২০১৭ সালে জার্মানিতে উদ্বাস্তু আবাসনের উপর আক্রমণের সংখ্যা ২০১৬ সালের তুলনায় লক্ষণীয়ভাবে কমেছে৷ কিন্তু রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত আক্রমণের সংখ্যা আজও ২০১৪ সালের তুলনায় অনেক বেশি৷
বিজ্ঞাপন
২০১৫ সালে জার্মানি লক্ষ লক্ষ অভিবাসীদের জন্য তার সীমান্ত খুলে দেয়৷ তার পর পর এদেশে উদ্বাস্তু আবাসনের উপর হামলার ঘটনা চরমে পৌঁছায়৷ কিন্তু সে যাবৎ ঐ সংখ্যা কমতির দিকে৷
ডিসেম্বরের মাঝামাঝি অবধি এ বছর জার্মানিতে উদ্বাস্তু আবাসনের উপর ২৬৪টি আক্রমণের ঘটনা ঘটেছে, বলে ফেডারাল ক্রিমিন্যাল পুলিশ অফিস (বিকেএ) জানিয়েছে৷ এই পরিসংখ্যান গত শুক্রবারের ‘ফ্রাংকফুর্টার রুন্ডশাউ' পত্রিকায় প্রকাশিত হয়৷
বিকেএ-র রিপোর্ট অনুযায়ী তার মধ্যে ২৫১টি আক্রমণের জন্য দক্ষিণপন্থি চরমপন্থিরা দায়ী৷ বাকি ১৩টি ঘটনার জন্য পুলিশ এখনও কোনো রাজনৈতিক অভিসন্ধির সম্ভাবনা পুরোপুরি বাদ দিতে পারছে না৷
হামলার ঘটনাগুলির অধিকাংশ ছিল দেয়াল লিখন বা সম্পত্তির ক্ষতি৷ তবে অগ্নিসংযোগের ১৩টি ঘটনা ঘটেছে ও দু'টি ঘটনায় বিস্ফোরক ব্যবহার করা হয়েছে৷
জার্মানি থেকে আফগানিস্তানে বিতাড়ন
২০১৬ সালের মাঝমাঝি সময়ে রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদন বাতিল হওয়া ৩৪ আফগান শরণার্থীকে তাদের দেশে ফেরত পাঠানো হয়েছিল৷ সেটা শুরু৷ এরপর মাঝখানে কিছুদিন বিরতি দিয়ে আবারো বিমানে করে ফেরত পাঠানো হচ্ছে তাঁদের৷
ছবি: picture-alliance/dpa/M. Balk
বিমানে করে ফেরত পাঠানো
গত ১২ সেপ্টেম্বর ১৫ জন শরণার্থীকে ডুসেলডর্ফ বিমানবন্দর থেকে আফগানিস্তানের উদ্দেশ্যে যাত্রা করা বিমানে তুলে দেয়া হয়৷ প্রত্যেকের রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদন বাতিল হয়ে গেছে৷ গত মে মাসে কাবুলে জার্মান দূতাবাসের সামনে প্রাণঘাতি গাড়ি বোমা বিস্ফোরণের পর আফগান শরণার্থীদের ফেরত পাঠানো কিছু সময়ের জন্য বন্ধ ছিল৷ এখন আবার শুরু হয়েছে৷ জার্মানির সবুজ দল এবং বামদল এর সমালোচনা করেছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/B. Roessler
একটা সুযোগের আশায় লড়াই
গত মার্চে কটবুসের একদল শিক্ষার্থী গণমাধ্যমের শিরোনাম হয়৷ তিন আফগান সহপাঠীকে যাতে ফেরত পাঠানো না হয়, সেজন্য প্রচারণা চালিয়েছিল তারা৷ এজন্য তারা বিক্ষোভ করে, স্বাক্ষর সংগ্রহ করে৷ এমনকি আশ্রয়ের আবেদন বাতিল হওয়া সেই তিন আফগান শিক্ষার্থীর পক্ষে লড়তে একজন আইনজীবী নিয়োগের অর্থও সংগ্রহ করা হয়৷ যে তিন শিক্ষার্থীর জন্য এত আয়োজন, তাদের একজনকে দেখা যাচ্ছে ওপরের ছবিতে৷
ছবি: DW/S.Petersmann
‘কাবুল নিরাপদ নয়’
‘প্রাণঘাতি বিপদের দিকে যাত্রা’, গত ফেব্রুয়ারি মাসে মিউনিখ বিমানবন্দরে প্রতিবাদস্বরুপ দেখানো এক পোস্টারে একথা লেখা ছিল৷ যেসব বিমানবন্দর থেকে আশ্রয়প্রার্থীদের ফেরত পাঠানো হয়, সেসব বিমানবন্দরে মাঝেমাঝেই হাজির হন এমন প্রতিবাদকারীরা৷ গত ডিসেম্বর থেকে মে মাস অবধি অনেক আফগান শরণার্থীকে ফেরত পাঠানো হয়েছে৷ চলতি বছর এখন অবধি আফগানিস্তানে ফেরত পাঠানো হয়েছে ২৬১ জনকে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/M. Balk
ভ্যুর্ৎসবুর্গ থেকে কাবুল
মধ্য ত্রিরিশে পা দেয়া বাদাম হায়দারিকে সাত বছর জার্মানিতে কাটানোর পর গত জানুয়ারিতে দেশে ফেরত যেতে বাধ্য করা হয়৷ তিনি অতীতে ইউএসএইডে কাজ করেছেন এবং তালেবানের কাছ থেকে বাঁচতে জার্মানিতে এসেছিলেন৷ তালেবানের ভয় এখনো তাড়া করছে হায়দারিকে৷ তিনি আশা করছেন, শীঘ্রই হয়ত আবারো জার্মানিতে ফিরতে পারবেন৷
ছবি: picture-alliance/dpa/C.F. Röhrs
নিগৃহীত সংখ্যালঘু
গত জানুয়ারি মাসে আফগান হিন্দু সমীর নারাংকে কাবুলে ফেরত পাঠানো হয়৷ ফেরত পাঠানোর আগ অবধি তিনি জার্মানির হামবুর্গে পরিবরাসহ ছিলেন৷ জার্মান পাবলিক রেডিওকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘‘আফগানিস্তান নিরাপদ নয়৷’’ যেসব সংখ্যালঘু রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদন বাতিল হওয়ায় আফগানিস্তানে ফেরত যাচ্ছেন, তারা মুসলিমপ্রধান দেশটিতে সংখ্যালঘু হওয়ায় নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন৷
ছবি: picture-alliance/dpa/H. Wiedl
অনিচ্ছা সত্ত্বেও ফিরে যাওয়া
পকেটে মাত্র বিশ ইউরো নিয়ে জার্মানি থেকে আফগানিস্তানে ফেরত যান রাজনৈতিক আশ্রয় পেতে ব্যর্থরা৷ তাঁরা চাইলে আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংগঠন আইওএম’এর সহায়তা নিতে পারেন৷ তাছাড়া সে দেশে জার্মান অর্থায়নে তাদের মানসিক চিকিৎসারও ব্যবস্থা রয়েছে৷
ছবি: picture-alliance/dap/M. Jawad
6 ছবি1 | 6
তা সত্ত্বেও ২০১৭ সালের পরিসংখ্যান এর আগের দু'বছরের তুলনায় লক্ষণীয়ভাবে কম৷ ২০১৬ সালে কর্তৃপক্ষ উদ্বাস্তু আবাসনের উপর ৯৯৫টি রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত আক্রমণের ঘটনা নথিভুক্ত করেন, যার মধ্যে ১৬৯টি ঘটনায় সহিংসতার ভূমিকা ছিল৷
২০১৫ সালে উদ্বাস্তু আবাসনের উপর হামলার সংখ্যা ছিল ১,০৩১, যার প্রায় সব ক'টি ঘটনা ঘটে বছরের দ্বিতীয়ার্ধে, জার্মানি সংঘাত পীড়িত মধ্যপ্রাচ্য থেকে পলাতক উদ্বাস্তুদের জন্য তার সীমান্ত খুলে দেবার পর৷
হামলার সংখ্যা পর পর দু'বছর কমলেও, উদ্বাস্তু সংকটের আগের পরিস্থিতির তুলনায় তা আজও অনেক বেশি৷ ২০১৪ সালে জার্মানিতে উদ্বাস্তু আবাসনের উপর আক্রমণের সংখ্যা ছিল ১৯৯; তার আগের বছর, অর্থাৎ ২০১৩ সালে মাত্র ৬৯টি এই ধরণের ঘটনা ঘটে৷ এছাড়া উদ্বাস্তু সংকটের আগে অধিকাংশ ক্ষেত্রে হামলার কারণ ছিল অরাজনৈতিক৷
বহু উদ্বাস্তু আবাসন খালি পড়ে রয়েছে
দু'বছর আগে উদ্বাস্তু সংকট যখন চরমে, তখন জার্মান কর্তৃপক্ষ দ্রুত নিত্যনতুন উদ্বাস্তু আবাসন খোলার কাজে ব্যস্ত ছিলেন৷ আজ কিন্তু সেই সব আবাসনের অনেকগুলি খালি পড়ে রয়েছে, বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে৷ এর কারণ, জার্মানিতে উদ্বাস্তুদের আগমন কমেছে৷ ২০১৭ সালের প্রথম ছ'মাসে প্রায় ৯০,০০০ রাজনৈতিক আশ্রয়প্রার্থী জার্মানিতে আসেন; বাকি ছ'মাসেও তাদের সংখ্যা মোটামুটি একই থাকবে, বলে ধরে নেওয়া হচ্ছে – যা কিনা এর আগের বছরগুলির তুলনায় অনেক কম৷
মুশকিল এই, যে এর ফলে বহু উদ্বাস্তু আবাসন খালি পড়ে থাকছে – যেমন নর্থরাইন ওয়েস্টফেলিয়া রাজ্যের উদ্বাস্তু আবাসনগুলির এক-তৃতীয়াংশ খালি পড়ে রয়েছে, বলে ডাব্লিউডিআর টেলিভিশন সংস্থা জানিয়েছে৷ ওদিকে এই খালি উদ্বাস্তু আবাসনগুলির দেখাশোনার খরচ ক্রমাগত বেড়ে চলেছে৷ দ্বিতীয়ত, উদ্বাস্তুদের দেখাশোনার জন্য রাজ্যের নগর প্রশাসনগুলি উদ্বাস্তু প্রতি ১০,৪০০ ইউরো অনুদান পেয়ে থাকে৷ কম উদ্বাস্তু আসার অর্থ, এই বরাদ্দও কমবে৷ অপরদিকে যে সব উদ্বাস্তু জার্মানিতে অবস্থানের অধিকার পেয়েছেন, তাদের জন্য সুযোগ্য বাসস্থানের ব্যবস্থা করাটাও একটা সমস্যা হয়ে দাঁড়াচ্ছে৷
সব মিলিয়ে বলা যেতে পারে যে, উদ্বাস্তু আবাসনের উপর হামলা কমার পিছনে সবচেয়ে বড় কারণ সম্ভবত উদ্বাস্তুদের আগমনের সংখ্যা কমা৷ অপরদিকে উদ্বাস্তুদের স্থায়ী আবাসনের সমস্যাটা নতুন আকার ধারণ করেছে৷
এসি/ডিজি (ডিপিএ, এএফপি, ইপিডি)
উদ্বাস্তু পরিস্থিতি ও জার্মান রাজনীতি
জার্মানিতে বিপুল সংখ্যক শরণার্থীদের আগমন শুধু সরকারি ব্যবস্থাপনাকেই বিপদের মুখে ফেলেনি, অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতেও তার ছাপ ফেলেছে: চ্যান্সেলর আঙ্গেলা ম্যার্কেল-এর জনপ্রিয়তা আজ কমতির দিকে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/A. Gebert
উদ্বাস্তু শিবিরে দাঙ্গা
হামবুর্গ শহরের ভিলহেল্মসবুর্গ এলাকায় শরণার্থীদের প্রাথমিক আশ্রয়কেন্দ্রটি ভরে যাওয়ায় আগন্তুকদের তাঁবুতে থাকার ব্যবস্থা করা হয়৷ মঙ্গলবার (৬ই অক্টোবর) সেখানে আফগানিস্তান ও আলবেনিয়া থেকে আগত উদ্বাস্তুদের মধ্যে ব্যাপক দাঙ্গা বাঁধে৷ লোয়ার স্যাক্সনি-র ব্রাউনশোয়াইগ-এও অনুরূপভাবে আলজিরীয় ও সিরীয় উদ্বাস্তুদের মধ্যে দাঙ্গা বাঁধে একটি চুরির অভিযোগকে কেন্দ্র করে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/C. Charisius
ইসলাম বিরোধীরা আবার মাথা চাড়া দিয়েছে
ড্রেসডেনে ইসলাম বিরোধী পেগিডা গোষ্ঠীর বিক্ষোভ সমাবেশে গত সোমবার প্রায় ন’হাজার মানুষ অংশগ্রহণ করেন৷ বিক্ষোভকারীরা মূলত চ্যান্সেলর আঙ্গেলা ম্যার্কেল-কেই বর্তমান উদ্বাস্তু সংকটের জন্য দায়ী করছেন৷
ছবি: picture-alliance/dpa/B. Settnik
ম্যার্কেল লাগাম টানলেন
চ্যান্সেলর আঙ্গেলা ম্যার্কেল দৃশ্যত তাঁর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী টোমাস ডেমেজিয়ের-এর গুরুত্ব কিছুটা খর্ব করে চ্যান্সেলরের দপ্তরের প্রধান পেটার আল্টমায়ার-কে শরণার্থী সংক্রান্ত কর্মকাণ্ড সমন্বয়ের দায়িত্ব দিয়েছেন৷
ছবি: Reuters
উদ্বাস্তুর লাশ
টুরিঙ্গিয়া রাজ্যের সালফেল্ড-এ অবস্থিত একটি রাজনৈতিক আশ্রয়প্রার্থী আবাসে সোমবার একটি অগ্নিকাণ্ডের পর ২৯ বছর বয়সি এক ইরিট্রিয়ান উদ্বাস্তুর লাশ পাওয়া যায়৷ কিভাবে এই শরণার্থী প্রাণ হারিয়েছেন, তা এখনও অজ্ঞাত৷ তবে আবাসটিতে ইচ্ছাকৃতভাবে অগ্নিসংযোগের কোনো হদিশ পুলিশ এখনও পায়নি৷
ছবি: picture-alliance/dpa
যে কোনো পন্থায়
টুরিঙ্গিয়ায় এর আগেও উদ্বাস্তু আবাস হিসেবে চিহ্নিত বাড়িঘরে আগুন ধরিয়ে শরণার্থীদের আসা বন্ধ করার চেষ্টা করা হয়েছে৷ যেমন বিশহাগেন-এর এই বাড়িটির ছাদ পুরোপুরি পুড়ে গিয়েছে৷ গত সোমবার এখানে প্রথম উদ্বাস্তুদের আসার কথা ছিল৷
ছবি: picture-alliance/dpa/M. Gränzdörfer
ঘরে বাইরে
শরণার্থী সংকট এখন জার্মানির অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতেও টান ধরাচ্ছে৷ চ্যান্সেলর ম্যার্কেলের সিডিইউ দলের জোড়োয়া দল বাভারিয়ার সিএসইউ৷ তাদের প্রধান হর্স্ট জেহোফার সেপ্টেম্বর মাসের শেষে একটি দলীয় সম্মেলনে বক্তা হিসেব আমন্ত্রণ জানান হাঙ্গেরির প্রধানমন্ত্রী ভিক্টর অর্বান-কে, যিনি সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে উদ্বাস্তুর স্রোত আটকানোর চেষ্টা করেছেন৷
ছবি: Reuters/M. Dalder
হাওয়া যদি বদলায়
বাভারিয়ার অর্থমন্ত্রী মার্কুস জ্যোডার ইতিপূর্বেও বলেছেন: ‘‘আমরা (অর্থাৎ জার্মানি) বিশ্বকে বাঁচাতে পারি না৷’’ এমনকি তিনি অস্ট্রিয়া সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া দেওয়ার কথাও চিন্তা করেছেন৷ তবে জ্যোডার যখন সম্প্রতি রাজনৈতিক আশ্রয় প্রাপ্তির সাংবিধানিক অধিকার সীমিত করার কথা বলেন, তখন জেহোফার স্বয়ং সাথে সাথে তা প্রত্যাখ্যান করেছেন৷