অথচ এ দেশে চাষিরা কিছু দীন-দরিদ্র নন৷ হয় তাঁদের জমিজমা, ট্র্যাক্টর, যন্ত্রপাতি সবই রয়েছে, নয়ত তাঁরা কোনো কৃষিখামারে বেশ ভালো মাইনেতে চাকরি করেন৷ তবুও তরুণ প্রজন্মের অধিকাংশ চাষবাসের দিকে যেতে চান না৷
ছবি: Reuters/M. Rehle
বিজ্ঞাপন
পরিস্থিতি নতুন কিছু নয়৷ বছর পাঁচেক আগে একটা ধুয়ো উঠেছিল যে, জার্মান কৃষিতে একটা ‘নাখভুক্স-প্রবলেম' দেখা দিয়েছে বা দিতে চলেছে৷ ‘নাখভুক্স' বলতে বোঝায় তরুণ প্রজন্ম বা পরের প্রজন্ম – এক কথায় কমবয়সি লোকজন, তা তাঁরা খামারমালিকই হন আর খামারের কর্মচারী বা প্রশিক্ষণার্থীই হন৷
বহু কৃষিজীবী নাকি চিন্তায় পড়েছিলেন, তাঁরা ছেড়ে দেবার পর তাঁদের সাধের খামারের কী হবে, কে তার ভার নেবে অথবা কিনবে৷ ২০১০ সালের একটি জরিপ অনুযায়ী নাকি ৪৫ বছরের বেশি বয়সের খামারমালিকদের ক্ষেত্রে মাত্র এক-তৃতীয়াংশ মোটামুটি জানতেন, তাঁদের পর কে খামারের দায়িত্ব নেবে৷ খামারগুলোয় ‘আউসসুবিল্ডেন্ডে' বা প্রশিক্ষণার্থীদের সংখ্যাও কমছে বছরের পর বছর৷ ওদিকে জার্মান কৃষিজীবীদের এক-তৃতীয়াংশের বয়স নাকি ৫৫ পেরিয়েছে৷ আগেই বলা হয়েছে, এ সব হল ২০১০ সালের খবর৷
দেশের তরুণরা ঝুঁকছে খামারে
ঢাকা শহরের ভেতরেই একটি খামার৷ সেখানে টার্কি, তিতির ও কোয়েল পাখির ‘চাষ’ বা ‘উৎপাদন’ করা হচ্ছে৷ নিজেদের প্রচেষ্টায় বাড্ডায় চালু হয়েছে এই খামার৷ দেশের ৬৪টি জেলায় তা ছড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা চলছে৷ ছবি পাঠিয়েছেন মিরাজ হোসেন৷
ছবি: picture-alliance/dpa
যেভাবে শুরু
একজন শৌখিন, কৃষিমনস্ক প্রকৌশলী শাহীন হাওলাদার ও একজন তরুণ উদ্যোক্তা মিরাজ হোসেনের যৌথ প্রয়াসে ঢাকার বাড্ডায় গড়ে উঠেছে একটি টার্কি খামার৷ খামারে সার্বক্ষনিক চিকিৎসা পরামর্শ দিয়ে থাকেন ফার্মাসিস্ট এনামুল হক৷
ছবি: Miraz Hossain
দুবাই থেকে ফিরে খামার
মিরাজ হোসেন জানান, দুবাই থেকে আসার পর কী করবেন ভেবে পাচ্ছিলেন না৷ পরবর্তীতে অনলাইনে টার্কি সম্পর্কে জানতে পারেন৷ তারপর টার্কি পালনের উপর কিছু প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে মাত্র ৬ টি টার্কি নিয়ে খামারটি শুরু করেন৷
ছবি: Miraz Hossain
‘টার্কি মিরাজ’
বর্তমানে টার্কি ‘উৎপাদন’ বাংলাদেশেও খুব জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে৷ এক্ষেত্রে বিশেষভাবে অবদান রেখেছে ‘মিরাজের টার্কি ফার্ম’৷ এই ফার্মের কারণে মিরাজ আজ সবার কাছে ‘টার্কি মিরাজ’ নামে পরিচিত৷ ২০১৫ সালের মাঝামাঝিতে মাত্র ৬টি টার্কি দিয়ে এই ফার্মটি শুরু করলেও বর্তমানে খামারে ২-৩ মাস বয়সী ১৫০ টি এবং ৭-৮ মাস বয়সি ৪৬ টি টার্কি রয়েছে৷
ছবি: Miraz Hossain
টার্কির আকার
পুরুষ টার্কি স্ত্রী টার্কির তুলনায় বড় এবং অনেক বেশি আকর্ষণীয় হয়৷ একটি পুরুষ টার্কির ওজন হয় ১০-১২ কেজি৷ পুরুষ টার্কির তুলনায় স্ত্রী টার্কি আকৃতিতে ছোট এবং ওজনে কম হয়৷ একটি স্ত্রী টার্কি বছরে ৮০-১০০ টি ডিম দেয়৷ (এই ছবিটি ডয়চে ভেলের)
ছবি: DW/E. Musli
রোগ প্রতিরোধ
অনুকুল পারিপার্শ্বিক অবস্থা, পরিবেশ, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ঘর ও নিয়মিত খাবার দিলে টার্কি মুরগি রোগাক্রান্ত হয় না৷ ৪ থেকে ৫ বর্গফুট জায়গা রাখতে হবে একটি টার্কির জন্য৷ নিয়মিত বিশেষজ্ঞ পরামর্শ নেয়া জরুরি৷ এতে রোগ সংক্রমণ কম হয়৷ চারটি ভ্যাকসিনেশন সিডিউল আছে৷ রানীক্ষেতসহ চারটি রোগের জন্য ভ্যাকসিন দিতে হয়৷
ছবি: Miraz Hossain
বাচ্চা উৎপাদন
ইনকিউবেটরের মাধ্যমে ২৮ দিনে টার্কির বাচ্চা উৎপাদন হয় এবং প্রতিমাসে আমার এখানে ২০০ থেকে ২৫০ টি বাচ্চা উৎপাদন হচ্ছে৷ এছাড়া দেশি মুরগির সাহায্যে সনাতন পদ্ধতিতেও ২৮ দিনে বাচ্চা উৎপাদন করা সম্ভব৷
ছবি: Miraz Hossain
প্রাণিজ প্রোটিনের উৎস
দেশের মানুষের প্রাণিজ প্রোটিনের চাহিদা পূরনের ক্ষেত্রে পোল্ট্রির পাশাপাশি টার্কি মুরগি বিরাট ভূমিকা রাখতে পারে বলে খামারিরা আশা করছেন৷
ছবি: Miraz Hossain
টার্কি ও তিতিরের দাম
টার্কির একমাস বয়সের একটি বাচ্চার দাম তিন হাজার টাকা, তিতিরের বাচ্চার দাম দুই হাজার টাকা৷ বড় একজোড়া টার্কির দাম ১০ থেকে ১২ হাজার টাকা৷ এছাড়া প্রতিটি ডিম বিক্রি হয় ১৫০ টাকায়৷
ছবি: Miraz Hossain
উট পাখি
মিরাজ হোসেন উট পাখিও পোষা শুরু করেছেন৷ এ থেকে লাভজনকভাবে উটপাখি উৎপাদন সম্ভব কিনা তা দেখছেন৷ ছবিতে উট পাখির একটি বাচ্চা হাতে নিয়ে আছেন মিরাজ হোসেন৷
ছবি: Miraz Hossain
কোয়েলের খামার
সাধারণত একটি ভালো জাতের কোয়েল পাখি বছরে ২৫০ থেকে ৩০০ টি ডিম দিয়ে থাকে৷ প্রায় প্রতিটি ডিম থেকেই বাচ্চা হয়৷ এই বাচ্চা পরবর্তী ৬ থেকে ৭ সপ্তাহের মধ্যেই ডিম দেওয়া আরম্ভ করে৷ এই বয়সের কোয়েল পাখির বাজারে প্রচুর চাহিদা৷ অত্যন্ত স্বল্প পুঁজি নিয়ে কোয়েল পাখির খামার করা যায় এবং খুব দ্রুতই লাভ পাওয়া সম্ভব৷
ছবি: Miraz Hossain
কোয়েলের যত্ন
ঘরের যেখানে পর্যাপ্ত আলো -বাতাস চলাচলের ব্যবস্থা রয়েছে সেখানেই কোয়েলের খাঁচা রাখা উত্তম৷ তবে লক্ষ্য রাখতে হবে, বৃষ্টির পানিতে কোয়েলের খাঁচা যেন ভিজে না যায়৷ ভিজে এবং স্যাঁতস্যাতে জায়গায় রাখলে কোয়েলের রোগ ব্যাধি বেশি হয়৷
ছবি: Miraz Hossain
আরও কয়েকজন
নুরুল হুদা, পার্থ মজুমদার বাপ্পি এবং শরীফ আব্দুল কাইয়ুমও এ ধরণের খামার করছেন৷ কেবল টার্কি নয় তিতির, কোয়েল পাখির খামার গড়েও সফলতা পেয়েছেন৷ শৌখিন পাখি যেমন ঘুঘু,কবুতর,টিয়া ইত্যাদি পাখিও যোগ করার পরিকল্পনা রয়েছে তাদের৷
ছবি: Miraz Hossain
অন্যদের উৎসাহিত করা
মিরাজের ইচ্ছা বাণিজ্যিকভাবে সারা বাংলাদেশে এই খামারের পরিকল্পনা ছড়িয়ে দেওয়া৷ বর্তমানে তাঁর কাছে প্রশিক্ষণ নিয়ে বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গার মানুষ টার্কি ফার্ম গড়ে তুলছেন৷ মিরাজ হোসেন টার্কি বিপ্লব ঘটানোর স্বপ্ন দেখেন৷ বেকারত্ব দূর করার জন্য এটা একটা ভালো উদ্যোগ বলে মনে করেন তিনি৷ প্রতি শুক্রবার তাঁর খামারটি পরিদর্শনে আসেন অনেক উদ্যোক্তা৷
ছবি: Miraz Hossain
13 ছবি1 | 13
২০১২ সালে দক্ষিণ জার্মানির বাডেন-ভ্যুর্টেমব্যার্গ রাজ্য থেকে খবর আসে, মাত্র ২০ শতাংশ খামারের ক্ষেত্রে বর্তমান কৃষিজীবী অবসর নেবার পর কে খামারের ভার নেবেন, তা নিশ্চিত৷ এর পিছনে যে মানবিক ট্র্যাজেডি লুকিয়ে রয়েছে, তা বোঝা যায় গেবহার্ড হাইম ও তাঁর স্ত্রীর কাহিনি থেকে৷ হাইম দম্পতি বোডেনজে হৃদের কাছে একটি পশুপালনের খামার চালাতেন৷ তাঁদের পাঁচ সন্তানের মধ্যে কেউই সেই খামারের ভার নিতে রাজি নন৷ কৃষিকাজ মানে নাকি বড় বেশি পরিশ্রম, বড় কম অবসর, বড় নীচু পারিশ্রমিক৷ কমবয়সিদের তাতে রুচি নেই৷
পূর্বাঞ্চলে
পুনর্মিলনের পর জার্মানির পূর্বাঞ্চলে এই সমস্যা ধীরে ধীরে আরো সঙ্গীন হয়ে দাঁড়ায়, কেননা কমিউনিস্ট পূর্ব জার্মানিতে চাষ করা হতো কৃষি উৎপাদন সমবায়ের ভিত্তিতে, সরকারি পরিভাষায় যার নাম ছিল এলপিজি৷ পুনর্মিলনের পরেও পূর্বাঞ্চলের খামারগুলো অপেক্ষাকৃত বড় আকারের রয়ে গেছে; কর্মচারীরাই এখানে মূলত খামারের কাজ সারেন৷ কাজেই এখানে ‘নাখভুক্স' বলতে বোঝাবে প্রধানত ট্র্যাক্টর-চালক থেকে শুরু করে ইঞ্জিনিয়ার বা খামার ম্যানেজার অবধি সব ধরনের কর্মচারী৷ ওদিকে পূর্ব জার্মানি থেকে তরুণরা পশ্চিমে পালাতে আকুল৷
বুলগেরিয়া কিংবা রাশিয়ার মতো পুবের কৃষিধর্মী দেশ থেকে লোক এনে কৃষি কর্মচারীর অভাব পূরণের আশা আশাই থেকে গেছে৷ এমনকি সিরিয়া বা ইরাক থেকে সম্প্রতি যে সব উদ্বাস্তুরা এসেছেন, তাদের দিয়েও সে অভাব মেটানো যায়নি, কেননা জার্মান কৃষি অনেক বেশি আধুনিক ও প্রযুক্তিনির্ভর; উদ্বাস্তুরা কৃষিকাজ বলতে যা বোঝেন, পশ্চিমের আধুনিক কৃষিকাজের সঙ্গে তার সাদৃশ্য কম৷ কাজেই জার্মানির পূর্বাঞ্চলের খামারগুলিতে আরো বড় আকারের যন্ত্রপাতি ও সর্বাধুনিক প্রযুক্তি নিয়োগ করে পরিস্থিতি সামাল দেবার চেষ্টা করা হয়েছে৷
অরুণ শঙ্কর চৌধুরী, ডয়চে ভেলেছবি: DW/P. Henriksen
আরটিএল টেলিভিশনের একটি প্রোগ্রাম গত কয়েক বছর ধরে জার্মানিকে মাতাচ্ছে; সেটি হলো ‘বাউয়ার্ন সুখ্ট ফ্রাউ', বা ‘চাষি খুঁজছেন সঙ্গিনী'৷ সাথীহীন কৃষিজীবীদের খামারে আসছেন মহিলারা, এই হলো অনুষ্ঠানের কাঠামো৷ জার্মান কৃষিজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি গ্যার্ড সনলাইটনার অনুষ্ঠানটিকে বিশেষভাবে অপছন্দ করতেন৷ তাঁর যুক্তি ছিল, ঐ অনুষ্ঠানে কৃষিজীবীদের স্থূল ও বুদ্ধিহীন হিসেবে দেখানো হয়েছে৷
সনলাইটনার স্মরণ করিয়ে দেন যে, কৃষি হলো বিশ্ব অর্থনীতির প্রাচীনতম অংশগুলির মধ্যে একটি এবং কৃষি চিরকালই থাকবে, এমনকি মোটর গাড়ি নির্মাণ শিল্প অন্তর্হিত হবার পরেও৷ বিশ্বের জনসংখ্যা বাড়ছে, সেই সঙ্গে বাড়ছে খাদ্যের প্রয়োজন৷ জার্মানি আজ বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম খাদ্য রপ্তানিকারক দেশ৷ সেদেশে কৃষিজীবীদের নিয়ে মশকরা?
আপনার কি কিছু বলার আছে? লিখুন নীচের মন্তব্যের ঘরে৷