বাঘে ধরে ফেললো, আপনি আক্রান্ত হতে পারেন। কিন্তু আক্রান্ত তো হননি। কেউ তো আপনাকে কিছু বলেনি। ফলে আপনি ভয় পেতেই পারেন। আসলে তেমন কিছুই হয়নি। আমি নিজে এগুলো নিশ্চিত করার চেষ্টা করেছি। আদালতও নির্দেশনা দিয়েছেন।”
চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট নাজিম উদ্দিন চৌধুরী ডয়চে ভেলেকে বলেন, "কেউ যদি আজকে বলে তিনি ভয় পেয়েছেন, সেটা তার নিজের ব্যাপার। আমি নিজে সেখানে উপস্থিত থেকে এগুলো দেখভাল করেছি। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন। আদালতও এ ব্যাপারে দিকনির্দেশনা দিয়েছেন। কোনো ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা সেখানে ঘটেনি। আর কিছু ঘটনার সুযোগও ছিল না।”
৭০ আইনজীবীর অনেকে এখনো পলাতক
চিন্ময় কৃষ্ণ দাশ ব্রহ্মচারীর বিরুদ্ধে দায়ের করা রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলার প্রথম দিনের জামিন শুনানিতে অংশ নেওয়া প্রায় ৭০ জন হিন্দু আইনজীবীর বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে। সনাতনী জাগরণী জোটের অন্যতম সংগঠক স্বতন্ত্র গৌরাঙ্গ দাস ব্রহ্মচারী ডয়চে ভেলেকে বলেন, "গত ২৬ নভেম্বর চিন্ময়ের জামিন আবেদন নাকচ করে কারাগারে পাঠানোর পর আদালত চত্বরে প্রতিবাদকারীদের সঙ্গে পুলিশ ও কিছু লোকের সংঘর্ষ হয় । সংঘর্ষের মধ্যে আইনজীবী সাইফুল ইসলাম আলিফকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। ঘটনার চার দিন পর আলিফের ভাই খানে আলম চট্টগ্রামের কোতোয়ালী থানায় বিস্ফোরক আইনে একটি মামলা করেন। ভাংচুর, বিস্ফোরণ ও জনসাধারণের ওপর হামলার অভিযোগে যে মামলা করেছেন, তাতে ১১৬ জনকে আসামি করা হয়েছে। এর মধ্যে ৭০ জন হিন্দু আইনজীবী আছেন, যারা চিন্ময় দাসের পক্ষে শুনানিতে ছিলেন।” এছাড়া আলিফের বাবা জামাল উদ্দিন ৩১ জনকে আসামি করে একটি হত্যা মামলাও করেছেন।
মামলার বর্তমান অবস্থা এবং ওই আইনজীবীরা আদালতে যাচ্ছেন কিনা জানতে চাইলে অ্যাডভোকেট সুমন কুমার রায় ডয়চে ভেলেকে বলেন, "ওই মামলাটি এখনো তদন্তাধীন। ওই মামলায় এখনো কারো জামিন হয়নি। অর্থাৎ, আইনজীবীরা কেউ জামিন পাননি। কেউ কেউ বাড়িতে থাকলেও অধিকাংশই এখনো পলাতক। তবে চিন্ময় প্রভুর মামলাটি যেহেতু এখন উচ্চ আদালতে চলে গেল, ফলে চট্টগ্রাম বারের পক্ষ থেকে এ ব্যাপারে উদ্যোগ নেওয়া হবে বলে আমরা জানতে পেরেছি। এসব আইনজীবী যাতে নিরাপদে আদালতে গিয়ে তাদের কাজ করতে পারেন, সে ব্যাপারে বারের উদ্যোগের কথা আমরা শুনেছি।”
চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট নাজিম উদ্দিন চৌধুরী ডয়চে ভেলেকে বলেন, "ওই মামলার আসামীদের মধ্যে অনেক আইনজীবী আদালতে আসছেন। আজও (বৃহস্পতিবার) আমি কয়েকজনকে দেখেছি। তারা যেহেতু আমাদের বারের সদস্য, ফলে আমরা তাদের পক্ষে আছি। আদালতে তারা জামিনের আবেদন করলে বারের পক্ষ থেকে আমরা তাদের সহযোগিতা করবো। আশা করি তারা কেউ হয়রানির শিকার হবেন না।”
ধর্ম অবমাননার অভিযোগ তুলে নির্যাতন
গৌরাঙ্গ দাস ব্রহ্মচারীও বলেছেন,"পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে। আগের মতো আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী খুব একটা ‘ঝামেলা' করছে না। আমরা খুব শিগগিরই বসে পরবর্তী করণীয় ঠিক করবো।'' তবে তিনি আরো বলেন, ‘‘এখনো কিছু ঘটনা আমাদের আতঙ্কিত করছে। বুধবার রাত ১১টার দিকে নগরের পতেঙ্গা কাঠগড় এলাকার বাসা থেকে প্রান্ত তালুকদার নামে একজনকে তুলে নিয়ে নির্যাতন করা হয়েছে। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ দেওয়া হয়েছে, তিনি নাকি ধর্ম অবমাননা করেছেন। পরে তাকে আহত অবস্থায় উদ্ধার করেছে পুলিশ। বর্তমানে তিনি চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। তার অবস্থা আশঙ্কাজনক বলে আমরা জানতে পেরেছি।”
চট্টগ্রামের খুলশী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মজিবুর রহমান বলেন, "গোপন তথ্যের ভিত্তিতে আমরা জানতে পারি লালখান বাজার আমিন সেন্টারের পার্কিংয়ে কিছু লোক এক যুবককে ঘিরে রেখেছে। আমরা গিয়ে যুবককে উদ্ধার করে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করেছি। মারধর করার কারণে আহত হয়েছেন যুবকটি।” যুবককে মারধর করার কারণ জানতে চাইলে ওসি বলেন, "ফেসবুকে কটূক্তির কারণে। তবে আমরা ইতিমধ্যে বিষয়টির তদন্ত শুরু করেছি। এই ঘটনায় কারো সংশ্লিষ্টতা পেলে ব্যবস্থা নেবো।”
আইনজীবী সাইফুল ইসলাম আলিফ হত্যা, আসামি ১৪০০
গত ২৫ অক্টোবর চট্টগ্রামের লালদীঘি মাঠে জনসভার পর ৩০ অক্টোবর চট্টগ্রামের কোতোয়ালি থানায় ১৯ জনের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা করেন বিএনপি নেতা (পরে বহিস্কৃত) ফিরোজ খান। সেখানে চিন্ময় দাসকেও আসামি করা হয়। মামলা হওয়ার এক মাসের মাথায় ২৫ নভেম্বর বিকালে ঢাকার শাহজালাল আর্ন্তজাতিক বিমানবন্দর থেকে তাকে আটক করা হয়। কোতোয়ালি থানার ওই মামলায় চিন্ময় দাশকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়। এর প্রতিবাদে ঢাকা, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, খুলনাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় বিক্ষোভ হয়। চিন্ময় দাসকে সেদিন রাতেই ঢাকা থেকে চট্টগ্রামে নেওয়া হয়। পরদিন আদালতের মাধ্যমে পাঠানো হয় কারাগারে।
ওই আদেশের পর আদালত প্রাঙ্গণে প্রিজন ভ্যান ঘিরে বিক্ষোভ করে সনাতনী সম্প্রদায়ের লোকজন। আড়াই ঘণ্টা পর পুলিশ সাউন্ড গ্রেনেড ছুঁড়ে বিক্ষোভকারীদের ছত্রভঙ্গ করে চিন্ময় দাসকে কারাগারে নিয়ে যায়। ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার মধ্যে রঙ্গম কনভেনশন হল সড়কে আইনজীবী সাইফুল ইসলাম আলিফকে হত্যা করা হয়। আদালত এলাকায় সংঘর্ষ, ভাংচুর ও পুলিশের কাজে বাধাদানের ঘটনায় পুলিশ বাদী হয়ে তিনটি মামলা করেছে। ওই তিন মামলায় মোট ৭৬ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাতনামা আরো মোট ১৪০০ জনকে আসামি করা হয়েছে। এছাড়া আইনজীবী সাইফুল ইসলাম আলিফকে হত্যার ঘটনায় তার বাবা বাদী হয়ে ৩১ জনের নাম উল্লেখ করে হত্যা মামলা করেছেন। এতে অজ্ঞাতনামা আরো ১৫/১৬ জনকে আসামি করা হয়েছে।
পাশাপাশি আলিফের ভাই খানে আলম বাদী হয়ে যানবাহন ভাংচুর ও জনসাধারণের ওপর হামলার ঘটনায় ১১৬ জনকে আসামি করে আরেকটি মামলা করেছেন নগরীর কোতোয়ালি থানায়। এসব মামলায় এখন পর্যন্ত ৩৯ জনকে গ্রেপ্তারের কথা জানিয়েছে পুলিশ। তাদের কয়েকজন আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন বলে দাবি করেছে পুলিশ।