প্রায় ৭০ বছর নিষিদ্ধ থাকার পর আবার জার্মানির বাজারে আসছে হিটলারের লেখা প্রচারণামূলক বই ‘মাইন কাম্ফ'৷ তবে নির্ভেজাল অবস্থায় নয়, সঙ্গে থাকছে প্রায় ৩,৫০০ মন্তব্য৷
বিজ্ঞাপন
He's back! Hilter's Tour of Germany
03:30
আডলফ হিটলার ও তার নাৎসি ভাবাদর্শের পরিণতি গোটা বিশ্বের ইতিহাসে তুলনাহীন৷ যুদ্ধবিগ্রহ ছাড়াই ঠান্ডা মাথায় সুপরিকল্পিতভাবে ৬০ লক্ষ মানুষের নিধনযজ্ঞের মতো ঘটনা এর আগে অথবা পরে ঘটেনি৷ ইহুদি জাতিকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে হিটলার ‘কনসেনট্রেশন ক্যাম্প' তৈরি করিয়েছিলেন, যেখানে প্রায় কারখানার মতো ‘দক্ষতার সঙ্গে' মানুষ মারার ব্যবস্থা ছিল৷
সেই হিটলারের আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ ‘মাইন কাম্ফ' বা ‘আমার সংগ্রাম' যে যুদ্ধোত্তর জার্মানিতে নিষিদ্ধ হবে, তাতে বিস্ময়ের কোনো কারণ থাকতে পারে না৷ এটি বিশ্বের সবচেয়ে বিপজ্জনক বইগুলির মধ্যে একটি হিসেবে পরিচিত৷ বাভেরিয়া রাজ্যের হাতে এই বইটির স্বত্ব ছিল৷ কিন্তু প্রায় ৭০ বছর পর আগামী ৩১শে ডিসেম্বর সেই স্বত্বের মেয়াদ শেষ হচ্ছে৷ তার পর যাতে বইটির বিভিন্ন সংস্করণ বাজারে ছড়িয়ে যেতে না পারে, জার্মানির সব রাজ্যের বিচারমন্ত্রীরা ২০১৪ সালের শুরুতেই তার প্রস্তুতি নিয়েছেন৷ জার্মানির ফেডারেল বিচারমন্ত্রীও এর প্রেক্ষাপট তুলে ধরেছেন৷
আগামী ৮ই জানুয়ারি মিউনিখ শহরের ঐতিহাসিকদের এক প্রতিষ্ঠান ‘মাইন কাম্ফ'-এর প্রায় ২,০০০ পৃষ্ঠার এক ‘ক্রিটিকাল এডিশন'৷ অর্থাৎ হিটলারের নিজস্ব লেখার পাশাপাশি থাকবে বিশেষজ্ঞদের মন্তব্য৷ উদ্দেশ্য, বইটিকে ঘিরে যে ‘মিথ' বা এক ধরনের সম্ভ্রম রয়েছে, তা দূর করে সঠিক প্রেক্ষাপটে হিটলারের বিকৃত মানসিকতা তুলে ধরা৷ আজকের জার্মানিতেও যারা নব্য নাৎসি ভাবধারার প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছে, তাদেরও এর মাধ্যমে সতর্ক করে দিতে চান মিউনিখের ঐতিহাসিকরা৷ জার্মানির শিক্ষক সংগঠনের সভাপতি ডয়চে ভেলের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে স্কুলেও বইটি পড়ানোর পরামর্শ দিয়েছেন৷
সেই প্রচেষ্টা কতটা সফল হবে, তা নিয়ে অবশ্য সংশয়ের শেষ নেই৷ বিশেষ করে কিছু ইহুদি সংগঠনের আশঙ্কা, এর ফলে হিতে বিপরীত হতে পারে৷ মানবতা ও গণতন্ত্রবিরোধী ব়্যাডিকাল শক্তি এই বই পড়ে উলটে বাড়তি উৎসাহ পেতে পারে৷ জার্মানির কেন্দ্রীয় ইহুদি সংগঠনের প্রধান অবশ্য এই উদ্যোগের পক্ষে সায় দিয়েছেন৷ ইসরায়েলেও বিষয়টি নিয়ে চর্চা চলছে৷
বাভেরিয়ার রাজ্য সরকারের পক্ষেও এই সিদ্ধান্ত সহজ ছিল না৷ ইন্টারনেটের যুগে সহজেই এই বইয়ের নাগাল পাওয়া যায়৷ স্বত্ব শেষ হবার পর বইটি প্রকাশিত হবার পথে বাধা সৃষ্টি করাও কঠিন৷ অন্যদিকে যে সরকার উগ্র দক্ষিণপন্থি এনপিডি দলকে নিষিদ্ধ ঘোষণার উদ্যোগ নিচ্ছে, তার পক্ষে সরকারি অর্থে হিটলারের বই প্রকাশ করার বিড়ম্বনাও কম নয়৷
হলোকস্টের স্মরণে জার্মানি যা করেছে, করছে
১৯৪৫ সালের ৮ মে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয় ইউরোপে৷ এরপর থেকে হলোকস্টের শিকার হয়েছিলেন যাঁরা, তাঁদের স্মরণে রাখতে এই গণহত্যার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন স্থাপনা সংরক্ষণ করে আসছে জার্মানি৷
ছবি: picture-alliance/dpa/Sven Hoppe
ডাখাউ
মিউনিখের কাছে ডাখাউ-এ প্রথম কনসেনট্রেশন ক্যাম্পটি স্থাপন করেছিল নাৎসিরা৷ আডল্ফ হিটলারের ক্ষমতা গ্রহণের কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই তাঁর গড়ে তোলা কুখ্যাত আধা-সামরিক বাহিনী বা এসএস-এর সদস্যরা রাজনৈতিক ভিন্নমতাবলম্বীদের সেই ইহুদি নিধন শিবিরে ধরে নিয়ে গিয়ে প্রথমে বন্দি করতো৷ তারপর অমানুষিক নির্যাতন চালিয়ে হত্যা করতো তাঁদের৷ পরবর্তীতে নাৎসিদের স্থাপন করা অন্যান্য ক্যাম্পগুলো ঐ ডাখাউ-এর আদলেই তৈরি করা হয়েছিল৷
ছবি: picture-alliance/dpa
নাৎসিদের ব়্যালি গ্রাউন্ড
ন্যুরেমব্যার্গে নাৎসি আমলের সবচেয়ে বড় প্রচারণা ব়্যালিটি অনুষ্ঠিত হতো৷ প্রায় ১১ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে থাকা একটি ‘গ্রাউন্ডে’ নাৎসিদের বার্ষিক কংগ্রেস এবং এই ব়্যালি অনুষ্ঠিত হতো, যাতে প্রায় দুই লক্ষ মানুষ অংশগ্রহণ করতেন৷ ছবিতে অসমাপ্ত কংগ্রেস হলটি দেখতে পাচ্ছেন৷ এটি বর্তমানে একটি জাদুঘর এবং ডকুমেন্টেশন সেন্টার৷
ছবি: picture-alliance/Daniel Karmann
হলোকস্টের মূল পরিকল্পনা
বার্লিনের ভানজে লেক এলাকার এই ‘ভানজে হাউস’-টিতে ইহুদি নিধনযজ্ঞের মূল পরিকল্পনা হয়েছিল৷ নাৎসি সরকার ও এসএস বাহিনীর মোট ১৫ জন সদস্য ১৯৪২ সালের ২০ জানুয়ারি এই ভবনে মিলিত হয়ে ‘ফাইনাল সলিউশন’ নামের পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিলেন৷ অর্থাৎ জার্মান নিয়ন্ত্রিত অঞ্চল থেকে সব ইহুদিদের তাড়ানো ও তাঁদের শেষ করার পরিকল্পনা নেওয়া হয় এখানেই৷ ১৯৯২ সাল থেকে ভবনটি একটি জাদুঘরে পরিণত হয়েছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
আনে ফ্রাঙ্কের স্মৃতি বিজড়িত
আনে ফ্রাঙ্ককে এখন অনেকেই চেনেন৷ তাঁর ডাইরিও পড়েছেন অনেকে৷ আনে ফ্রাঙ্ক সহ প্রায় ৫০ হাজার ইহুদিকে ব্যার্গেন-বেলজেনের এই কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে হত্যা করা হয়েছিল৷
ছবি: picture alliance/Klaus Nowottnick
হিটলারকে মারার ব্যর্থ পরিকল্পনা
জার্মানিতে হিটলারের নাৎসি অপশাসন প্রতিরোধে ১৯৪৪ সালের ২০ জুলাই সামরিক কর্মকর্তা কর্নেল ক্লাউস ফন স্টাউফেনব্যার্গ-এর নেতৃত্বে একটি দল হিটলারের ওপর বোমা হামলা চালায়৷ কিন্তু হত্যা পরিকল্পনাটি ব্যর্থ হলে, সেই রাতেই বার্লিনের এই ‘বেন্ডলারব্লক’ ভবনে স্টাউফেনব্যার্গ ও তাঁর সঙ্গীদের গুলি করে হত্যা করা হয়৷ এই ভবনটি এখন ‘জার্মান রেসিস্টেন্স মেমোরিয়াল সেন্টার’ হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
শারীরিক ও মানসিক প্রতিবন্ধী হত্যা স্মরণ
হেসে রাজ্যের হাডামারে একটি হাসপাতালের প্রায় ১৫ হাজার শারীরিক ও মানসিক প্রতিবন্ধীকে হত্যা করা হয়৷ এরকম ‘অক্ষমদের’ নাৎসি সরকার ‘অবাঞ্চিত’ ঘোষণা করেছিল৷ তাই তাঁদের দেহে ইনজেকশনের মাধ্যমে বিষাক্ত ওষুধ প্রবেশ করানোসহ বিভিন্ন উপায়ে হত্যা করা হয়৷ পুরো জার্মানিতে এভাবে প্রায় ৭০ হাজার প্রতিবন্ধীকে মেরে ফেলে নাৎসি বাহিনী৷ পরবর্তীতে নিহতদের স্মরণে হাডামারে একটি স্মৃতিস্তম্ভ গড়ে তোলা হয়েছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
বার্লিনে স্মৃতিস্তম্ভ
হলোকস্টের স্মরণে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষের ৬০ বছর পর, বার্লিনের ঐতিহাসিক ব্রান্ডেনবুর্গ তোরণের কাছে ‘মেমোরিয়াল টু দ্য মার্ডার্ড জিউস অফ ইউরোপ’ নামের এই স্মৃতিস্তম্ভটি স্থাপন করা হয়৷ নিহতদের স্মরণে সেখানে কংক্রিটের ২,৭১১টি স্ল্যাব বসানো হয়েছে৷ ইহুদি নিধনযজ্ঞের শিকার, এমন বহু মানুষের নামও লেখা আছে একটি জায়গায়৷
ছবি: picture-alliance/dpa
সমকামী হত্যা স্মরণ
বার্লিনের ঐ স্মৃতিস্তম্ভ থেকে সামান্য দূরে অবস্থিত ‘টিয়ারগার্টেন’ নামক একটি উদ্যানে স্থাপন করা হয়েছে চার মিটার উঁচু এই স্মৃতিফলক৷ ১৯৩৩ থেকে ১৯৪৫ সালের মধ্যে নাৎসিদের হাতে নিহত সমকামীদের স্মরণে এটি স্থাপন করা হয়৷ এই স্তম্ভের মধ্যে থাকা একটি পর্দায় চোখ রাখলে দুটি ছবি দেখা যায়৷ একটিতে চুমু খাচ্ছেন দু’জন পুরুষ, অন্যটিতে দুই নারী৷
ছবি: picture alliance/Markus C. Hurek
সিন্টি ও রোমা হত্যা স্মরণ
বার্লিনের সংসদ ভবনের ঠিক উল্টো দিকে ২০১২ সালে একটি পার্ক উদ্বোধন করা হয়৷ নাৎসি আমলে নিহত প্রায় পাঁচ লক্ষ সিন্টি ও রোমার স্মরণে এটি স্থাপন করা হয়েছিল৷
ছবি: picture-alliance/dpa
স্মতিস্মারক হিসেবে ‘শ্টলপারশ্টাইন’
নব্বইয়ের দশকে শিল্পী গুন্টার ডেমনিগ নাৎসি নির্যাতনের শিকাররা যে সব বাড়িতে বাস করতেন, সেগুলোর সামনে রাস্তার ওপর সোনালি পাতের ছবির মতো এই স্মৃতিস্মারক বসানো শুরু করেন৷ এতে যিনি নির্যাতিত হয়েছিলেন, তাঁর নাম, তাঁকে ধরে নিয়ে যাওয়া ও মেরে ফেলার তারিখ লেখা আছে৷ ইউরোপের ১৮টি দেশে এরকম ৪৫ হাজারেরও বেশি ‘শ্টলপারশ্টাইন’ রয়েছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
মিউনিখের ব্রাউন হাউস
নাৎসি আমল শেষের এত বছর পরও সে সময়ের স্মৃতি ধরে রাখতে তৎপর জার্মানি৷ তাই তো ৩০ এপ্রিল, ২০১৫-তে আরও একটি ডকুমেন্টেশন সেন্টার উদ্বোধন করতে যাচ্ছে জার্মানি৷ মিউনিখ শহরে হিটলারের অফিসের অদূরে যেখানে নাৎসিদের প্রধান কার্যালয় ছিল, সেই ব্রাউন হাউসে ‘ডকুমেন্টেশন সেন্টার ফর দ্য হিস্টরি অফ ন্যাশনাল সোশ্যালিজম’ নামের এই সেন্টারটির উদ্বোধন করা হবে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/Sven Hoppe
11 ছবি1 | 11
এসবি/ডিজি (ইপিডি, এপি)
বন্ধুরা, হিটলারের ‘মাইন কাম্ফ’ কি আপনি পড়েছেন? জানান নীচের ঘরে৷