প্রতি তিনজন জার্মান নাগরিকের মধ্যে দু'জনই মনে করছেন, নেতা হিসেবে আঙ্গেলা ম্যার্কেল তাঁর সেরা দিনগুলো পার করে এসেছেন৷ তবে এখনও তাঁকে ‘একজন ভালো চ্যান্সেলর' বলে মনে করেন তাঁরা৷
বিজ্ঞাপন
সরকারি প্রচারমাধ্যম এআরডি ও দৈনিক পত্রিকা ‘ডি ভেল্ট'-এর এক জরিপে এ তথ্য বেরিয়ে এসেছে৷ বৃহস্পতিবার প্রকাশিত জরিপের ফলাফলে বলা হয়, ৬৭ শতাংশ জার্মান মনে করেন, এক সময় ম্যার্কেল যে মাপের ছিলেন, এখন তিনি আর সেরকম নেই৷ অবশ্য জার্মান ভোটাররা ম্যার্কেলের উপর থেকে পুরোপুরি বিশ্বাস হারাননি৷ তাই তো জরিপে অংশ নেয়া ৬৫ শতাংশ মানুষ এখনও মনে করেন, ম্যার্কেল ‘একজন ভালো চ্যান্সেলর'৷
জরিপে বড় একটি সমস্যার কথাও উঠে এসেছে৷ সেটি হচ্ছে, ম্যার্কেলের খ্রিষ্টীয় গণতন্ত্রী দল বা সিডিইউতে এখনও ম্যার্কেলের বিকল্প গড়ে ওঠেনি৷ তিন-চতুর্থাংশ জার্মান মনে করছেন, সিডিইউতে একজন ‘নতুন নেতা' দরকার৷
এখনও সরকার গঠিত হয়নি
গতবছরের ২৪ সেপ্টেম্বর জার্মানিতে সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়৷ কিন্তু এখনও সরকার গঠন সম্ভব হয়নি৷ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জার্মানিতে আর কোনো সময় সরকার গঠনে এতদিন অপেক্ষা করতে হয়নি৷ এ নিয়ে জরিপে অংশগ্রহণকারীরা তাঁদের হতাশা প্রকাশ করেছেন৷
নির্বাচনে ম্যার্কেলের দল সিডিইউ ও বাভারিয়া রাজ্যে তাঁদের সঙ্গী দল সিএসইউ ৩২ দশমিক ৯ শতাংশ ভোট পায়৷ ফলে সরকার গঠন করতে তাদের জোটসঙ্গীর প্রয়োজন৷ সেই লক্ষ্যে ব্যবসাবান্ধব দল এফডিপি এবং সবুজ দলের সঙ্গে আলোচনা শুরু করেছিল তারা৷ কিন্তু সেটি ফলপ্রসু না হওয়ায় আলোচনা ভেস্তে যায়৷ সমস্যার শুরু হয় সেখানেই৷ এরপর জার্মান প্রেসিডেন্ট ফ্রাংক ভাল্টার স্টাইনমায়ারের উদ্যোগে সিডিইউ-সিএসইউ ও নির্বাচনে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ভোট পাওয়া সামাজিক গণতন্ত্রী বা এসপিডি দলের মধ্যে একটি জোট গড়ার চেষ্টা শুরু হয়েছে৷ আগামী রবিবার এই দুই দলের মধ্যে প্রাথমিক পর্যায়ের আলোচনার প্রথম পর্ব অনুষ্ঠিত হবে৷ এটাকে বলা হচ্ছে ‘এক্সপ্লোরেটরি টক'৷ এই পর্যায়ের আলোচনার পর আগামী কয়েক সপ্তাহের মধ্যে দুই দলের মধ্যে জোট গঠনে আনুষ্ঠানিক আলোচনা শুরু হতে পারে বলে আশা করা হচ্ছে৷
আলোচনা সফল করার লক্ষ্যে দুই দলের শীর্ষনেতারা ইতিমধ্যে একটি সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন৷ সেটি হচ্ছে, দুই দলের আলোচকরা আলোচনার বিষয়ে গণমাধ্যমে কোনো কথা বলবেন না৷ জার্মান গণমাধ্যম ‘ডেয়ার স্পিগেল' এমন সিদ্ধান্তের তথ্য প্রকাশ করেছে৷
উল্লেখ্য, এফডিপি ও সবুজ দলের সঙ্গে সিডিইউ-র আলোচনা চলার সময় আলোচকদের মধ্যে কেউ কেউ আলোচনার বিষয়বস্তু নিয়ে গণমাধ্যমে কথা বলেছিলেন৷ এতে আলোচনায় অংশ নেয়া দলগুলোর মধ্যে অবিশ্বাসের জন্ম নিয়েছিল৷ আলোচনা সফল না হওয়ার জন্য এই বিষয়টিকেও অনেকাংশ দায়ী করা হয়৷
ফলে এবারের আলোচনার সময় যেন সেই অবস্থার পুনরাবৃত্তি না হয় সেজন্য এবার গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা না বলার সিদ্ধান্তে একমত হয়েছেন শীর্ষ নেতারা৷
যেভাবে প্রতিদ্বন্দ্বীদের পরাস্ত করেন ম্যার্কেল
এমনকি ২০১৭ সালের নির্বাচনের আগেও তাঁর পথে বাধা হয়ে দাঁড়ানো রাজনীতিবিদদের নিষ্ক্রিয় বা পাশে সরিয়ে দিয়েছেন জার্মান চ্যান্সেলর আঙ্গেলা ম্যার্কেল৷ নিজের দল বা বিরোধী দলের অনেক নেতাকেই নানাভাবে ঠেকিয়েছেন তিনি৷
ছবি: picture-alliance/dpa/ANP/R. De Waal
‘কোল গার্ল’ যখন গুরুকে ছাড়লেন
দীর্ঘদিন চ্যান্সেলর পদে থাকে হেলমুট কোল ম্যার্কেলকে মন্ত্রিসভায় প্রথম সুযোগ দিয়েছেন এবং তাঁর উত্থানে সহায়তা করেছিলেন৷ কিন্তু ১৯৯৮ সালে চ্যান্সেলর পদ হারানোর পর ম্যার্কেল এবং সিডিইউ তাঁর বিপক্ষে চলে যায়৷ কোল কিছু সূত্র থেকে নগদ অর্থ সাহায্য নিয়েছিলেন৷ কিন্তু সে সব সূত্রের বিস্তারিত তিনি জানাননি যা দলের জন্য ক্ষতিকর বলে মন্তব্য করেছিলেন সেসময় সিডিইউ’র সাধারণ সম্পাদক আঙ্গেলা ম্যার্কেল৷
ছবি: picture-alliance/dpa/A. Altwein
গেয়ারহার্ড শ্র্যোডার – রাজনৈতিক ক্যারিয়ারের সমাপ্তি
২০০৫ সালের নির্বাচনে এসপিডি’র চ্যান্সেলর শ্র্যোডারকে পরাস্ত করেন ম্যার্কেল৷ তবে এই পরাজয়ে শ্র্যোডারের নিজের দাম্ভিকতাও কিছুটা ভূমিকা রেখেছিল৷ সেই নির্বাচনে খুব অল্প ব্যবধানে সিডিইউ’র কাছে হেরে যায় এসপিডি৷ যদিও নির্বাচনের আগে টিভি বিতর্কে তিনি দাবি করেছিলেন, যে জার্মানরা চায় তিনি ক্ষমতায় থাকুন৷ কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি এবং তিনি রাজনীতি থেকে বিদায় নেন৷
ছবি: picture-alliance/dpa
ফ্রাঙ্ক-ভাল্টার স্টাইনমায়ার - দীর্ঘদিনের সঙ্গী
শুরুতে ম্যার্কেলের অধীনে চারবছর পররাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন ফ্রাঙ্ক-ভাল্টার স্টাইনমায়ার৷ এরপর ২০০৯ সালের জাতীয় নির্বাচনে তাঁকে চ্যালেঞ্জ করেন সামাজিক গণতন্ত্রীদের এই রাজনীতিবিদ৷ কিন্তু সেই নির্বাচনে সুবিধা করতে পারেনি স্টাইনমায়ারের দল৷ পরবর্তীতে ২০১৩ সালে আবারো ম্যার্কেলের অধীনে পররাষ্ট্রমন্ত্রী হন স্টাইনমায়ার৷ আর চলতি বছরের মার্চ মাস থেকে তিনি জার্মানির প্রেসিডেন্ট৷
ছবি: picture-alliance/dpa/S. Kembowski
গ্যুন্টার ও্যটিঙার - পথের কাঁটা দূর হলো
ম্যার্কেল যে শুধু তাঁর সম্ভাব্য প্রতিদ্বন্দ্বীদের রাজনীতি থেকে দূরে সরিয়ে দেন এমন নয়৷ বরং নিজের দলে থাকা সম্ভাব্য প্রতিদ্বন্দ্বীদের লোভনীয় অন্য কোন পদেও পাঠিয়ে দেন৷ তাঁর সহকর্মী বাডেন-ভ্যুর্টেমব্যার্গ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী গ্যুন্টার ও্যটিঙারকে ২০১০ সালে তিনি ইউরোপীয় কমিশনে বড় পদে পাঠিয়ে দেন৷ অথচ ও্যটিঙারের সেই পদ পাওয়ার মতো কোনো অভিজ্ঞতাই ছিল না৷
ছবি: picture-alliance/dpa/P. Seeger
রোনাল্ড কখ - বাতিলের তালিকায় ফেলে দেয়া
দুই কারণে রোনাল্ড কখ পরিচিত৷ প্রথমত, তিনি দলাই লামার বন্ধু৷ দ্বিতীয়ত, সরকারের দ্বৈত নাগরিকত্ব চালুর পরিকল্পনার বিরুদ্ধে কয়েক মিলিয়ন স্বাক্ষর সংগ্রহের জন্য৷ হেসে রাজ্যের এই রাজ্য প্রধান কখনো ম্যার্কেলের উত্থানে বাধা না হলেও হঠাৎ করেই মনে করেছিলেন তাঁকে বার্লিনে বড় পদের জন্য ডাকা হবে৷ কিন্তু ম্যার্কেলকে তাঁকে সেরকম কোন সুযোগ দেননি৷
ছবি: picture-alliance/dpa
ক্রিস্টিয়ান ভুল্ফ - একজন দুর্ভাগা রাষ্ট্রপতি
ক্রিস্টিয়ান ভুল্ফ প্রেসিডেন্ট হিসেবে ম্যার্কেলের প্রথম পছন্দ ছিলেন না৷ কিন্তু ২০১০ সালে হর্স্ট ক্যোলার পদত্যাগ করার পর সিডিইউ বর্তমান প্রতিরক্ষামন্ত্রী উরসুলা ফন ডেয়ার লাইয়েনের ব্যাপারে ঐকমত্যে পৌঁছাতে না পারায় ভুল্ফ সুযোগ পেয়ে যান৷ ভুল্ফ তখন লোয়ার স্যাক্সনি রাজ্যের রাজ্যপ্রধান৷ পরবর্তীতে অবশ্য দুর্নীতির দায়ে প্রেসিডেন্টের পদ ছাড়তে হয় তাঁকে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
পেয়ার স্টাইনব্রুক – সঠিক মানুষ, ভুল সময়
২০১৩ সালে ম্যার্কেল যখন তাঁর ক্যারিয়ারের তুঙ্গে, তখন এসপিডি থেকে তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে বেছে নেয়া হয় পেয়ার স্টাইনব্রুক’কে৷ ম্যার্কেলের অধীনে একসময় অর্থমন্ত্রী থাকা এই রাজনীতিবিদের চ্যান্সেলর পদ পাওয়ার সব যোগ্যতাই ছিল৷ কিন্তু সময়টা ঠিক ছিল না৷ ম্যার্কেলের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সুবিধা করতে পারেননি তিনি৷