জার্মানিতে রয়েছে লাখো রকমের বিমা৷ সেগুলোর একটি হচ্ছে আইনি সহায়তা পাওয়ার বিমা৷ মানে আপনি অধিকারের জন্য লড়তে চাইলে পাবেন আইনজীবী এবং অন্যান্য সুবিধা৷
বিজ্ঞাপন
জার্মানিতে একটি ইন্সুরেন্স বেশ জনপ্রিয়৷ জার্মান ভাষায় সেটিকে বলা হয় ‘‘রেক্সটশ্যুৎসফেরৎজিসারুং'' যার বাংলা অর্থ দাঁড়ায় আইনি খরচ বিমা৷ আমার বিবেচনায় এই বিমা মূলত দু'টি কারণে করেন জার্মানরা: প্রথমত, আইনি সহায়তার প্রয়োজন হলে যাতে সেটা দ্রুত পাওয়া যায়৷ দ্বিতীয়ত, জার্মানিতে মামলা মোকাদ্দমার খরচ অনেক৷ বিমা থাকলে সেই খরচ তুলনামূলকভাবে কম হয়৷
জীর্ণ আদালতে দীর্ঘ বিচার
মামলার অনুপাতে বিচারক আর বিচারিক অবকাঠামোর সংকট বাংলাদেশের৷ এ কারণে বিচারে দীর্ঘসূত্রিতা চরম৷ আদালত অবকাঠামোর জীর্ণ-শীর্ণ পরিস্থিতি দেখে নিন ছবিঘরে৷
ছবি: DW/M. Mostafigur Rahman
বিচারের অপেক্ষা
আদালতের বারান্দায় মানুষের এমন দীর্ঘ সারিই প্রমাণ করে, কতোটা মামলাজট নিয়ে চলছে বাংলাদেশের বিচারিক কার্যক্রম৷ বর্তমানে সুপ্রিম কোর্টের দুই বিভাগে বিচারাধীন মামলা পাঁচ লাখ ৩৭ হাজার ৯৪টি৷ আর নিম্ন আদালতে বিচারাধীন মামলা ৩০ লাখ ৩২ হাজার ৬৫৬টি৷ গত বছর চার লাখ ৪৭ হাজার ৮৫৪টি মামলা দায়েরের বিপরীতে নিষ্পত্তি হয়েছে দুই লাখ ৮৪ হাজার ১৩১টি৷
ছবি: DW/M. Mostafigur Rahman
বিচারক সংকট
বিচারাধীন মামলার তুলনায় বিচারকের অপর্যাপ্ততার একটি চিত্র উঠে এসেছে সুপ্রিম কোর্টের জুডিশিয়াল রিফর্ম কমিটি ও জার্মান উন্নয়ন সংস্থা (জিআইজেড)-এর এক প্রতিবেদনে৷ তাতে দেখা যায়, বাংলাদেশে প্রতি দশ লাখ লোককে মাত্র ১০ জন বিচারক বিচারিক সেবা দিচ্ছেন৷ যুক্তরাষ্ট্রে এই সংখ্যা ১০৭, কানাডায় ৭৫, ব্রিটেনে ৫১, অস্ট্রেলিয়ায় ৪১, ভারতে ১৮ জন৷
ছবি: DW/M. Mostafigur Rahman
ফাইলের স্তুপ
মামলাজটের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকে নথিপত্রের স্তুপ৷ আর বছরের পর বছর চাপা পড়ে থাকে একেকটি ফাইল৷ আধুনিক ব্যবস্থা না থাকায় সেকেলে পদ্ধতিতে চলছে নথিপত্র সংরক্ষণ৷
ছবি: DW/M. Mostafigur Rahman
জামিনে কারসাজি
মামলাজটের মধ্যে আদালতে জামিন কারসাজির বহু ঘটনা ঘটে৷ আইনজীবীদের পাশাপাশি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা জড়িত এসবের সঙ্গে৷ ২০১৫ সালে বিচারকের জাল স্বাক্ষরে ভুয়া জামিননামা তৈরি করে শতাধিক দাগি আসামিকে আদালত থেকে ছাড়ানোর ঘটনা ঘটেছিল৷ তদন্তে নেমে দুদক জানতে পারে, এরসঙ্গে আদালতের পেশকার, উমেদার ও পিয়ন জড়িত ছিল৷
আদালতপাড়ায় অনেক সময় প্রতারণার ফাঁদ পাতে একদল প্রতারক৷ কখনো আইনজীবী, কখনো সাংবাদিক কিংবা মানবাধিকারকর্মীর ভুয়া পরিচয়ে বিচারপ্রার্থীদের কাছ থেকে অর্থ হাতিয়ে নেয় তারা৷ নিজেদের স্বার্থসিদ্ধি না হলে মামলার ফাঁদে ফেলাসহ বিভিন্ন হয়রানি করে তারা৷
ছবি: DW/M. Mostafigur Rahman
ঘিঞ্জি পরিবেশ
বেশিরভাগ আদালতে ঘিঞ্জি পরিবেশে কাজ করেন আইনজীবী এবং আদালতের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা৷ এমন আলোছায়ার কক্ষে কাজ চলে ঢাকার আদালতে৷
ছবি: DW/M. Mostafigur Rahman
বিচারের আগেই শাস্তি!
কারাগার কিংবা থানা থেকে এসব প্রিজন ভ্যানে আসামি আনা হয় আদালতে৷ সংকীর্ণ এসব প্রিজন ভ্যানে বেশির ভাগ সময়ে গাদাগাদির কারণে বিচার শেষ হওয়ার আগেই যেন শাস্তি পেয়ে যান আসামিরা৷
ছবি: DW/M. Mostafigur Rahman
অন্ধকারে রেকর্ড রুম
অন্ধকার ও ঘুপচি এই কক্ষই ঢাকা মহানগর ও দায়রা জর্জ আদালতের রেকর্ড রুম৷
ছবি: DW/M. Mostafigur Rahman
নোংরা শৌচাগার
আদালত বিশৃঙ্খল অবস্থাই শুধু নয়, সেখানে আসলে নানা রকম প্রতিবন্ধকতার শিকার হন বিচার প্রার্থীরা৷ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা অভাবে শৌচাগারে এমন বেহাল অবস্থার চিত্র ঢাকা আদালতের৷
ছবি: DW/M. Mostafigur Rahman
নথিপত্রের জায়গা সিঁড়ির তলা
নথিপত্র সংরক্ষণের আধুনিক ব্যবস্থা নেই আদালত কর্তৃপক্ষের৷ এর মধ্যে ভেতরে জায়গা নাই৷ জীর্ণ আদালত ভবনের সিঁড়ির নীচে জায়গা পেয়েছে এসব নথিপত্র৷
ছবি: DW/M. Mostafigur Rahman
11 ছবি1 | 11
বিমা থাকার কারণে কারো অধিকার ভঙ্গ হলে বা কেউ যদি কোন অন্যায়ের শিকার হন, তাহলে সহজেই তিনি আদালতের দ্বারস্থ হতে পারেন৷ এই সুযোগ আছে বলে সাধারণ মানুষ অনেকটাই আস্বস্ত থাকেন৷ ফলে অনেক ছোটখাট বিষয় নিয়েও আদালতের শরনাপন্ন হন অনেকে৷ এইতো কিছুদিন আগে এক ব্যক্তি নিজের বারান্দায় ধূমপান করেও বিপাকে পড়েন৷ তাঁর প্রতিবেশীর অভিযোগ সিগারেটের ধোঁয়ার কারণে তিনি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন৷ আদালত শেষমেষ যার বিরুদ্ধে অভিযোগ, তাঁকে ধূমপানের জন্য নির্দিষ্ট সময় বেঁধে দিয়েছেন৷ অর্থাৎ নিজের বারান্দাতেও তিনি চাইলেই যখন তখন ধূমপান করতে পারবেন না৷
এরকম উদ্ভট সব মামলার কথা জার্মানিতে হরহামেশাই শোনা যায়৷ এদেশের বিচার ব্যবস্থার আরেকটি উল্লেখযোগ্য দিক হচ্ছে শুধুমাত্র সন্দেহের বশে কাউকে গ্রেপ্তার বা জিজ্ঞাসাবাদের সুযোগ নেই৷ পুলিশের ক্ষমতা খুবই সীমিত৷ নেহাত যদি কাউকে গ্রেপ্তারের প্রয়োজন হয় তবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী শুধুমাত্র অকাট্য প্রমাণ পাওয়ার পর সেটা করতে পারে৷ তবে একটা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যেই সন্দেহভাজনকে আদালতে তুলতে হয়৷
আর সন্দেহভাজন কাউকে নিয়ে ‘মিডিয়া ট্রায়ালের' সুযোগও নেই৷ কেননা কারো বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণ না হওয়া পর্যন্ত গণমাধ্যমে তার পুরো নাম, ছবি বা তার ঠিকানা কিংবা পরিবারের পরিচয় প্রকাশের সুযোগ নেই৷ আমাদের দেশের বিচার ব্যবস্থার সঙ্গে জার্মানির এক বড় পার্থক্য এখানে৷ একজন ব্যক্তির গোপনীয়তা এদেশে আইন দিয়ে কঠোরভাবে সুরক্ষিত৷
জার্মানিতে মৃত্যুদণ্ড নেই৷ আর এদেশে শাস্তি প্রদানের ক্ষেত্রে অপরাধীকে শোধরানোর সুযোগ আছে কিনা সেটা বিশেষভাবে বিবেচনায় আনা হয়৷ লঘু অপরাধের ক্ষেত্রে শাস্তি হিসেবে সামাজিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণের সুযোগও দেয়া হয়৷
তবে, জার্মানির বিচার ব্যবস্থাতে বড় ভুলও হয়৷ জার্মান চ্যান্সেলর আঙ্গেলা ম্যার্কেল ২০১২ সালে একবার ভুল বিচারের ঘটনায় ক্ষমা চেয়েছিলেন৷ একদল নব্য নাৎসি কয়েকজন বিদেশি বংশোদ্তভূকে হত্যা করেছিল৷ কিন্তু, সেসব হত্যাকাণ্ডের বিচারকালে পারিবারিক বিষয়াদিকে প্রাধান্য দেয়া হয়েছিল৷ ফলে কয়েকবছর সময় লেগে যায় প্রকৃত ঘটনা বুঝতে৷ বিচার কাজে এই ভুলের দায় স্বীকার করে খোদ চ্যান্সেলর ক্ষমা চান৷
জার্মানি এবং বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থার তুলনা করতে গেলে একটি বিষয়ই বলতে হয়৷ এদেশে যেকোন পর্যায়েই জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা হয়৷ তাই, বিচারের কাজে ভুল করার সুযোগ যেমন অত্যন্ত কম, তেমনি ভুল হলে সেই ভুলের দায় নিতেও প্রস্তুত থাকতে হয়৷
প্রিয় পাঠক, আপনার কি কিছু বলার আছে? লিখুন নীচের মন্তব্যের ঘরে৷