তুর্কি প্রেসিডেন্ট রেচেপ তাইয়েপ এর্দোয়ান জার্মানিতে রাষ্ট্রীয় সফরে আসলে তাঁর জন্য লাল গালিচা বিছানো আর তাঁকে সামরিক সম্মান জানানো নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করেছেন জার্মান রাজনীতিবিদরা৷
বিজ্ঞাপন
যদিও এর্দোয়ানের জার্মানিতে রাষ্ট্রীয় সফর নিয়ে এখনো বিস্তারিত কিছু জানা যায়নি, তবুও তিনি সেই সফরে কী ধরনের রাষ্ট্রীয় অভ্যর্থনা পাবেন, তা নিয়ে বিস্তর আলোচনা শুরু হয়ে গেছে৷
জার্মান প্রেসিডেন্ট ফ্রাংক ভাল্টার স্টাইনমায়ারের এক মুখপাত্র স্বীকার করেছেন যে এর্দোয়ানকে জার্মানি সফরের জন্য একটি আমন্ত্রণপত্র ইতোমধ্যে পাঠানো হয়েছে৷ তবে বার্লিন এবং আংকারার তরফ থেকে সেই সফর এখনো চূড়ান্ত করা হয়নি৷ এদনকি সফরের নির্দিষ্ট কোনো দিনক্ষণও নিশ্চিত করেনি কোনো পক্ষ৷
তবে দিনক্ষণ কিংবা এর্দোয়ানের সফর ঠিক কী ধরনের হবে, সেটা নিয়ে নির্দিষ্ট তথ্য জানা না গেলেও জার্মানির রাজনীতিবিদরা এই বিষয়ে মন্তব্য করতে শুরু করেছেন৷ জার্মানির সবুজ দলের রাজনীতিবিদ চেম ও্যজদেমির মনে করেন, গণতন্ত্রের বিচারে এর্দোয়ান কোনো স্বাভাবিক প্রেসিডেন্ট নন৷ জার্মানির একটি পত্রিকাকে তিনি বলেন, ‘‘এর্দোয়ান নিষেধাজ্ঞা, স্বেচ্ছাতন্ত্র, স্বজনপোষণ এবং একনায়কতন্ত্রের মাধ্যমে তুরস্ককে একরকম তুর্কমিনিস্তান বা আজারবাইজানে পরিণত করেছেন৷''
ফলেএর্দোয়ানকে কোনো ধরনের অভ্যর্থনা জানানোর আগে বিষয়টি বিবেচনা করা উচিত বলে মনে করেন ও্যজদেমির৷ তাঁর মতো একই সূরে মন্তব্য করেছেন উগ্র ডানপন্থি দল এএফডির সংসদীয় কমিটির প্রধান এলিস ভিডেল৷ তিনি বলেন, ‘‘এর্দোয়ানের উচিত নিজের দেশে থাকা৷ জার্মান সরকারের উচিত হবে না বার্লিনে তাঁকে আরেকটি ‘প্রোপাগান্ডা শো' করার সুযোগ দেয়া৷''
জার্মান সরকার অবশ্য সোমবার জানিয়েছে, এর্দোয়ানের সঙ্গে যেকোন ধরনের আলোচনায় অংশ নিতে আগ্রহী চ্যান্সেলর আঙ্গেলা ম্যার্কেল৷ বর্তমান জোট সরকারের শরিক রাজনীতিবিদরাও সফরের বিষয়টিকে ইতিবাচকভাবেই দেখছেন৷ জার্মান পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাইকো মাস বলেছেন, ‘‘আমি কখনোই এই যুক্তিতে নিজেকে আস্বস্ত করতে পারিনি যে জটিল সঙ্গীদের সঙ্গে কোনো ধরনের কথাবার্তা না বলাই ভালো৷''
ম্যার্কেলের দল সিডিইউর রাজনীতিবিদ এলমার ব্রোক অতীতের কথা উল্লেখ করে বলেছেন, ‘‘আমরা এর আগেও বিতর্কিত অনেক রাষ্ট্রপ্রধানের জন্য লাল গালিচা বিছিয়ে দিয়েছি৷ আমরা যদি শুধুমাত্র গণতান্ত্রিক নেতাদের সঙ্গে আলাপ করে চাই, তাহলে জার্মানি শীঘ্রই একা হয়ে পড়বে৷''
উল্লেখ্য, তুরস্কে ২০১৬ সালে এক ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থানের পর ব্যাপক ধরপাকড় শুরু হয়৷ এর্দোয়ান তখন জরুরি অবস্থা ঘোষণা করে তাঁর প্রকৃত এবং কাল্পনিক শত্রুদের উপর দমনপীড়ান চালান৷ সেসময় এক জার্মান সাংবাদিক এবং এক মানবাধিকার কর্মীকেও গ্রেপ্তার করা হয়৷ তুরস্কে মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়ে জার্মানি সোচ্চার হলে দু'দেশের মধ্যে সম্পর্কের অবনতি ঘটে৷
রেবেকা স্টাইডেনমায়ার/এআই
তুরস্কের রেচেপ তাইয়েপ এর্দোয়ান কে?
ইসলামপন্থি তরুণ অ্যাক্টিভিস্ট থেকে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট– রাজনীতিতে নিজের ক্যারিয়ার ভালোভাবেই গড়েছেন রেচেপ তাইয়েপ এর্দোয়ান৷ তবে রাজনৈতিক জীবনে বহুবার বিতর্কে জড়িয়েছেন তিনি৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/E. Morenatti
এর্দোয়ানের উত্থান
তুরস্কে এবং বিদেশে রেচেপ তাইয়েপ এর্দোয়ান সম্পর্কে নানা ধরনের মতামত রয়েছে৷ তাঁকে নব্য-অটোমান ‘সুলতান’ হিসেবে যেমন বিবেচনা করা হয়, তেমনি কারো কারো চোখে তিনি একজন স্বৈরাচারী নেতা৷ রাজনৈতিক জীবনের শুরু থেকেই ইসলামপন্থিদের বিভিন্ন দাবিদাওয়ার ব্যাপারে সচেতন ছিলেন তিনি৷ পাশাপাশি ন্যাটোতে তাঁর নেতৃত্বে বড় ধরনের অবদান রাখছে তুরস্ক৷ এর্দোয়ানের উত্থান নিয়ে এই ছবিঘর৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/E. Morenatti
ইস্তানবুলের কারাবন্দি মেয়র
তুরস্কে ইসলামপন্থিদের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত দল ওয়েলফেয়ার পার্টিতে নিজের অবস্থান দ্রুতই পাকাপোক্ত করেছিলেন এর্দোয়ান৷ ১৯৯৪ সালে তিনি সেই দল থেকে ইস্তানবুলের মেয়রও নির্বাচিত হন৷ কিন্তু এর্দোয়ান মেয়র হওয়ার চার বছরের মাথায় সেই দলটিকে সে দেশের সরকার তুরস্কের ধর্মনিরপেক্ষ নীতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয় ঘোষণা দিয়ে নিষিদ্ধ করে৷ এরপর জনসমক্ষে বিতর্কিত কবিতা আবৃত্তির দায়ে জেলে যান এর্দোয়ান৷ চার মাস জেল খাটেন৷
তুরস্কের একেপি পার্টির সহপ্রতিষ্ঠাতা এর্দোয়ান৷ ২০০২ সালের নির্বাচনে দলটি সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন লাভ করে৷ আর ২০০৩ সালে তিনি প্রধানমন্ত্রী হন৷ দায়িত্ব গ্রহণের প্রথম বছরগুলোতে এর্দোয়ান দেশবাসীকে সামাজিক সুযোগ-সুবিধা প্রদান, অর্থনীতির উন্নয়ন এবং বিভিন্ন গণতান্ত্রিক সংস্কারের দিকে মনোযোগী হন৷ তবে কেউ কেউ এটাও মনে করেন যে, প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তিনি রাজনীতিতে ধর্মের মিশ্রণ ঘটানোয় ভূমিকা রেখেছেন৷
ছবি: picture-alliance/dpa/B. Ozbilici
ইসলামপন্থিদের স্বার্থ রক্ষা
যদিও তুরস্কের সংবিধান দেশটির ধর্মনিরপেক্ষ অবস্থানকে সমর্থন করে, তারপরও এর্দোয়ান কট্টর ইসলামপন্থিদের মন জয়ের নানা চেষ্টা করেছেন৷ তুরস্কের এই শীর্ষনেতা একসময় বলেছিলেন যে, তাঁর লক্ষ্যগুলোর একটি হচ্ছে এক ‘ধার্মিক প্রজন্ম’ গড়ে তোলা৷ এর্দোয়ানের সমর্থকরা এই লক্ষ্যের প্রতি সমর্থন জানিয়েছেন, কেননা, তাঁরা মনে করেন, ধর্মচর্চা করা মুসলমানরা তুরস্কে নানাভাবে বঞ্চিত হচ্ছিল৷
ছবি: picture-alliance/AA/C. Ozdel
ক্যু থেকে রক্ষা
২০১৬ সালের জুলাইয়ে এর্দোয়ানের বিরুদ্ধে সে দেশের সেনাবাহিনীর এক অভ্যুত্থান ব্যর্থ হয়৷ তবে সেই ঘটনায় দু’শ’র বেশি বেসামরিক নাগরিক এবং সেনা সদস্য নিহত হন৷ সেই ব্যর্থ সেনা অভ্যুত্থানের পর এর্দোয়ান আরো ক্ষমতাশালী হয়ে ওঠেন এবং জরুরি অবস্থা ঘোষণার পাশাপাশি সেনাবাহিনীতে ‘শুদ্ধি অভিযান’ শুরু করেন৷
ছবি: picture-alliance/AA/K. Ozer
দেশজুড়ে অভিযান
ব্যর্থ সেই সেনা অভ্যুত্থানের পর দেশজুড়ে অভিযান পরিচালনা করে তুর্কি কর্তৃপক্ষ৷ এতে সেনাবাহিনী, পুলিশ, বিচার ব্যবস্থা, স্কুল এবং গণমাধ্যম থেকে পঞ্চাশ হাজারের বেশি মানুষকে গ্রেপ্তার করা হয়৷ এর্দোয়ান সেই সেনা অভ্যুত্থানের পেছনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নির্বাসিত ধর্মীয় নেতা এবং তাঁর প্রাক্তন সঙ্গী ফেতুল্লাহ গুলেনের হাত রয়েছে বলে দাবি করেন৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/E. Gurel
বিভেদ সৃষ্টিকারী রাজনীতিবিদ
যদিও নিজের দেশে এবং বিদেশে বসবাসরত তুর্কিদের একটি বড় অংশের সমর্থন রয়েছে এর্দোয়ানের প্রতি, তা সত্ত্বেও তিনি তাঁর কঠোর নীতি এবং কুর্দিদের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান চালানোয় কড়া সমালোচনার মুখে পড়েছেন৷ চলতি বছরের জানুয়ারিতে আফরিনে মারাত্মক আক্রমণ পরিচালনা করেন এর্দোয়ান, যার সমালোচনা করে মানবাধিকা সংস্থাগুলো৷
ছবি: picture- alliance/ZUMAPRESS/Brais G. Rouco
ব্যাপক ক্ষমতাধর
২০১৭ সালে এক গণভোটের মাধ্যমে দেশটির সংবিধান সংশোধন করা হয়৷ সংসদীয় গণতন্ত্র থেকে রাষ্ট্রপতি শাসিত প্রজাতন্ত্রে পরিণত হয় তুরস্ক৷ ২০১৮ সালের ২৪ জুন নতুন করে ৫ বছরের জন্য প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন তিনি৷ দেশটির ইতিহাসে এতো ক্ষমতাবান প্রেসিডেন্ট এর আগে আসেননি৷ শপথ নেয়ার দিন নিজের জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি- একেপির সদস্যদের এর্দোয়ান বলেন, ‘তুরস্ক নতুন যুগে প্রবেশ করেছে’৷