বুধবার জার্মানির হালে শহরে সিনাগগের উপর হামলার ফলে ইহুদি-বিদ্বেষ ও প্রশাসনের তৎপরতা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে৷ সিনাগগের নিরাপত্তাপক্ষীদের তৎপরতায় আরও বড় হত্যালীলা প্রতিরোধ করা সম্ভব হয়েছে৷
বিজ্ঞাপন
ইহুদি ধর্মাবলম্বীদের জন্য বছরের সবচেয়ে পবিত্র দিনটিকে ঘিরে আশঙ্কা থেকেই যায়৷ কারণ ইয়ম কিপুর এমন এক দিন, যখন গোটা বিশ্বের প্রায় সব ইহুদি মানুষ দৈনন্দিন জীবনের ছন্দ ভুলে নিজেদের গুটিয়ে নিয়ে উপবাস, অন্তর্দৃষ্টি ও ভুলভ্রান্তির জন্য সবার কাছে ক্ষমা প্রার্থনায় মগ্ন থাকেন৷ মানুষ ও জাতি হিসেবে প্রতিরোধের ক্ষমতা তখন কিছুটা দুর্বল হয়ে পড়ে৷ ১৯৬৭ সালের এই দিনেই আরবরা ইসরায়েলের উপর হামলা চালিয়েছিল৷ ইসরায়েলের সেনাবাহিনীর সদস্যরা পারিবারের সঙ্গে নিভৃতে সময় কাটাচ্ছেন, এমনটা ধরে নিয়েই হিসেব করে সেই যুদ্ধ শুরু হয়েছিল৷
২০১৯ সালের ৯ই অক্টোবর জার্মানির হালে শহরেও আততায়ী সেই সুযোগ নিতে চেয়েছিল৷ সিনাগগ বা ইহুদি উপাসনালয়ের মধ্যে তখন প্রার্থনা চলছে৷ ৭০ থেকে ৮০ জন মানুষ সেখানে ছিলেন৷ অস্ত্রশস্ত্র সঙ্গে নিয়ে, হেলমেটে ক্যামেরা লাগিয়ে হত্যালীলা চালাতেই সেই ব্যক্তি পথে নেমেছিল বলে ধরে নেওয়া হচ্ছে৷ বন্ধ দরজার উপর বিস্ফোরক নিক্ষেপ করেও সফল হতে পারে নি আততায়ী৷ সিনাগগের নিজস্ব নিরাপত্তারক্ষীরা সেই হামলা প্রতিহত করতে সফল হন৷ তখন ইহুদিদের গালিগালাজ করতে করতে গুলি চালিয়ে দুই জন পথচারীকে হত্যা করে সে৷ গোটা ঘটনার দৃশ্য ইন্টারনেটে সরাসরি সম্প্রচারের ব্যবস্থা করেছিল আততায়ী৷ ঘটনার আগে ও পরে প্রায় ২,২০০ মানুষ সেই দৃশ্য দেখেছে৷ আততায়ী সিনাগগে প্রবেশ করতে পারলে কী ভয়াবহ ঘটনা ঘটতে পারতো, তা বলার অপেক্ষা রাখে না৷ হামলার পর পালানোর সময় গাড়ি নিয়ে ধাক্কা মারার পর আততায়ী পুলিশের হাতে ধরা পড়ে৷
এমন হামলাকে কেন্দ্র করে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে৷ জার্মানি তথা ইউরোপে বেড়ে চলা ইহুদি-বিদ্বেষের প্রেক্ষাপটে সিনাগগ বা সামগ্রিকভাবে ইহুদিদের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে৷ এমন এক পবিত্র দিনে হালে শহরের সিনাগগের সামনে পুলিশ কেন তৎপর ছিল না, সেই অভিযোগ উঠছে৷ জার্মানির কেন্দ্রীয় ইহুদি সংগঠনের প্রধান ইয়োসেফ শুস্টার প্রশাসনের ভূমিকার সমালোচনা করেছেন৷ স্যাক্সনি-আনহাল্ট রাজ্যের ইহুদিরা রাজ্য প্রশাসনের কাছে আরও সুরক্ষার আবেদন করা সত্ত্বেও বাস্তবে কোনো জোরালো পদক্ষেপ নেওয়া হয় নি বলে অভিযোগ উঠছে৷
জার্মান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হর্স্ট সেহোফার জানিয়েছেন, উগ্র দক্ষিণপন্থি ভাবধারায় উদ্বুদ্ধ হয়ে ইহুদি-বিদ্বেষের ভিত্তিতেই ২৭ বছর বয়সি জার্মান আতাতয়ী এই হামলা চালিয়েছে৷ পুলিশের ধারণা, সে একাই হামলার যড়যন্ত্র করেছিল৷ তবে ফেডারেল স্তরে তদন্তের পর গোটা ঘটনা জানা যাবে, এমনটা আশা করা হচ্ছে৷
জার্মান চ্যান্সেলর আঙ্গেলা ম্যার্কেল বুধবার সন্ধ্যায় বার্লিনে সিনাগগের কাছে এক সমাবেশে সংহতি দেখাতে উপস্থিত ছিলেন৷ হালে শহরে যারা হামলার শিকার হয়েছেন, তাদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে ব্রাসেলসে ইউরোপীয় পার্লামেন্ট এক মিনিট নীরবতা পালন করে৷ জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিয়ো গুতেরেস কড়া ভাষায় এই হামলার নিন্দা করেন৷ ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনইয়ামিন নেতানিয়াহু বলেন, হালে শহরের ঘটনা ইউরোপে ইহুদি-বিদ্বেষের আরেকটি দৃষ্টান্ত৷
জার্মানি-ইসরায়েল: একটি বিশেষ সম্পর্ক
নাৎসি আমলের ইহুদি নিধন যজ্ঞে প্রায় ৬০ লক্ষ মানুষের অপমৃত্যুর জের ধরে আত্মপ্রকাশ ঘটে ইসরায়েলের৷ তাই ঐতিহাসিক কারণে জার্মানি ও ইসরায়েলের মধ্যে সম্পর্কের চরিত্র একেবারে অনন্য৷ কিছু মানুষের জীবন জুড়েও রয়েছে এ দুটি ভূখণ্ড...
গল্পগুচ্ছ
জার্মান লেখক সারা স্ট্রিকার ইসরায়েলে প্রায় পাঁচ বছর কাটিয়েছেন৷ সেখানেই লিখেছেন নিজের প্রথম উপন্যাসটি৷ আর সম্প্রতি ইসরায়েলি এবং জার্মান লেখকদের কাজ নিয়ে তৈরি অভিনব একটি গল্পগুচ্ছে একটি ছোট গল্পও লিখেছেন তিনি৷
ছবি: Win Schumacher
মানুষ, প্রকৃতি, ভবিষ্যৎ
এত দীর্ঘ একটা সময় ইসরায়েলে থাকার কারণে সেখানকার মানুষ, এমনকি প্রকৃতিকেও ভালোবেসে ফেলেছেন সারা৷ তাঁর মতে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ফেডারেল জার্মান প্রজাতন্ত্রের সঙ্গে ইসরায়েলের সম্পর্ক অনেকটা স্বাভাবিক হয়ে এসেছে, বেড়ে চলেছে সহযোগিতা৷ তাই সারা ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আশাবাদী৷
ছবি: Win Schumacher
রন্ধনশিল্প
২০১৩ সালে জার্মানির টম ফ্রাঞ্জ ইসরায়েলের একটি বিখ্যাত রান্নার অনুষ্ঠান তথা প্রতিযোগিতা ‘মাস্টার শেফ’-এ প্রথম পুরস্কার পেয়েছিলেন৷ আর তখন থেকেই ইসরায়েলে তিনি একটি অতি পরিচিত নাম৷
ভালোবাসার টানে
ইসরায়েল আর সেখানকার মানুষদের সঙ্গে এতটাই মিলেমিশে গিয়েছিলেন টম যে, আট বছর আগে ইহুদি ধর্ম গ্রহণ করেন তিনি৷ হ্যাঁ, ঠিকই ধরেছেন৷ এ অঘটনটা ঘটেছিল ভালোবাসার টানেই৷ প্রেমে পড়ে গিয়েছিলেন তিনি৷ বর্তমানে টমকে জেরুসালেমের একটি ছোট্ট সিনাগগে প্রতিদিন স্ত্রীর সঙ্গে প্রার্থনা করতে দেখা যায়৷
রাঁধুনি পরিবার
স্ত্রীর পরিবারেই থাকেন টম৷ তাঁরাও যে রান্নায় এক-একজন ওস্তাদ৷ তাই তাঁদের সঙ্গে রান্নাঘরে দারুণ সময় কাটে টমের৷ কত কী যে শিখেছেন তিনি এখানে৷ আসলে জেরুসালেমের খাবার-দাবার নিয়ে একটি বই লিখতেই তিনি এসেছিলেন ইসরায়েলে৷
গায়িকা হওয়ার স্বপ্ন
নাম: রিলি উইলো৷ বয়স: ৩৪৷ স্বপ্ন: দাদির মতো মস্ত গায়িকা হওয়ার৷ রিলির দাদি একসময় বার্লিনের বিখ্যাত গায়িকা ছিলেন৷ তাই রিলি ইসরায়েল ছেড়ে আজ পরবাসী৷ বহুদিন হলো বার্লিনেই ঘর বেঁধেছেন তিনি, সানন্দেই৷ যদিও নাৎসিদের কুখ্যাত কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প আউশভিৎসে হত্যা করা হয়েছিল তাঁর প্রিয় দাদিকে৷
বার্লিনের আড্ডা
এটা ইসরায়েল নয়, জার্মানির ছবি৷ রাজধানীর ক্রয়েৎসব্যার্গ এলাকার একটা পাবে বসে বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে আড্ডা মারছেন রিলি উইলো আর তাঁর স্বামী বেনেডিক্ট বিন্ডেভাল্ড৷ বার্লিনের এ অঞ্চল এবং পার্শ্ববর্তী নয়ক্যোলন এলাকায় বহু তরুণ ইসরায়েলির বাস৷
হালকা হাসির পাল্লা
ইসরায়েল থেকে আসা রিলি উইলো আর বন্ধু শাহাগ শাপিরা একটা বিষয়ে একমত৷ আর সেটা হলো: ইহুদি বুদ্ধিমত্তা আর ইসরায়েলি ব্যঙ্গ আসলেই অতীতের কালো অধ্যায়টাকে হালকা করতে সাহায্য করেছে অনেকটাই৷
ছবি: Win Schumacher
সোজা প্রশ্ন
পেশায় সাংবাদিক শাপিরার বয়স মাত্র ২৭৷ কিন্তু আজকের জার্মান সমাজে ইহুদিদের কীভাবে দেখা হয়, সেটা জানতে তাঁর দারুণ আগ্রহ৷ তাই পথে-ঘাটে কারুর সাথে দেখা হলেই তিনি প্রশ্ন করে বসেন: আচ্ছা, আপনি কি ইহুদি বিদ্বেষী?
হাসতে তো মানা নেই!
বার্লিনের হলোকস্ট মেমোরিয়ালটি দেখতে যাঁরাই আসেন, তাঁরাই নিজের মোবাইল ফোনটা দিয়ে একটা ‘সেল্ফি’ তুলতে ভোলেন না৷ ‘‘এখানে সেল্ফি তোলা নিষেধ’’ – না, সত্যি সত্যি না৷ দর্শনার্থিদের সঙ্গে দুষ্টুমি করে শাপিরা প্রায়ই এমনটা বলেন৷ আর লোকজন সব ঘাবড়ে গেলে, হো হো করে হেসে ওঠেন তিনি৷