জার্মানির পার্লামেন্টে এখন এএফডি-র বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেয়া যায় তানিয়ে আলোচনা চলছে। ক্ষমতাসীন জোটের তিন শরিক এসপিডি, এফডিপি ও গ্রিন পার্টির সদস্যরা এএফডি-র বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য প্রস্তাব এনেছেন। প্রস্তাবে বলা হয়েছে, গণতন্ত্রের শত্রুদের বিরুদ্ধে এবং যারা জোর করে মানুষকে উৎখাত করতে চায় তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে।
মিডিয়া রিপোর্ট করেছে যে, এএফডি কর্মকর্তারা এবং সিডিইউ-এর কয়েকজন নেতা একটি বৈঠকে অংশ নিয়েছিলেন। সেখানে রিমাইগ্রেশন বা জার্মানি থেকে জোর করে অভিবাসীদের ফেরত পাঠানো নিয়ে আলোচনা হয়।
পার্লামেন্টে বিতর্কের সময় এএফডি নেতা বাউম্যান বলেছেন, ‘‘ওই মিটিংটা আসলে ছোট ব্যক্তিগত ও বেসরকারি একটি বিতর্কসভা ছিল। এটা কোনো গোপন বৈঠক ছিল না। কিন্তু আমরা দেখতে পাচ্ছি আমাদের গণতন্ত্রবিরোধী বলে চিহ্নিত করার চেষ্টা করা হচ্ছে।’’
ন্যান্সি ফ্রেজার বলেছেন, তিনি শেষ বিকল্প হিসাবে এএফডি-কে নিষিদ্ধ করার কথাও ভাবতে পারছেন।
জার্মানির এএফডি নেতাদের কয়েকটি আলোচিত মন্তব্য
জার্মানির অভিবাসনবিরোধী অতি-ডানপন্থি এএফডি দলের নেতারা আক্রমণাত্মক ও উদ্ভট মন্তব্যের জন্য পরিচিত৷ ছবিঘরে এমন কয়েকজনের মন্তব্য থাকছে৷
ছবি: Britta Pedersen/dpa/picture alliance
বিয়র্ন হ্যোকে
টুরিঙ্গিয়া রাজ্যের এএফডি প্রধান হ্যোকে ২০১৭ সালে বার্লিনের হলোকস্ট মেমোরিয়ালকে ‘মনুমেন্ট অফ শেম’, অর্থাৎ ‘লজ্জার স্মৃতিসৌধ’ বলে আখ্যায়িত করে প্রথমবারের মতো শিরোনামে এসেছিলেন৷ নাৎসি অতীত নিয়ে প্রায়শ্চিত্ত করা বন্ধ করতেও বলেন তিনি৷ এরপর ২০২৩ সালে তিনি বলেন, ‘‘এই ইইউকে অবশ্যই মরতে হবে যেন সত্যিকারের ইউরোপ বাঁচতে পারে৷’’ ২০১৯ সালে আদালত বলেছিল, হ্যোকেকে ফ্যাসিস্ট বলা হলে সেটা অপবাদ দেওয়া হবে না৷
ছবি: picture-alliance/Arifoto Ug/Candy Welz
আলিস ভাইডেল
এএফডির অন্যতম পরিচিত মুখ দলের কো-চেয়ার ভাইডেল ২০১৮ সালে জার্মান সংসদে বলেছিলেন, ‘‘বোরকা, হেডস্কার্ফ পরা মেয়ে, ছুরি নিয়ে চলা মানুষ ও অলসেরা আমাদের সমৃদ্ধি, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও সামাজিক রাষ্ট্রের সুফল পাবে না৷’’
ছবি: Sebastian Kahnert/dpa/picture-alliance
আলেক্সান্ডার গাউলান্ড
এএফডির সাবেক সংসদীয় নেতা গাউলান্ড ২০১৮ সালে দলের তরুণ সদস্যদের সামনে দেওয়া এক বক্তব্যে বলেছিলেন, জার্মানির একটি দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে যেটা (হিটলারের) ১২ বছরের শাসনামলের চেয়ে বেশিদিন টিকে ছিল৷ ‘‘জার্মানির এক হাজারেরও বেশি বছরের সফল ইতিহাসে হিটলার আর নাৎসিরা পাখির বিষ্ঠার দাগ মাত্র,’’ বলেন তিনি৷
ক্রিস্টিয়ান ল্যুথ
বিতর্কিত মন্তব্য করে কয়েকবার পদ অবনমন হয়েছে সাবেক প্রেস অফিসার ল্যুথের৷ এরপরও তিনি ডানপন্থি এক ইউটিউব ব্লগারকে বলেছিলেন, ‘‘আমরা পরেও তাদের (অভিবাসীদের) গুলি করতে পারব, সেটা কোনো বিষয় নয়৷ বা গ্যাস দিতে পারব৷ আমার কাছে এটা কোনো বিষয় নয়৷
ছবি: Soeren Stache/dpa/picture-alliance
বেয়াট্রিক্স ফন স্টর্শ
ইউরোপীয় এই সাংসদ ২০১৬ সালে অভিবাসনপ্রত্যাশীদের সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘‘যারা আমাদের সীমান্তে দেয়া বাধা মানবে না, তারা আসলে হামলাকারী৷ তাদের বিরুদ্ধে নিজেদের রক্ষা করতে হবে- সেটি নারী ও শিশুদের গুলি করে হলেও৷’’
ছবি: picture-alliance/dpa/M. Murat
ফ্রাউকে পেট্রি
২০১৬ সালে জার্মানির একটি আঞ্চলিক পত্রিকাকে এএফডির সেই সময়কার প্রধান পেট্রি বলেছিলেন, ‘‘অবৈধভাবে জার্মানিতে প্রবেশকারী শরণার্থীদের দিকে জার্মানির বর্ডার পুলিশের গুলি ছোড়া উচিত৷’’
ছবি: Getty Images/T. Lohnes
হারাল্ড ভায়এল
বুন্ডেসটাগ সদস্য ভায়এল ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে বলেছিলেন, তিনি আশা করছেন জার্মানিতে যেন ‘অনেক শীত’ পড়ে৷ তাহলে জ্বালানির জন্য অনেক খরচ হবে৷ ‘‘তা নাহলে সবকিছু এখন যেভাবে চলছে সেভাবেই চলতে থাকবে,’’ বলেন তিনি৷ অবশ্য এই কথা বলার সময় যে তার মাইক্রোফোন অন ছিল সেটি তিনি বুঝতে পারেননি৷
ছবি: Christoph Hardt /Future Image/imago images
7 ছবি1 | 7
কীভাবে একটি দল নিষিদ্ধ হতে পারে?
২০১৭ সালে এনপিডি পার্টিকে নিষিদ্ধ করার চেষ্টা হয়েছিল এবং তা ব্যর্থ হয়েছিল। তারপর তারা নাম বদল করে নিজেদের নাম রেখেছে হোমল্যান্ড। সাংবিধানিক আদালত সেসময় রায় দিয়েছিল, এই দল এতটাই গুরুত্বহীন যে, তাদের কাছ থেকে গণতন্ত্রের বিপদের কোনো কারণ নেই। তাই তারা ওই দলকে নিষিদ্ধ করেনি।
কিন্তু এএফডির অবস্থা এনএফডির মতো নয়। এএফডি-র পিছনে এখন যথেষ্ট জনসমর্থন রয়েছে। জার্মানির ১৬টি রাজ্যের মধ্যে তিনটিতে এই দলকে চরম দক্ষিণপন্থি দল বলা হয়েছে।
ফেডারেল সাংবিধানিক আদালত কোনো দলকে নিষিদ্ধ করার ক্ষেত্রে অতি কঠিন মাপদণ্ড রেখেছে। সাংবিধানিক আইন বিশেষজ্ঞ ক্রিশ্চিয়ান পেস্তালোজ্জা জানিয়েছেন, কোনো দলকে নিষিদ্ধ করার জন্য একটি আবশ্যিক শর্ত হলো, সেই দল কোনো না কোনো সময় তাদের লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য যথেষ্ট শক্তিসঞ্চয় করেছিল।
অর্থ না দেয়া
তবে সরকারের থেকে দল যে অর্থ পায় সেটা বন্ধ করার কাজটা অত কঠিন নয়। রাজনৈতিক দলগুলির অর্থ আসে সদস্য চাঁদা, ডোনেশন এবং করদাতাদের অর্থ থেকে। কোনো দল যত বেশি ভোট পায়, তত বেশি সরকারি বা রাষ্ট্রীয় সাহায্য পায়। এএফডি এখন এক কোটি ইউরো(১১৯ কোটিরও বেশি বাংলাদেশি টাকা) রাষ্ট্রের কাছ থেকে পায়।
কট্টর-ডানপন্থি দল এএফডির উত্থানে উদ্বেগ বাড়ছে জার্মানির রাজনৈতিক অঙ্গনে৷ অভিবাসনবিরোধী দলটিকে নিষিদ্ধের দাবিও উঠেছে বিভিন্ন শহরের প্রতিবাদ, বিক্ষোভে৷
ছবি: Michael Kuenne/ZUMAPRESS/picture alliance
কোলনে ৩০ হাজার মানুষ
মঙ্গলবার কোলন শহরে এএফডি-র বিরুদ্ধে বিক্ষোভে ৩০ হাজার মানুষ জড়ো হন৷ টানা পাঁচদিন ধরে জার্মানির বিভিন্ন শহরে চলছে এই প্রতিবাদ৷
ছবি: Oliver Berg/dpa/picture alliance
‘ডানপন্থিদের বিরুদ্ধে গণতন্ত্রীদের জোট’
কোলন শহরে জড়ো হওয়ারা বিভিন্ন বার্তা নিয়ে হাজির হন৷ একজন প্ল্যাকার্ডে ‘ডানপন্থিদের বিরুদ্ধে সব গণতন্ত্রীদের জোট’ গড়ার আহ্বান জানিয়েছেন৷ নানা ইস্যুতে ক্ষমতাসীনদের জনপ্রিয়তা হ্রাস আর ডানপন্থি দলের সমর্থন বাড়ায় কেউ কেউ লিখে এনেছেন, ‘বর্ণবাদীরা বিকল্প হতে পারে না৷’
ছবি: Oliver Berg/dpa/picture alliance
চ্যান্সেলরের সমর্থন
কোলনের এই প্রতিবাদ-বিক্ষোভকে স্বাগত জানিয়েছেন জার্মানির চ্যান্সেলর ওলাফ শলৎসও৷ তিনি বিক্ষোভকারীদের উৎসাহ ও সাহস জোগাতে বার্তা দিয়েছেন৷ দেবেন ই বা না কেন? এএফডির উত্থানে যে বড় ধরনের দুশ্চিন্তায় পড়েছে ক্ষমতাসীনেরা৷
ছবি: Marc John/IMAGO
‘নাৎসিদের সরকারে নয়’
একইদিনে ১৫ হাজারের বেশি মানুষ এসেনে অল্টারনেটিভ ফর জার্মানি বা এএফডি দলটির বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করেছেন৷ ‘নাৎসিদের সরকারে নয়’, ‘ধূসর নয়, রঙিনকে বেছে নিন’, এমন স্লোগান দেন তারা৷
ছবি: David Young/dpa/picture alliance
ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে লাইপসিশ
এএফডি ছাড়াও উগ্র-রক্ষণশীল দল ভ্যালুস ইউনিয়ন নামের আরেকটি দলের বিরুদ্ধে রাস্তায় নেমেছেন পূর্বের শহর লাইপসিশের মানুষ৷ মোবাইলে আলো জ্বালিয়ে শহরের ফেডারেল অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ কোর্টের সামনে জড়ো হন তারা৷ ‘ফ্যাসিবাদ আর কখনো নয়’, ‘এএফডিকে না’, ‘এএফডি নাৎসি দল’, এমন স্লোগান দেন তারা৷ সোমবার এই বিক্ষোভে পাঁচ হাজার মানুষ অংশ নিয়েছেন বলে জানিয়েছে পুলিশ৷
ছবি: Jan Woitas/dpa/picture alliance
গ্য়োটিঙেনে মুখোমুখি
শনিবার গ্য়োটিঙেনে বিক্ষোভ করেছেন উগ্র ডানপন্থার পক্ষ ও বিপক্ষের মানুষ৷ ডানপন্থাবিরোধী জোট নামে একটি পক্ষ পুলিশের বাধার সামনে রাস্তায় বসে পড়েন (ছবিতে)৷ একই সময়ে ডানপন্থি ১০টি সংগঠনের সদস্যরা লোয়ার স্যাক্সনির শহরটিতে পাল্টা প্রতিবাদ করেছেন৷
ছবি: Swen Pförtner/dpa/picture alliance
বার্লিনে ঐক্যের ডাক
তার আগে রোববার বার্লিনে প্রতিবাদে শামিল হন ২৫ হাজার মানুষ৷ ফ্রাইডে ফর ফিউচারসহ বিভিন্ন এনজিও ও আন্দোলনকর্মীরা এতে অংশ নেন৷ কট্টর ডানপন্থার বিরুদ্ধে গণতন্ত্রের মূল্যবোধের ধারাবাহিকতা রক্ষায় ঐক্যের ডাক দেন তারা৷
ছবি: Rainer Keuenhof/picture alliance
প্রতিবাদে সরকারও
এএফডির কর্মকাণ্ড নিয়ে চিন্তায় আছে সরকারও৷ একদিকে তাদের জনপ্রিয়তা কমছে, অন্যদিকে ডানপন্থিদের বাড়ছে৷ এমন পরিস্থিতিতে অস্তিত্ব রক্ষায় জোট সরকারের তিন দলের নেতারাও ডানপন্থা ঠেকানোর দাবিতে মানুষের সাথে শামিল হয়েছেন৷ রোববার পটসডামে এসপিডির নেতা জার্মানির চ্যান্সেলর শলৎস, গ্রিন পার্টির নেত্রী পররাষ্ট্রমন্ত্রী আনালেনা বেয়ারবকও বিক্ষোভে অংশ নেন।
ছবি: Sebastian Gollnow/dpa/picture alliance
যে কারণে ক্ষোভ
অনুসন্ধানী সংবাদমাধ্যম কারেকটিভ জানিয়েছে, সম্প্রতি পটসডামে এএফডিসহ উগ্র ডানপন্থি দলগুলো একটি বৈঠক করে৷ নির্বাচনে জয়লাভের পর ‘রিমাইগ্রেশন’ বা জার্মানিতে আসা অভিবাসীদের কীভাবে নিজ দেশে ফেরত পাঠানো যায়- সেই কৌশল নিয়ে তারা আলোচনা করে৷ এই বৈঠকে জার্মান পার্লামেন্টের কয়েকজন সদস্যও উপস্থিত ছিলেন বলে জানিয়েছে কারেক্টিভ৷ এমন পরিস্থিতিতে এএফডিকে নিষিদ্ধ করার দাবি আবারো জোরালো হয়ে উঠেছে রাজনৈতিক মহলে৷
ছবি: Jan Woitas/dpa/picture alliance
9 ছবি1 | 9
ক্রিশ্চিয়ান বলেছেন, যদি কোনো দল কোনো অসাংবিধানিক লক্ষ্য নেয়, তাহলে তাদের অর্থ বন্ধ করে দেয়া যেতে পারে। তারা যে ওই লক্ষ্য়ের প্রতি দায়বদ্ধ এটা দেখাতে পারলেই অর্থ বন্ধ করে দেয়া সম্ভব।
যদিও এএফডির রাজনৈতিক কর্মসূচির কথা শুনে মনে হবে, সেগুলি একেবারেই ক্ষতিকর নয়। কিন্তু বাস্তব অবস্থাটা আলাদা বলে ক্রিশ্চিয়ান জানিয়েছেন।
তবে তিনি জানিয়েছেন, এই শর্তগুলি পূরণ হয়েছে কিনা সেটা নিয়ে বিতর্ক থাকতে পারে। এটা সংশ্লিষ্ট সরকারি বিভাগ ও গোয়েন্দা বিভাগ সিদ্ধান্ত নিতে পারে।
কয়েকটি রাজ্যে এএফডির কাজকর্মের উপর নজরদারি রাখা হচ্ছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এই নজরদারি থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে অন্ততপক্ষে ওই রাজ্যগুলিতে এএফডি -র সরকারি সাহায্য বন্ধ করা সম্ভব। তবে তার জন্য পার্লামেন্টে প্রস্তাব আনতে হবে। তারপরেও সাংবিধানিক আদালত সেই সিদ্ধান্ত বাতিল করতে পারে।
এছাড়া আরেকটা উপায় আছে। সেটা হলো, ব্যক্তিদের মূল অধিকার প্রত্যাহার করে নেয়া হতে পারে। তাহলে তারা কোনো সরকারি পদে থাকতে পারবেন না।
পার্লামেন্টে যখন বিতর্ক হবে, তখন আরো কিছু পন্থা বের হয়ে আসতে পারে।