জার্মানি যে পরমাণু শক্তির ব্যবহার বন্ধ করবে, ফুকুশিমা বিপর্যয়ের পাঁচ বছরের মধ্যেই এ দেশে তা নিয়ে আর কোনো বিতর্কের অবকাশ নেই৷ বহির্বিশ্ব একদিকে যেমন মুগ্ধ, অন্যদিকে চমৎকৃত – দেখছেন ডয়চে ভেলের ইয়েন্স টুরাও৷
বিজ্ঞাপন
জার্মানিতে আজ যখন টেলিভিশনে ‘এনার্গি-ভেন্ডে'' বা ‘জ্বালানি পরিবর্তন' নিয়ে আলোচনা চলে, তখন উইন্ড টার্বাইনের বিরুদ্ধে স্থানীয় বাসিন্দাদের প্রতিরোধ, কিংবা কয়লা পুড়িয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ফলে গ্রিনহাউস গ্যাস বৃদ্ধির কথা উল্লেখ করা হয়৷ মাঝেমধ্যে যে পরমাণু শক্তি অর্থাৎ আণবিক চুল্লিগুলির কথা ওঠে না, এমন নয়, তবে ঐ পর্যন্ত৷
জার্মানিতে এককালে প্রায় ২০টা আণবিক চুল্লি কাজ করছিল; আজ সেখানে কাজ করছে মাত্র আটটি৷ আগামী ছ'বছরের মধ্যে সেই আটটিও বন্ধ করে দেওয়া হবে৷ এ নিয়ে জার্মান সংসদেও আর বিতর্ক হয় না; সুশীল সমাজেও নয়৷ যে প্রশ্নটা নিয়ে আজকাল মাথা ঘামানো হয়, সেটি হলো: আণবিক চুল্লিগুলি খুলে ফেলে দিতে যে কোটি কোটি ইউরো খরচ হবে, সে টাকা কে দেবে৷ শুধু জ্বালানি শিল্পের কোম্পানিগুলো? নাকি শেষমেষ করদাতাদের তার দাম চুকোতে হবে?
ম্যার্কেলের সিদ্ধান্ত
পাঁচ বছর আগে পরিস্থিতি সম্পূর্ণ অন্যরকম ছিল৷ ফুকুশিমার পর চ্যান্সেলর আঙ্গেলা ম্যার্কেল ভোল পাল্টে হঠাৎ ঘোষণা করে বসেন যে, জার্মানি পরমাণু শক্তি থেকে বিদায় নিচ্ছে৷ অথচ এর কিছু আগেই তিনি আণবিক চুল্লিগুলি চালু রাখার মেয়াদ বাড়িয়েছিলেন৷ এমনকি তিনি এ বিষয়ে তাঁর নিজের খ্রিষ্টীয় গণতন্ত্রী দলের মতামতও জানতে চাননি৷ আজ যেমন তিনি উদ্বাস্তু নীতি নিয়েও দলের মতামত বিশেষ জানতে চাইছেন না৷
ফুকুশিমা যাবৎ জার্মানিতে জ্বালানি নীতির পরিবর্তন দ্রুততর হয়েছে; শেষমেষ দেশের বিদ্যুতের চাহিদার এক-তৃতীয়াংশ মেটাচ্ছিল নবায়নযোগ্য জ্বালানি৷ দেশ জুড়ে ইলেকট্রিক মাস্ট, অথবা মাটির তলায় কেবল্ বসিয়ে উত্তরের উইন্ড পার্কগুলো থেকে দক্ষিণে বাভারিয়া অবধি বিদ্যুৎ টানার ব্যবস্থা করা হচ্ছে৷ বায়ুশক্তি আর সৌরশক্তি থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনে সরকারি ভরতুকি থাকায় বিদ্যুতের দাম বেড়েছে – তবে ভুক্তভোগীরা তা মোটামুটি মেনে নিয়েছেন, যেমন পরমাণু শক্তি থেকে বিদায় নেবার ফলে বিদ্যুৎ সরবরাহে ঘাটতির দুঃস্বপ্নও আজ আর কেউ দেখছেন না৷ বলতে কি, বিদ্যুৎ সরবরাহের নিশ্চয়তায় বিশ্বের আর কোনো দেশ জার্মানির পাশে দাঁড়াতে পারবে না৷ তবুও তা নিয়ে দুশ্চিন্তা৷
ফুকুশিমা এখনো ধুঁকছে
ভূমিকম্প, সুনামি আর পারমাণবিক কেন্দ্র বিস্ফোরণের ক্ষতি সামলে ওঠার জন্য এখনো লড়ছে জাপান৷ পাঁচ বছর আগে ত্রিমুখী আক্রমণে বিপর্যয় নেমে এসেছিল৷ ফিরে দেখা যাক সেই দিনটি, দেখা যাক এখন কী অবস্থায় আছে ফুকুশিমা৷
ছবি: Reuters/T. Hanai
১৮ হাজারেরও বেশি মানুষের ঘাতক
২০১১ সালের ১১ই মার্চ ২টা ৪৬ মিনিটে যেন প্রলয় শুরু হয়েছিল জাপানের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে৷ প্রথমে প্রচণ্ড ভূমিকম্প৷ রিখটার স্কেলে ৯ মাত্রার সেই ভূমিকম্পের কারণে শুরু হলো সুনামি৷ তাতে মারাত্মক ক্ষতি হলো ফুকুশিমার পারমাণবিক কেন্দ্রটির৷ পারমাণবিক চুল্লি ছিদ্র হয়ে চারপাশে তেজস্ক্রিয়তা ছড়িয়ে পড়ল৷ সুনামিতে ধ্বংস হয় অনেক বাড়ি-ঘর৷ এক হিসেবে মোট ১৮ হাজার ৫শ’ মানুষ মারা যায় সেদিন৷ নিখোঁজ হয় ২ হাজার মানুষ৷
ছবি: Bertram Schiller
এখনো ভুগছে মানুষ
ফুকুশিমার বিপর্যয়ে যে শুধু ১৮ হাজার মানুষ মারা গেছে তা নয়, অসংখ্য মানুষকে এখনো ভোগ করতে হচ্ছে বিপর্যয়ের পরিণাম৷ দায়িচি পারমানবিক চুল্লির আশপাশের এলাকায় এখনো তেজস্ক্রিয়তা ছড়িয়ে আছে৷ অনেকেই এখনো নিজের ঘরে ফিরতে পারেননি৷
ছবি: Bertram Schiller
শূন্য স্কুল
দাইচির কাছের এই স্কুলটি এখনো খালি পড়ে আছে৷
ছবি: Getty Images/C.Furlong
এখনো চলতে হয় সাবধানে
এখনো তেজস্ক্রিয়তা ছড়িয়ে আছে৷ তাই সংবাদ সম্মেলনেও সাংবাদিককে বসতে হয় এই পোশাকে৷
ছবি: Getty Images/AFP/T.Hanai
প্রার্থনা
এখানেই একসময় ছিল নিজের বাড়ি৷ ছবির এই নারী ২০১১ সালের ১১ই মার্চ বাড়ি হারিয়েছেন, সঙ্গে হারিয়েছেন স্বজনদেরও৷ তাই ফুল দিয়ে হারিয়ে যাওয়া স্বজনদের জন্য প্রার্থনা করছেন তিনি৷
ছবি: picture-alliance/dpa/K.Kamoshida
স্বজনদের স্মরণ
প্রতিবছর এই দিনে ২০১১ সালের ১১ই মার্চের দুর্যোগে হারানো মানুষদের স্মরণ করে জাপান৷ চিরতরে হারিয়ে যাওয়া প্রিয়জনদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাচ্ছেন এক বৌদ্ধ ভিক্ষু৷
ছবি: TORU YAMANAKA/AFP/Getty Images
জাতীয় শোক
প্রতি বছর শোকের পরিবেশেই পাঁচ বছর আগের দিনটিকে স্মরণ করে জাপান৷ ১০ মার্চ জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে যখন সংবাদ সম্মেলনে কথা বলছিলেন তখন কালো ফিতা দেখা গেল জাতীয় পতাকায়৷ ফুকুশিমায় নিহতদের স্মরণ করতেই পতাকায় লাগানো হয় কালো ফিতা৷
ছবি: Reuters/T. Hanai
7 ছবি1 | 7
বলতে কি, দুশ্চিন্তাটাও একটা জার্মান বৈশিষ্ট্য, যেমন তারা সব কাজ খুঁটিয়ে, ভালোভাবে করতে চায় ও করতে পারে৷ এ দেশে যে সূর্যালোকের প্রাচুর্য্য আছে, একথা নিন্দুকেও বলবে না; অথচ এই দেশই সৌরশক্তিতে প্রায় অন্য সব দেশের চেয়ে বেশি বিনিয়োগ করে চলেছে৷ বহির্বিশ্বেও মানুষজন ধীরে ধীরে বুঝতে শুরু করেছে যে, জার্মানরা সত্যিই আণবিক শক্তি বর্জন করতে চলেছে৷ সেটা পাগলামি হতে পারতো – ‘জার্মানদের মাথা খারাপ' – যদি না জার্মানরা এতটা দক্ষতার সঙ্গে সে কাজটা করতো৷ কাজেই তার সঙ্গে যোগ হয়েছে: ‘যদি কেউ পারে, তবে ঐ জার্মানরা৷'
বন্ধুরা, আপনি কি লেখকের সঙ্গে একমত? জানান নীচের ঘরে৷
ফুকুশিমার ছায়া
দুইবছর আগে ফুকুশিমায় দুর্ঘটনার পর বিশ্বের বিভিন্ন দেশ পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র নিয়ে নতুন করে ভেবেছে৷ কারও উপর আবার কোনো প্রভাবই পড়েনি৷
ছবি: Reuters/Kyodo
একইসঙ্গে সুনামি, ভূমিকম্প ও পরমাণু দুর্ঘটনা
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জাপানে সবচেয়ে বড় দুর্ঘটনা হয় দুই বছর আগে৷ সাগরের নীচে ৯.৩ মাত্রার ভূমিকম্পের পর উত্তরপূর্ব উপকূলে সুনামি তৈরি হয়৷ এতে কমপক্ষে ১৫,৮৮০ জন মারা যায়৷ আর আহত হয় ৬,১৩৫ জন৷ তবে এখনো নিখোঁজ রয়েছেন ২,৬৯৪ জন৷
ছবি: dapd
পরমাণু দুর্ঘটনা
সুনামির কারণে ফুকুশিমা পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্রের শীতলীকরণ ব্যবস্থা নষ্ট হয়ে যায়৷ এতে তিনটি চুল্লি অতিরিক্ত উত্তপ্ত হয়ে ওঠে৷ আর তেজস্ক্রিয়তা ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে৷ ফলে সরকার ঐ বিদ্যুৎকেন্দ্রের আশেপাশের ৩০ কিলোমিটার এলাকায় বসবাসরতদের সরে যেতে বলে৷ এখনো তারা ঘরে ফিরতে পারেনি৷
ছবি: Reuters/Kyodo
চেরনোবিল
ফুকুশিমার আগে ইউক্রেনের চেরনোবিল দুর্ঘটনা ছিল ইতিহাসের সবচেয়ে মারাত্মক পরমাণু দুর্ঘটনা৷ ১৯৮৬ সালে ঐ কেন্দ্রের একটি চুল্লিতে তাপমাত্রা বেড়ে গিয়ে সে ধ্বংস হয়ে যায়৷ ফলে ইউরোপ ও রাশিয়ার বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে তেজস্ক্রিয়তা ছড়িয়ে পড়ে৷ ঐ দুর্ঘটনায় ৩০ জন নিহত হয়৷
ছবি: picture-alliance/dpa
তারপরও পরমাণু বিদ্যুৎ
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে চেরনোবিলের কথা সবাই ভুলে যায়৷ ফলে যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশও জ্বালানির চাহিদা মেটাতে জীবাশ্ম জ্বালানির বিকল্প হিসেবে পরমাণু বিদ্যুতের দিকে ঝুঁকে পড়ে৷ এমনকি ফুকুশিমা দুর্ঘটনার পরও যুক্তরাষ্ট্রে দুটি চুল্লি নির্মাণের অনুমোদন দেয়া হয়েছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
এমনকি জার্মানিও
জার্মানি এমনিতেই পরমাণু শক্তির চরম বিরোধী৷ তাই সাবেক চ্যান্সেলর গেয়ারহার্ড শ্র্যোডার ২০২২ সালের মধ্যে পরমাণু শক্তি উৎপাদন বন্ধ করার পরিকল্পনা করেছিলেন৷ বর্তমান সরকার সেটা বাড়িয়ে ২০৩৪ পর্যন্ত করতে চেয়েছিল৷
ছবি: picture-alliance/dpa
ফুকুশিমা বদলে দিল সব
ফুকুশিমায় দুর্ঘটনার পর জার্মানিতে পরমাণু শক্তির বিরুদ্ধে ব্যাপক জনমত গড়ে ওঠায় আঙ্গেলা ম্যার্কেলের সরকার তাদের সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসতে বাধ্য হয়৷ ফলে এখন আগের পরিকল্পনা অনুযায়ী ২০২২ সালের মধ্যেই সব পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ হয়ে যাবে৷ জার্মানি ২০৫০ সালের মধ্যে নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার ৮০ শতাংশ করার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে৷
ছবি: picture alliance/Hinrich Bäsemann
ইটালিতেও পরমাণু বিদ্যুৎ উৎপাদন বন্ধ
জার্মানির মতো ইটালিও পরমাণু শক্তির ঘোর বিরোধী৷ চেরনোবিল দুর্ঘটনার পর ১৯৮৭ সালে একটি গণভোটের মাধ্যমে ইটালীয়রা পরমাণু বিদ্যুৎ উৎপাদন বন্ধের পক্ষে ভোট দেয়৷ পরবর্তীতে সাবেক প্রধানমন্ত্রী সিলভিও বার্লুসকোনি সেটা আবারও শুরু করতে চাইলেও তা সম্ভব হয়নি৷
ছবি: picture-alliance/dpa
পরমাণু বিদ্যুতের পক্ষে ব্রিটেন
ব্রিটিশ সরকার পরমাণু বিদ্যুৎকে জ্বালানির একটা উৎস হিসেবে দেখছে৷ তাদের মতে ২০৩০ সালের মধ্যে কার্বন নির্গমন কমানোর লক্ষ্য পূরণে সহায়তা করবে পরমাণু বিদ্যুৎ৷
ছবি: AP
চারগুণ বাড়াতে চায় ভারত
২০২০ সালের মধ্যে পরমাণু বিদ্যুৎ উৎপাদন চারগুণ বাড়াতে চায় ভারত৷ সরকারের এই সিদ্ধান্ত ব্যাপক বিরোধিতার মুখে পড়েছে৷ রাশিয়ার সহায়তায় তৈরি হওয়া একটি বিদ্যুৎকেন্দ্রের কাজ বিক্ষোভের কারণে মাঝেমধ্যেই বন্ধ রাখতে হয়েছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
চীনের লক্ষ্যও একই
চীনও পরমাণু বিদ্যুতের উপর নির্ভরতা বাড়াচ্ছে৷ বর্তমানে দেশটির মোট চাহিদার মাত্র এক শতাংশ আসে পরমাণু বিদ্যুৎ থেকে৷ ২০২০ সালের মধ্যে এই হারটা চীন ছয় শতাংশে নিয়ে যেতে চায়৷
ছবি: picture-alliance/dpa
বাংলাদেশে প্রথম
পাবনার রূপপুরে বাংলাদেশের প্রথম পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপিত হতে যাচ্ছে৷ রাশিয়ার সহায়তায় তৈরি হতে যাওয়া এই কেন্দ্র থেকে এক হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিকল্পনা করা হচ্ছে৷