জার্মানিতে শিশু-কিশোরদের জন্য প্লেগ্রাউন্ড বা খেলার মাঠ আছে এক লাখ ২০ হাজারের মতো৷ নানাপ্রান্তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা এসব খেলার জায়গা শিশুদের অবাধ বিচরণক্ষেত্র৷ খেলাধুলার এই আয়োজনের বিশেষ উদ্দেশ্যও রয়েছে৷ বলছি সে কথা৷
বিজ্ঞাপন
জার্মানিতে বিভিন্ন শহরের অলিগলিতে, পার্কের কিনারে কিংবা বড় বড় ভবনের মাঝখানে ছোট ছোট প্লেগ্রাউন্ড বা শিশুদের খেলার মাঠ দেখতে পাওয়া যায়৷ দোলনা, ঢেঁকি, স্লাইড, স্প্রিং রাইডার, ক্লাইম্বার, ট্রাইটোপিয়া, প্লেহাউসসহ নানা রকম খেলাধুলার উপকরণ থাকে এসব স্থানে৷ আর সেগুলো তৈরি করা হয় বালির উপরে যাতে করে এসব ব্যবহার করতে গিয়ে শিশুরা পড়ে গেলে বেশি ব্যথা না পায়৷ পাশাপাশি বালি দিয়ে খেলার সুযোগতো থাকেই৷
প্লেগ্রাউন্ডগুলোতে শিশু-কিশোররা দিনের বেলা যে-কোনো সময়ই যেতে পারে৷ এগুলো ব্যবহারের জন্য কোনো অনুমতি বা আলাদা খরচ নেই৷ পুরোটাই ফ্রি৷
শিশুদের এই খেলার জায়গাগুলো আপাত দৃষ্টিতে দেখলে কিছুটা অগোছালো মনে হলেও এগুলোর পেছনে সুনির্দিষ্ট কিছু লক্ষ্য থাকে৷ শিশুদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশে ভূমিকা রাখতে এগুলোতে থাকে নানা আয়োজন৷
যেমন ক্লাইম্বার এবং ট্রাইটোপিয়ার মতো আয়োজনগুলো শিশুদের ‘মোটর স্কিল’ বৃদ্ধিতে সহায়তা করে৷ দড়ি কিংবা স্টিলের বিভিন্ন কাঠামো বেয়ে উপরে ওঠা এবং নামার মতো খেলার মাধ্যমে তারা বিভিন্ন ঝুঁকিপূর্ণ কাজের সঙ্গে পরিচিত হয়৷ এতে করে তাদের মানসিক শক্তি বাড়ে যা ভবিষ্যতে ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশে নিজেকে মানিয়ে নিতে সহায়ক হয়৷
অনেক প্লেগ্রাউন্ডে শিশুদের অনেক কিছু গড়ার সুযোগ থাকে৷ তারা নিজেদের মতো করে সেগুলো নিয়ে খেলতে পারে৷ কিছু গ্রাউন্ডে শুধু শিশুদের প্রবেশের সুযোগ দেয়া হয় যাতে তারা অভিভাবকদের কাছ থেকে দূরে থেকে নিজেদের মতো করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারে৷
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, জার্মানির প্লেগ্রাউন্ডগুলোতে শিশুদেরকে ইচ্ছাকৃতভাবেই মুক্ত পরিবেশে কিছুটা ঝুঁকিপূর্ণ কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত হওয়ার সুযোগ করে দেয়া হয়েছে৷ কেননা এটা তাদের শারীরিক ও মানসিক বৃদ্ধি এবং ঝুঁকিপূর্ণ বিভিন্ন পরিস্থিতির সঙ্গে পরিচিত হতে সহায়তা করবে৷
কেউ কেউ বলতে পারেন, শিশুরা ক্লাইম্বার বা ট্রাইটোপিয়া টাওয়ার ব্যবহার করতে গিয়ে আহত হওয়ার মতো পরিস্থিতি কি তৈরি হতে পারে না? হ্যাঁ, সেই ঝুঁকি কিছুটা রয়েছে৷ তবে শিশুদের যেসব খেলার উপকরণ প্লেগ্রাউন্ডে রাখা হয়, সেগুলো ট্যুভ নামক একটি মান যাচাই সংস্থার সনদপ্রাপ্ত হতে হয়৷ এই একই সংস্থা জার্মানির রাস্তায় কোন গাড়ি চলার উপযুক্ত এবং কোনটি উপযুক্ত নয় তা নির্ধারণ করে৷
খেলার উপকরণগুলো তৈরির ক্ষেত্রে শিশুদের দুর্ঘটনার ঝুঁকি যতটা সম্ভব যাতে কম থাকে সেটা নিশ্চিত করা হয়৷ তা না হলে সেগুলো ট্যুভের অনুমোদন পাবে না৷ যেমন ট্রাইটোপিয়া টাওয়ারে নানা স্তর থাকে যাতে করে বেশ কয়েক মিটার উপর থেকে একটি শিশু সরাসরি নীচে না পড়ে যায়৷ আর কিছু উপকরণ বা খেলার স্থাপনা ব্যবহারের সময় শিশুদের সাইকেল চালানোর হেলমেট ব্যবহারের পরামর্শ দেয়া হয়৷
জার্মানির এই প্লেগাউন্ডগুলোর চাহিদা এবং প্রয়োজনীয়তা ক্রমশ বেড়েই চলেছে৷ এমনকি যুক্তরাজ্য এবং যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশগুলোতেও জার্মানির আদলে শিশুকিশোরদের জন্য প্লেগ্রাউন্ড তৈরি করা হচ্ছে৷ কথা হচ্ছে, আমাদের দেশে শিশু-কিশোরদের জন্যও এরকম প্লেগ্রাউন্ড তৈরি কি অসম্ভব ব্যাপার?
ঢাকার মাঠের হালচাল
ঢাকায় খেলাধুলা করার মতো মাঠের অভাব রয়েছে৷ যেগুলো আছে তার মধ্যে অনেকগুলোও খেলাধুলার উপযোগী নয়৷
ছবি: DW
খামারবাড়ি টিঅ্যাণ্ডটি খেলার মাঠ
জাতীয় সংসদ ভবনের দক্ষিণ পূর্ব পাশে এই মাঠটি ইন্দিরা রোড ক্রিকেট অ্যাকাডেমির মাঠ হিসেবেও পরিচিত৷ দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ২৭ নম্বর ওয়ার্ডে এটি একমাত্র মাঠ৷ আগে এই মাঠে বিভিন্ন সময়ে মেলার আয়োজন হতো৷ তবে ২০১৯ সালের পর এ মাঠে মেলা আয়োজন বন্ধ করে দেওয়া হয়৷
ছবি: DW
ধূপখোলা মাঠ
পুরান ঢাকার ঐতিহ্যবাহী মাঠ৷ এটি ঢাকার ভেতরে আবাসিক এলাকাগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড় মাঠ৷ কোরবানির গরুর হাট, বৈশাখী মেলা থেকে শুরু করে নানা সামাজিক সাংস্কৃতিক কাজেরও কেন্দ্রবিন্দু ছিল এটি৷ বড় বড় খেলার টুর্নামেন্ট আয়োজন হতো সেখানে৷ সম্প্রতি পুরো মাঠে উন্নয়ন কাঠামো বানানো হচ্ছে৷ এর অবস্থা অনেকটা পুরান ঢাকার পাকিস্তান মাঠ কিংবা ধলপুরের গোলাপবাগ মাঠের মতো হবে বলে আশঙ্কা করছেন এলাকাবাসী৷
ছবি: DW
বুলবুলের স্মৃতিবিজড়িত এলবার্ট মাঠ
পুরান ঢাকার গেণ্ডারিয়ার একটি ছোট মাঠের নাম এলবার্ট মাঠ৷ এলাকাবাসী জানায় এটি মূলত এলবার্ট নামে এক বিদেশির জায়গা ছিল, যার মালিকানা নিয়ে বহু বছর ধরে জটিলতা চলছে৷ তবে ১৯৯০ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত এটি পাড়ার ছেলেমেয়েদের খেলার জায়গা হিসেবেই পরিচিত ছিল৷ ধীরে ধীরে ময়লা আবর্জনা ফেলে, টং দোকান তুলে এটি দখলের চেষ্টা করা হচ্ছে৷ এই মাঠের কাছে বাড়ি ছিল সাবেক ক্রিকেটার আমিনুল ইসলাম বুলবুলের৷ তিনি ঐ মাঠে খেলেছেন৷
ছবি: DW
ধলপুর বা গোলাপবাগ মাঠ
ধলপুর মাঠ একই সাথে গোলাপবাগ মাঠ নামেও পরিচিত৷ আধুনিকায়নের ফলে এ মাঠে এখন শিশু-কিশোররা প্রবেশে বাধা পাচ্ছে৷ কর্তৃপক্ষের অনুমতি ব্যতীত তারা প্রবেশ করতে পারে না৷ ফলে অনেক শিশু-কিশোর সীমানা প্রাচীর পেরিয়ে মাঠে প্রবেশ করে৷
ছবি: DW
বাঁশবাড়ি সোনালী সংঘ খেলার মাঠ
মোহাম্মদপুরের সোনালী সংঘ মাঠ আধুনিকায়নের জন্য বন্ধ রয়েছে৷ তাই এলাকাবাসীরা মাঠে যেতে পারছেন না৷
ছবি: DW
মাঠের জায়গায় তৈরি হচ্ছে মার্কেট
পুরান ঢাকার ধূপখোলা মাঠে উন্নয়ন কাজ চলতে থাকায় প্রায় আট মাস ধরে খেলার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন স্থানীয় শিশু-কিশোরেরা৷ এ মাঠের একপাশে পাঁচতলা ভবন নির্মাণ করছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন৷ কাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত মাঠ উন্মুক্ত করা হচ্ছে না৷
ছবি: DW
খেলার জন্য মাঠ, নাকি মেলার জন্য!
শ্যামলী ক্লাব মাঠে প্রায় এক মাস ধরে তাঁত ও বস্ত্র মেলা চলছে৷ তাই মাঠে এখন খেলাধুলা বন্ধ রয়েছে৷ স্থানীয় লোকজন হাঁটাচলা করতো, তাও এখন বন্ধ৷ প্রতি রমজান মাসে মাঠে মেলা অনুষ্ঠিত হয়৷
ছবি: DW
মাঠ নয়, যেন ময়লার বাগাড়
পল্টন আউটারে মাঠের এক পাশে ময়লার স্তুপ৷ এখানে খেলাধুলা করার কথা থাকলেও আবর্জনার স্তূপের কারণে অসুবিধায় পড়ছেন আগত খেলোয়াড়েরা৷
ছবি: DW
কবে খেলবে এই মাঠে?
প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য প্রস্তাবিত খেলার এই মাঠে পথচারীরা দীর্ঘদিন ধরে এই সাইনবোর্ডটি দেখে গেলেও এর কোনো অগ্রগতি দেখছে না৷
ছবি: DW
মাঠের একাংশ যেন বস্তি
আড়ং মাঠ অথবা লালমাটিয়া মাঠ - এই দুই নামে এই মাঠটিকে এলাকাবাসী চেনে৷ এই মাঠের একাংশ যেন বস্তি হয়ে উঠেছে৷ অন্য অংশে গাড়ি পার্কিং আর চায়ের দোকান৷ ফলে এই মাঠে শিশু-কিশোরের খেলা বাধাগ্রস্ত হচ্ছে৷
ছবি: DW
আধুনিকায়নের ফলে খেলাধুলার সুযোগ বঞ্চিত
শ্যামলী ক্লাব মাঠের আধুনিকায়ন হলেও খেলার সুযোগ নেই৷ কারণ কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া সেখানে খেলার সুযোগ নেই৷
ছবি: DW
সফল প্রতিবাদ
কলাবাগান আবাসিক এলাকার (পান্থপথের দক্ষিণ পাশে) তেঁতুলতলা মাঠে পুলিশ কলাবাগান থানা নির্মাণের জন্য বরাদ্দ নিয়েছিল৷ উদীচীর কর্মী সৈয়দা রত্নার নেতৃত্ব স্থানীয় বাসিন্দারা এর প্রতিবাদ করেছেন৷ গত রোববার রত্না ও তার ছেলেকে ধরে থানায় নিয়ে যাওয়া হয়েছিল৷ সমালোচনা হলে ১৩ ঘণ্টা পর মুচলেকা নিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়৷ এরপর বৃহস্পতিবার ঐ মাঠে থানা ভবন না করে সেটি খেলার জন্য রাখার নির্দেশ দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা৷