জার্মানিতে এএফডির যুব সংগঠনকে চরমপন্থি অভিহিত করা যাবে
৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৪
জার্মানির উগ্র-ডানপন্থি রাজনৈতিক দল এএফডির যুব সংগঠনকে আনুষ্ঠানিকভাবে চরমপন্থি হিসেবে অভিহিত করতে কোনো বাধা নেই৷ জার্মানির একটি আদালত এমন রায় দিয়েছে৷
বিজ্ঞাপন
মঙ্গলবার ঘোষিত জার্মানির একটি প্রশাসনিক আদালতের রায়ে বলা হয়েছে, অভ্যন্তরীণ গোয়েন্দা সংস্থা এএফডির অঙ্গ সংগঠনটিকে ‘চরম ডানপন্থি' হিসেবে চিহ্নিত করতে পারবে৷
কোলন শহরের প্রশাসনিক আদালতে এএফডি ও তাদের অঙ্গসংগঠন ‘ইউঙ্গে অলটারনেটিভ' (তরুণ বিকল্প) তাদেরকে এভাবে শনাক্ত করার বিপক্ষে আদেশ চেয়ে আবেদন করে৷ সেই আবেদন বাতিল করে দিয়েছে আদালত৷
তবে এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে চলতি সপ্তাহে উচ্চ আদালতে তারা আপিল করতে পারবে৷
রায়ে বলা হয়েছে, ‘আদালতের কাছে প্রতীয়মান হয়েছে যে, জেএ (ইউঙ্গে অলটারনেটিভ) একটি চরমপন্থি সংগঠন'৷ সংগঠনটি জার্মান সমাজের ‘নৃতাত্ত্বিক পরিচয়ভিত্তিক জাতীয়তাবাদী দৃষ্টিভঙ্গির' প্রচার চালায়৷ এই ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি ধারণকারীরা জার্মানির মানুষের নৃতাত্ত্বিক কাঠামো রক্ষা এবং বিদেশিদের বের করে দেয়া সমর্থন করেন৷ আদালত বলেছে, দলটি বিদেশিদের বিশেষ করে যাদের মুসলিম পরিচয় আছে তাদের প্রতি ‘অব্যাহত ক্ষোভ' প্রদর্শন করে যাচ্ছে৷
জার্মানির এএফডি নেতাদের কয়েকটি আলোচিত মন্তব্য
জার্মানির অভিবাসনবিরোধী অতি-ডানপন্থি এএফডি দলের নেতারা আক্রমণাত্মক ও উদ্ভট মন্তব্যের জন্য পরিচিত৷ ছবিঘরে এমন কয়েকজনের মন্তব্য থাকছে৷
ছবি: Britta Pedersen/dpa/picture alliance
বিয়র্ন হ্যোকে
টুরিঙ্গিয়া রাজ্যের এএফডি প্রধান হ্যোকে ২০১৭ সালে বার্লিনের হলোকস্ট মেমোরিয়ালকে ‘মনুমেন্ট অফ শেম’, অর্থাৎ ‘লজ্জার স্মৃতিসৌধ’ বলে আখ্যায়িত করে প্রথমবারের মতো শিরোনামে এসেছিলেন৷ নাৎসি অতীত নিয়ে প্রায়শ্চিত্ত করা বন্ধ করতেও বলেন তিনি৷ এরপর ২০২৩ সালে তিনি বলেন, ‘‘এই ইইউকে অবশ্যই মরতে হবে যেন সত্যিকারের ইউরোপ বাঁচতে পারে৷’’ ২০১৯ সালে আদালত বলেছিল, হ্যোকেকে ফ্যাসিস্ট বলা হলে সেটা অপবাদ দেওয়া হবে না৷
ছবি: picture-alliance/Arifoto Ug/Candy Welz
আলিস ভাইডেল
এএফডির অন্যতম পরিচিত মুখ দলের কো-চেয়ার ভাইডেল ২০১৮ সালে জার্মান সংসদে বলেছিলেন, ‘‘বোরকা, হেডস্কার্ফ পরা মেয়ে, ছুরি নিয়ে চলা মানুষ ও অলসেরা আমাদের সমৃদ্ধি, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও সামাজিক রাষ্ট্রের সুফল পাবে না৷’’
ছবি: Sebastian Kahnert/dpa/picture-alliance
আলেক্সান্ডার গাউলান্ড
এএফডির সাবেক সংসদীয় নেতা গাউলান্ড ২০১৮ সালে দলের তরুণ সদস্যদের সামনে দেওয়া এক বক্তব্যে বলেছিলেন, জার্মানির একটি দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে যেটা (হিটলারের) ১২ বছরের শাসনামলের চেয়ে বেশিদিন টিকে ছিল৷ ‘‘জার্মানির এক হাজারেরও বেশি বছরের সফল ইতিহাসে হিটলার আর নাৎসিরা পাখির বিষ্ঠার দাগ মাত্র,’’ বলেন তিনি৷
ক্রিস্টিয়ান ল্যুথ
বিতর্কিত মন্তব্য করে কয়েকবার পদ অবনমন হয়েছে সাবেক প্রেস অফিসার ল্যুথের৷ এরপরও তিনি ডানপন্থি এক ইউটিউব ব্লগারকে বলেছিলেন, ‘‘আমরা পরেও তাদের (অভিবাসীদের) গুলি করতে পারব, সেটা কোনো বিষয় নয়৷ বা গ্যাস দিতে পারব৷ আমার কাছে এটা কোনো বিষয় নয়৷
ছবি: Soeren Stache/dpa/picture-alliance
বেয়াট্রিক্স ফন স্টর্শ
ইউরোপীয় এই সাংসদ ২০১৬ সালে অভিবাসনপ্রত্যাশীদের সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘‘যারা আমাদের সীমান্তে দেয়া বাধা মানবে না, তারা আসলে হামলাকারী৷ তাদের বিরুদ্ধে নিজেদের রক্ষা করতে হবে- সেটি নারী ও শিশুদের গুলি করে হলেও৷’’
ছবি: picture-alliance/dpa/M. Murat
ফ্রাউকে পেট্রি
২০১৬ সালে জার্মানির একটি আঞ্চলিক পত্রিকাকে এএফডির সেই সময়কার প্রধান পেট্রি বলেছিলেন, ‘‘অবৈধভাবে জার্মানিতে প্রবেশকারী শরণার্থীদের দিকে জার্মানির বর্ডার পুলিশের গুলি ছোড়া উচিত৷’’
ছবি: Getty Images/T. Lohnes
হারাল্ড ভায়এল
বুন্ডেসটাগ সদস্য ভায়এল ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে বলেছিলেন, তিনি আশা করছেন জার্মানিতে যেন ‘অনেক শীত’ পড়ে৷ তাহলে জ্বালানির জন্য অনেক খরচ হবে৷ ‘‘তা নাহলে সবকিছু এখন যেভাবে চলছে সেভাবেই চলতে থাকবে,’’ বলেন তিনি৷ অবশ্য এই কথা বলার সময় যে তার মাইক্রোফোন অন ছিল সেটি তিনি বুঝতে পারেননি৷
ছবি: Christoph Hardt /Future Image/imago images
7 ছবি1 | 7
জার্মানির স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ন্যান্সি ফেজা রায়কে স্বাগত জানিয়েছেন৷ তিনি বলেন, ‘‘আজকের রায়ে এটা পরিষ্কার যে আমরা মানবতার প্রতি ব্যাপক অবজ্ঞা, বর্ণবাদ, মুসলমানদের প্রতি ঘৃণা এবং আমাদের গণতন্ত্রের উপর হামলার মোকাবিলা করে যাচ্ছি৷''
গত এপ্রিলে জার্মানির অভ্যন্তরীণ গোয়েন্দা সংস্থা (বিএফভি) আনুষ্ঠানিকভাবে জেএ-কে চরমপন্থি হিসেবে চিহ্নিত করেছিল৷ যার ফলে দলটি ও তার সদস্যদের কর্মকাণ্ডকে জার্মানির গণতন্ত্রের জন্য সম্ভাব্য হুমকি হিসেবে ধরে নিয়ে তাদের উপর নজরদারি চালানোর অনুমোদন লাভ করে গোয়েন্দা সংস্থা৷ এর বিরুদ্ধেই আদালতে গিয়েছিল এএফডি ও তার অঙ্গ সংগঠন৷
সাম্প্রতিক সময়ে এএফডির নীতি নির্ধারণী একটি গোপন বৈঠকের খবর ফাঁসের পর জার্মানিতে ব্যাপক আলোড়ন তৈরি হয়৷ ক্ষমতায় আসলে তারা বিদেশিদের কীভাবে জার্মানি থেকে বের করবে সেই কৌশল নিয়ে বৈঠকে আলোচনা হয়৷ এই খবর প্রকাশিত হওয়ার পর জার্মানির বিভিন্ন শহরে গণতন্ত্রমনস্ক মানুষ দলটির বিরুদ্ধে ক্ষোভ জানিয়েছেন৷ এএফডিকে নিষিদ্ধ করার দাবিও জোরালো হয়েছে৷ এদিকে জরিপ অনুযায়ী এএফডির জনপ্রিয়তা বেড়েছে, যা নিয়ে উদ্বেগ আছে সরকারের মধ্যে৷
কট্টর-ডানপন্থি দল এএফডির উত্থানে উদ্বেগ বাড়ছে জার্মানির রাজনৈতিক অঙ্গনে৷ অভিবাসনবিরোধী দলটিকে নিষিদ্ধের দাবিও উঠেছে বিভিন্ন শহরের প্রতিবাদ, বিক্ষোভে৷
ছবি: Michael Kuenne/ZUMAPRESS/picture alliance
কোলনে ৩০ হাজার মানুষ
মঙ্গলবার কোলন শহরে এএফডি-র বিরুদ্ধে বিক্ষোভে ৩০ হাজার মানুষ জড়ো হন৷ টানা পাঁচদিন ধরে জার্মানির বিভিন্ন শহরে চলছে এই প্রতিবাদ৷
ছবি: Oliver Berg/dpa/picture alliance
‘ডানপন্থিদের বিরুদ্ধে গণতন্ত্রীদের জোট’
কোলন শহরে জড়ো হওয়ারা বিভিন্ন বার্তা নিয়ে হাজির হন৷ একজন প্ল্যাকার্ডে ‘ডানপন্থিদের বিরুদ্ধে সব গণতন্ত্রীদের জোট’ গড়ার আহ্বান জানিয়েছেন৷ নানা ইস্যুতে ক্ষমতাসীনদের জনপ্রিয়তা হ্রাস আর ডানপন্থি দলের সমর্থন বাড়ায় কেউ কেউ লিখে এনেছেন, ‘বর্ণবাদীরা বিকল্প হতে পারে না৷’
ছবি: Oliver Berg/dpa/picture alliance
চ্যান্সেলরের সমর্থন
কোলনের এই প্রতিবাদ-বিক্ষোভকে স্বাগত জানিয়েছেন জার্মানির চ্যান্সেলর ওলাফ শলৎসও৷ তিনি বিক্ষোভকারীদের উৎসাহ ও সাহস জোগাতে বার্তা দিয়েছেন৷ দেবেন ই বা না কেন? এএফডির উত্থানে যে বড় ধরনের দুশ্চিন্তায় পড়েছে ক্ষমতাসীনেরা৷
ছবি: Marc John/IMAGO
‘নাৎসিদের সরকারে নয়’
একইদিনে ১৫ হাজারের বেশি মানুষ এসেনে অল্টারনেটিভ ফর জার্মানি বা এএফডি দলটির বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করেছেন৷ ‘নাৎসিদের সরকারে নয়’, ‘ধূসর নয়, রঙিনকে বেছে নিন’, এমন স্লোগান দেন তারা৷
ছবি: David Young/dpa/picture alliance
ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে লাইপসিশ
এএফডি ছাড়াও উগ্র-রক্ষণশীল দল ভ্যালুস ইউনিয়ন নামের আরেকটি দলের বিরুদ্ধে রাস্তায় নেমেছেন পূর্বের শহর লাইপসিশের মানুষ৷ মোবাইলে আলো জ্বালিয়ে শহরের ফেডারেল অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ কোর্টের সামনে জড়ো হন তারা৷ ‘ফ্যাসিবাদ আর কখনো নয়’, ‘এএফডিকে না’, ‘এএফডি নাৎসি দল’, এমন স্লোগান দেন তারা৷ সোমবার এই বিক্ষোভে পাঁচ হাজার মানুষ অংশ নিয়েছেন বলে জানিয়েছে পুলিশ৷
ছবি: Jan Woitas/dpa/picture alliance
গ্য়োটিঙেনে মুখোমুখি
শনিবার গ্য়োটিঙেনে বিক্ষোভ করেছেন উগ্র ডানপন্থার পক্ষ ও বিপক্ষের মানুষ৷ ডানপন্থাবিরোধী জোট নামে একটি পক্ষ পুলিশের বাধার সামনে রাস্তায় বসে পড়েন (ছবিতে)৷ একই সময়ে ডানপন্থি ১০টি সংগঠনের সদস্যরা লোয়ার স্যাক্সনির শহরটিতে পাল্টা প্রতিবাদ করেছেন৷
ছবি: Swen Pförtner/dpa/picture alliance
বার্লিনে ঐক্যের ডাক
তার আগে রোববার বার্লিনে প্রতিবাদে শামিল হন ২৫ হাজার মানুষ৷ ফ্রাইডে ফর ফিউচারসহ বিভিন্ন এনজিও ও আন্দোলনকর্মীরা এতে অংশ নেন৷ কট্টর ডানপন্থার বিরুদ্ধে গণতন্ত্রের মূল্যবোধের ধারাবাহিকতা রক্ষায় ঐক্যের ডাক দেন তারা৷
ছবি: Rainer Keuenhof/picture alliance
প্রতিবাদে সরকারও
এএফডির কর্মকাণ্ড নিয়ে চিন্তায় আছে সরকারও৷ একদিকে তাদের জনপ্রিয়তা কমছে, অন্যদিকে ডানপন্থিদের বাড়ছে৷ এমন পরিস্থিতিতে অস্তিত্ব রক্ষায় জোট সরকারের তিন দলের নেতারাও ডানপন্থা ঠেকানোর দাবিতে মানুষের সাথে শামিল হয়েছেন৷ রোববার পটসডামে এসপিডির নেতা জার্মানির চ্যান্সেলর শলৎস, গ্রিন পার্টির নেত্রী পররাষ্ট্রমন্ত্রী আনালেনা বেয়ারবকও বিক্ষোভে অংশ নেন।
ছবি: Sebastian Gollnow/dpa/picture alliance
যে কারণে ক্ষোভ
অনুসন্ধানী সংবাদমাধ্যম কারেকটিভ জানিয়েছে, সম্প্রতি পটসডামে এএফডিসহ উগ্র ডানপন্থি দলগুলো একটি বৈঠক করে৷ নির্বাচনে জয়লাভের পর ‘রিমাইগ্রেশন’ বা জার্মানিতে আসা অভিবাসীদের কীভাবে নিজ দেশে ফেরত পাঠানো যায়- সেই কৌশল নিয়ে তারা আলোচনা করে৷ এই বৈঠকে জার্মান পার্লামেন্টের কয়েকজন সদস্যও উপস্থিত ছিলেন বলে জানিয়েছে কারেক্টিভ৷ এমন পরিস্থিতিতে এএফডিকে নিষিদ্ধ করার দাবি আবারো জোরালো হয়ে উঠেছে রাজনৈতিক মহলে৷