রাশিয়ার উপর নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও সে দেশের গাজপ্রম কোম্পানির গ্যাস পাইপলাইনের টার্বাইন মেরামতি করে প্রবল সমালোচনার মুখে পড়েছে ক্যানাডার সরকার৷ জার্মানির সরকার প্রধানমন্ত্রী ট্রুডোর পাশে দাঁড়িয়েছে৷
বিজ্ঞাপন
রাশিয়া থেকে গ্যাস সরবরাহ যতটা সম্ভব চালু রাখতে জার্মানি কতটা মরিয়া, রাজনৈতিক আঙিনায় জোরালো তৎপরতা তা স্পষ্ট করে দিচ্ছে৷ রাশিয়ার উপর নিষেধাজ্ঞার আওতায় গ্যাস না থাকলেও খোদ মস্কোই নানা ‘অজুহাত' দেখিয়ে জুন মাস থেকে সরবরাহ কমিয়ে চলেছে বলে জার্মানি অভিযোগ করছে৷ রাশিয়ার গাজপ্রম কোম্পানি জার্মানির ‘সিমেন্স এনার্জি' কোম্পানির বিরুদ্ধে বার বার টার্বাইনের মেরামতি সংক্রান্ত সব নথিপত্র হস্তান্তর না করার অভিযোগ করলেও জার্মান কোম্পানি তা অস্বীকার করেছে৷ সেই বাধা দ্রুত দূর করতে জার্মানির সরকার ব্যাপক উদ্যোগ নিয়েছে৷ নিষেধাজ্ঞার কারণে ক্যানাডায়‘নর্ড স্ট্রিম ১' পাইপলাইনের টার্বাইন মেরামতির কাজে সমস্যা দেখা দেওয়ায় চ্যান্সেলর ওলাফ শলৎসের সরকার অবিলম্বে হস্তক্ষেপ করেছে৷
ক্যানাডাও ব্যতিক্রম হিসেবে সেই টার্বাইন মেরামতি করেছে৷ তবে রাশিয়ার গাজপ্রম কোম্পানিকে পাইপলাইনের টার্বাইন সরবরাহ করতে রাজি হয়ে প্রবল সমালোচনার মুখে পড়েছেন ক্যানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো৷ সে দেশের সংসদের পররাষ্ট্র বিষয়ক কমিটি বিষয়টির তদন্ত করছে৷ ক্যানাডার পররাষ্ট্রমন্ত্রী মেলানি জোলির পাশাপাশি ক্যানাডায় নিযুক্ত জার্মান রাষ্ট্রদূত সাবিনে স্বারভাসারও কমিটির সামনে বক্তব্য রাখবেন৷ ইউক্রেনীয়দের এক আন্তর্জাতিক সংগঠন রাশিয়াকে টার্বাইন সরবরাহের অভিযোগে ক্যানাডার বিরুদ্ধে মামলার ঘোষণা করেছে৷
জার্মান চ্যান্সেলর শলৎস ক্যানাডার প্রধানমন্ত্রী ট্রুডোর প্রতি সমর্থন জানিয়ে বলেন, এমন অভিযোগ তার কাছে সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন৷ তার মতে, টার্বাইন সরবরাহে সম্মতির মাধ্যমে ক্যানাডার সরকার মোটেই গাজপ্রম কোম্পানির কোনো উপকার করে নি, বরং জার্মানি তথা ইউরোপের প্রতি জোরালো সমর্থনজানিয়েছে৷ ক্যানাডার ‘দ্য গ্লোব অ্যান্ড মেল' সংবাদপত্রের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে শলৎস আরও বলেন, এই টার্বাইন সরবরাহের মাধ্যমে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুটিনের ‘ভাঁওতা' ফাঁস হয়ে যাবে৷ প্রযুক্তিগত সমস্যার অজুহাত দেখিয়ে রাশিয়া আর গ্যাস সরবরাহ বন্ধ করতে পারবে না বলে তিনি মনে করেন৷
শলৎস বুধবার নিজে জার্মানির ম্যুলহাইম আন ডেয়ার রুয়র শহরে ক্যানাডা থেকে আনা টার্বাইনচি পরিদর্শন করছেন৷ ‘নর্ড স্ট্রিম ১' পাইপলাইনে বসানোর আগে টার্বাইনটি সেখানে এনে রাশিয়ায় পাঠানোর জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে৷ জার্মানির ‘সিমেন্স এনার্জি' কোম্পানি মঙ্গলবার এই খবর দিয়েছে৷
শলৎসের এই পদক্ষেপের পরেই জার্মান পররাষ্ট্রমন্ত্রী আনালেনা বেয়ারবক তার প্রথম ক্যানাডা সফরে যাচ্ছেন৷ তবে রাজধানী ওটাওয়ার বদলে তিনি ক্যানাডার পররাষ্ট্রমন্ত্রী জোলির শহর মনট্রিয়ালে পা রাখছেন৷ সেখানেই ‘নর্ড স্ট্রিম ১' পাইপলাইনের টার্বাইন রক্ষণাবেক্ষণের কাজ করা হয়েছে৷ তবে বেয়ারবক সেখানে ‘সিমেন্স এনার্জি' কারখানা পরিদর্শনের কোনো পরিকল্পনা করছেন না৷
রাশিয়ার জ্বালানির ওপর নির্ভরতা যেভাবে কমাবে ইউরোপ
২০২৭ সালের মধ্যে ইউরোপীয় ইউনিয়ন রাশিয়ার ওপর থেকে তাদের জ্বালানির নির্ভরতা শূন্যে নামিয়ে আনতে চাইছে৷ গত বুধবার এ সংক্রান্ত একটি পরিকল্পনা প্রকাশ করেছে ইউরোপীয় এই জোট৷
ছবি: Jean-Francois Badias/AP/picture alliance
রাশিয়ার ওপর নির্ভরতা
এখন পর্যন্ত রাশিয়া ইউরোপীয় ইউনিয়নের ৪০ ভাগ গ্যাস ও ২৭ ভাগ তেলের চাহিদা মেটাচ্ছে৷ ইউরোপজুড়ে এই জ্বালানি ঘর গরম রাখতে, বিদ্যুৎ উৎপাদনে এবং শিল্পে ব্যবহৃত হয়৷ এতটা নির্ভরশীলতা হুট করে কমানো সম্ভব নয়৷ তবে ইউক্রেনে রাশিয়ার আক্রমণ ইউরোপকে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করেছে৷ অবশ্য এই নির্ভরশীলতা কাটাতে অন্তত আরো পাঁচ বছর প্রয়োজন৷
ছবি: Kremlin Pool/ZUMAPRESS/picture alliance
নবায়নযোগ্যে ভরসা
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলায় জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে সরে নবায়নযোগ্য জ্বালানির ওপর নির্ভরতা বাড়ানোর পরিকল্পনা আগে থেকেই ছিল৷ কিন্তু ইউরোপীয় কমিশন সেই পরিকল্পনাকে আরো ত্বরান্বিত করতে চাইছে এখন৷ আগের প্রস্তাব অনুযায়ী, ২০৩০ সালের মধ্যে ৪০ শতাংশ নবায়নযোগ্যের পরিকল্পনাকে বাড়িয়ে ৪৫ শতাংশ করতে চাইছে তারা৷ ২০২০ সালের হিসেবে, তাদের ২২ শতাংশ জ্বালানি আসে বায়ু, সৌর ও জৈবশক্তি থেকে৷
ছবি: picture alliance / Zoonar
আইনে পরিবর্তন
লক্ষ্যে পৌঁছাতে ইউরোপীয় কমিশন আইনে পরিবর্তন আনার ঘোষণাও দিয়েছে৷ কড়া বিধিনিষেধের কারণে অনেক প্রকল্প পাস হতে সময় লাগে৷ সেগুলো কিছুটা শিথিলের উদ্যোগ নেয়া হবে৷ এছাড়া বড় বাণিজ্যিক ও আবাসিক ভবনগুলোর ওপর সৌর প্যানেল বসানো বাধ্যতামূলক করার নিয়মও করা হবে৷
ছবি: Philip Reynaers/BELGA/dpa/picture alliance
জ্বালানি সাশ্রয়
কমিশন ২০৩০ সালের মধ্যে ইউরোপীয় ইউনিয়নের জ্বালানি সাশ্রয়ও ১৩ ভাগ কমাতে চায়৷ আগের প্রস্তাবে তা ছিল ৯ শতাংশ৷ এর জন্য অনেক ভবনকে সংস্কার করা হবে, যেন সেগুলোতে কম জ্বালানি খরচ হয়৷ তাদের হিসেব বলছে, মানুষ চাইলে নিজ উদ্যোগে তাদের জ্বালানি খরচ কমাতে পারে৷ এতে করে অন্তত পাঁচ শতাংশ গ্যাসের চাহিদা কমানো সম্ভব৷
ছবি: David McNew/Getty Images
গ্যাসের নতুন অবকাঠামো
ইউরোপ রাশিয়া থেকে বছরে ১৫৫ বিলিয়ন ঘনমিটার গ্যাস আমদানি করে থাকে৷ নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহার ও জ্বালানি সাশ্রয় করে এর বিকল্প তৈরি সম্ভব৷ কিন্তু স্বল্পমেয়াদে ইউরোপ এখন সেই গ্যাসের বিকল্প উৎস খুঁজছে৷ সেক্ষেত্রে হাইড্রোজেন গ্যাস এর বিকল্প হতে পারে৷ কিন্তু এর অবকাঠামো নির্মাণ করতে হবে৷ কারণ যে-কোনো সময় রাশিয়া গ্যাস সরবরাহ বন্ধ করে দিলে বিপদ তৈরি হবে, যেমনটি তারা পোল্যান্ড ও বুলগেরিয়ার ক্ষেত্রে করেছে৷
ছবি: Joerg Boethling/imago images
অর্থায়ন
সবমিলিয়ে জ্বালানি খাতে ২০২৭ সালের মধ্যে ২১০ বিলিয়ন ইউরো বিনিয়োগ করতে চায় ইইউ৷ ২০৩০ সালের মধ্যে এটি ৩০০ বিলিয়ন হবে৷ এর মধ্যে নবায়নযোগ্য জ্বালানির জন্য ৮৬ বিলিয়ন, হাইড্রোজেন অবকাঠামোর জন্য ২৭ বিলিয়ন ইউরো, ২৯ বিলিয়ন ইউরো বিদ্যুৎ গ্রিড উন্নয়নে ও ৫৬ বিলিয়ন ইউরো জ্বালানি সাশ্রয় অবকাঠামো ও হিট পাম্প তৈরিতে খরচ হবে৷
ছবি: Christoph Hardt/Geisler-Fotopress/picture alliance