নারীদের সৌন্দর্য প্রতিযোগিতা নিয়ে নানা তর্ক বিতর্ক রয়েছে৷ কিন্তু গরুর সৌন্দর্য বিচার করার কথা জানা আছে কি? জার্মানিতে এমন একটি প্রতিযোগিতায় অনেক গরু তাদের রূপ ও গুণের স্বীকৃতি পেয়ে থাকে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/M. Assanimoghaddam
বিজ্ঞাপন
জার্মানির লোয়ার স্যাক্সনি রাজ্যে গরুর রূপগুণ বিচার করতে অভিনব এক প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়৷ মূল প্রতিযোগিতার পাশাপাশি থাকে আরও অনেক কার্যকলাপ৷ যেমন গরুর ছবির শুটিং৷ একটি গরুর মুখচ্ছবিতে কৌতূহলের অভিব্যক্তি আনতে একটি বল ব্যবহার করা হচ্ছে৷ তার নাম আফ্রিকা৷ তার প্রজননকারী ইয়াসিন গরুর ক্ষমতা ও সৌন্দর্যের জন্য পুরস্কার পেয়েছেন৷ সেই গরুর আলাদা খাদ্য তালিকাও রয়েছে৷ তিনি বলেন, ‘‘ডেয়ারবোফেন গরু প্রজনন কেন্দ্রের জন্য আমরা তিন সপ্তাহের খাদ্যের প্রস্তুতি নিয়েছি৷ অর্থাৎ গরুকে শুধু খড় খাওয়ানো হবে৷ সাধারণত তারা সিলাজ খায়৷ গরুর অনেক সংখ্যায় ও চওড়া পাঁজর থাকা উচিত, শরীরে গভীরতা থাকা উচিত৷ খড়ের নিজস্ব কাঠামো থাকায় শরীরের কাঠামো ও গভীরতা পরিবর্তন করা সম্ভব৷''
মঞ্চের আড়ালে স্টিভ ম্যাকলাউলিন গরুর সৌন্দর্য বাড়াতে ব্যস্ত৷ নারীর সৌন্দর্য প্রতিযোগিতার মতো এ ক্ষেত্রেও বিশেষজ্ঞদের আনা হয়৷ যেমন আয়ারল্যান্ড থেকে স্টিভ ম্যাকলাউলিন নামে গরুর স্টাইলিস্ট এসেছেন৷ তিনি বলেন, ‘‘জেল দিয়ে বাঁট উজ্জ্বল করে তোলা হয়৷ ফলে রিং-এ নিয়ে গেলে গরুকে অনেক স্বাভাবিক দেখায়, বিচারকরাও ভালোভাবে দেখতে পান৷''
সৌন্দর্য প্রতিযোগিতায় গরু
05:21
This browser does not support the video element.
মঞ্চে প্রবেশের আগে টিমের হাতে মাত্র কয়েক মিনিট সময় রয়েছে৷ জার্মানিতে গরুদের সবচেয়ে বড় সৌন্দর্য প্রতিযোগিতায় ১০০ জনেরও বেশি প্রজননকারী যোগ দিয়েছেন৷ গোটা দেশে সবচেয়ে আদর্শ গরু কার কাছে আছে?
সৌন্দর্যের সংজ্ঞা
বিচারকদের কাছে শারীরিক গঠন, দীর্ঘ আয়ু ও দুধ দেবার ক্ষমতা জরুরি বিষয়৷ বয়স্ক ও কমবয়সি গরুর মূল্যও আলাদা৷ ২৪ নম্বর প্রজননকারী একটি পুরস্কার পেয়েছেন৷ ভালো প্রজননের মানদণ্ড কী? কৃষি ইঞ্জিনিয়ার আনিটা লুকাসসেন বলেন, ‘‘গরুর শারীরিক গঠন ভালো হতে হবে, অনেক খাদ্য খাওয়ার জন্য পেট যথেষ্ট গভীর হওয়া চাই, পাঁজর শক্ত হওয়া চাই৷ বাঁট মজবুত হতে হবে, গোড়ালি থেকে অনেক উপরে থাকতে হবে৷ যতটা সম্ভব দীর্ঘ সময় ধরে গরুকে অনেক দুধ উৎপাদন করতে হবে৷''
এক্ষেত্রে শুধু সৌন্দর্য নয়, মুনাফাও জরুরি বিষয়৷ প্রাণীগুলিকে সর্বোচ্চ ক্ষমতার জন্য প্রস্তুত করা হয়৷ অবিশ্বাস্য মনে হলেও এমন গরু দিনে ৪০ লিটার দুধ উৎপাদন করতে পারে৷ তারা যাতে নিজেদের বাঁটের ভারে কাবু না হয়ে পড়ে, তা নিশ্চিত করতে প্রজননকারীদের গরুর শারীরিক গঠনের প্রতি মনোযোগ দিতে হয়৷ গরুর দীর্ঘ আয়ু নিশ্চিত করা প্রয়োজন৷ আনিটা বলেন, ‘‘ব্রিডিং-এর ব্যয় অত্যন্ত বেশি৷ প্রথম বাছুরের জন্ম পর্যন্ত গরুপ্রতি দেড় থেকে দুই হাজার ইউরো ব্যয় হতে পারে৷ তখনই প্রথম দুধ বেচে আয় করা সম্ভব হয়৷ বাছুরও বিক্রি করা যায়৷''
শিল্পোন্নত দেশগুলোতে বর্তমানে ‘ভেগানিজম’ জনপ্রিয় হয়ে উঠছে৷ ভেগানরা পরিবেশের কথা মাথায় রেখেই মাংস বা পশু থেকে উৎপাদিত কোনো খাবার খান না৷ কিন্তু আসলে মাংস উৎপাদন এবং ভক্ষণ পৃথিবীর জন্য কতটা খারাপ?
ছবি: picture-alliance/dpa/I. Wagner
শিল্পোন্নত দেশের মানুষ বেশি মাংস খায়
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা জানিয়েছে, ২০১৫ সালে বিশ্বের প্রতিটি মানুষ (মাথাপিছু) গড়ে মাংস খেয়েছে ৪১.৩ কেজি৷ অথচ ৫০ বছর আগে এর অর্ধেক মাংস খাওয়া হতো৷ গত বছর উন্নয়নশীল দেশে যেখানে মাথাপিছু ৩১.৬ কেজি মাংস খাওয়া হয়েছে, শিল্পোন্নত দেশে খাওয়া হয়েছে ৯৫.৭ কিলোগ্রাম৷
ছবি: China Photos/Getty Images
উৎপাদনে পানি খরচ
মাংস উৎপাদন একটি ব্যয়বহুল ব্যবসা৷ এতে অর্থ, সময় ও সম্পদ খরচ হয়৷ এক কেজি গরুর মাংস উৎপাদনে ১৫,৪১৫ লিটার পানি লাগে৷ এক কেজি শুকরের মাংস উৎপাদনে লাগে ৬ হাজার লিটার পানি৷ অন্যদিকে সবজি, যেমন আলু উৎপাদনে ১ কেজিতে খরচ হয় ৩০০ লিটার পানি৷ অন্যদিকে ধান উৎপাদনে প্রতি কেজিতে খরচ হয় ২,৫০০ লিটার পানি৷
ছবি: picture-alliance/dpa/P.Pleul
গরু ও মুরগির খাদ্য
ওয়ার্ল্ড ওয়াচ ইনস্টিটিউটের মতে, বিশ্বের উৎপাদিত প্রতি ৫ টন শস্যের মধ্যে ২ টন পোলট্রি বা মাছের খামারে যায়৷ অন্যদিকে, গুরুর মাংস উৎপাদনের জন্য এত খাদ্য ব্যয় হয় না৷ ঘাস খেয়েই এদের অনেকটা চাহিদা পূরণ হয়৷
ছবি: Norberto Duarte/AFP/Getty Images
উজাড় হচ্ছে বন
প্রাণী খাদ্যের জন্য বন উজাড় হচ্ছে সবচেয়ে বেশি৷ গাছ কেটে গরু চারণ ক্ষেত্র বা কৃষিক্ষেত্র বাড়ানো হচ্ছে৷ ফলে জীববৈচিত্র হারিয়ে যাচ্ছে৷ সেই সাথে বৃদ্ধি পাচ্ছে বৈশ্বিক উষ্ণতা৷
ছবি: Kate Evans / Center for International Forestry Research (CIFOR)
বিষাক্ত মিথেন
কার্বন নিঃসরণে কৃষির ভূমিকা রয়েছে ১১ থেকে ১৫ ভাগ৷ অন্যদিকে, গরুর ঢেঁকুর বা ‘গ্যাস’ থেকে যে মিথেন উৎপন্ন হয়, তা কার্বন ডাই অক্সাইডের চেয়ে ২০ গুণ বিষাক্ত ও ক্ষতিকর৷
ছবি: DW/C.Lomas
5 ছবি1 | 5
দর্শকদের আসনে কৌতূহলী মানুষ, চাষি ও প্রজননকারীদের দেখা যায়৷ একজন জানালেন,সুন্দর গরু দেখতে তাঁর দারুণ লাগে৷ তাঁর নিজেরই প্রায় ১০টি গরু রয়েছে৷ তিনি নিজেও একজন প্রজননকারী৷
গরুদের ‘অহংবোধ'
সবসময়ে আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকার অন্য প্রভাবও রয়েছে৷ মালিকদের মতে, কিছু গরুর নিজস্ব অহংবোধ দেখা যায়৷ কারণ নিজেদের গোয়ালেও তারা বাড়তি খাতির পায়৷ প্রজননকারী হিসেবে আন কাটরিন মায়ার বলেন, ‘‘এই গরু কিছু জানতে চাইলে কানদুটি সামনে মেলে দেয়, এখন যেমনটা করছে৷ তারপর মন দিয়ে দেখে৷ সে নিজেকে তারকার মতো মনে করে৷ গোয়ালে এমন আচরণ আরও বেশি লক্ষ্য করা যায়৷ গরুটি মানুষের বড় ন্যাওটা, সহজেই সবার কাছে যায়৷ সবার কাছে আদর চায়৷''
অনেক গরুই পুরস্কার পেয়েছে৷ তবে তাদের মধ্যে কোনটি সেরা গরুর স্বীকৃতি পাবে? ১১ বছর বয়স ও সাতবার মা হওয়া সত্ত্বেও ‘লেডি গাগা নামের গরুটি বেশ কয়েকবার প্রতিযোগিতায় জিতেছে৷
সেরা গরু-সুন্দরী ‘লেডি গাগা’!
সেরা সুন্দরীদের মেলা বসেছিল জার্মানিতে৷ মানুষ নয়, সুন্দর সুন্দর গরুদের মেলা৷ সেখান থেকে বেছে নেয়া হয়েছে সেরা সুন্দরী৷ সেই সুন্দরীর নাম জানেন? ‘ল্যাডি গাগা’!
ছবি: picture-alliance/dpa/F. Gentsch
বাছাই পর্বে ২০ লাখ প্রতিযোগী!
প্রতিযোগিতার নাম ‘হলস্টাইন শো’৷ ফাইনালের আগে ছিল হাড্ডাহাড্ডি প্রতিযোগিতাপূর্ণ বাছাই পর্ব৷ জার্মানি আর লুক্সেমবুর্গের অন্তত ২০ লাখ সুন্দরী, স্বাস্থ্যবতী গরু অংশ নিয়েছে সেই পর্বে৷ ২০ লক্ষ থেকে ‘গ্র্যান্ড চ্যাম্পিয়ন’ হবার আশা নিয়ে ফাইনালে উঠেছিল মাত্র দু’শ সুন্দরী৷
ছবি: picture-alliance/dpa/I. Wagner
‘সাইজ জিরো’ নয়, ডাবল এক্সএল
মানবীদের বিশ্ব সুন্দরী প্রতিযোগিতার মতো ‘হলস্টার শো’-তে কোনো প্রতিযোগী জিরো ফিগার নিয়ে এলে বাছাই পর্বেও নাম লেখাতে পারবে না৷ বিচারকরা এমন সব গরুই বেছে নিয়েছেন যাদের দু’জোড়া শক্ত পায়ের ওপর রয়েছে সবল, সুদৃঢ় কাঠামো এবং যাদের দুধের বাণও বেশ বড়৷ তেমন প্রতিযোগীই ছিল বেশি৷ জার্মানি আর লুক্সেমবুর্গের গরুরা গড়ে প্রতিদিন ২৫ কেজি ঘাস এবং অন্যান্য খাবার খায়৷ এত খেলে কেউ মোটা-তাজা না হয়ে পারে!
ছবি: picture-alliance/dpa/I. Wagner
সুন্দরীদের সাজগোজ
গরু সুন্দরীদের সাজগোজের জন্য ছিল ব্যাপক আয়োজন৷ শীতপ্রধান দেশ বলে গরুদের গায়ের রোম অনেক বড় বড় হয়৷ মাথার পাশে অনেক গরুর এমন ঘন, দীর্ঘ রোম থাকে যে তাদের ‘সুকেশিনী’ বলা যায় নির্দ্বিধায়৷ তাদের চুল কাটার জন্য ছিল বিশেষ সেলুন৷ পাঁজর আর দুধের বাটে মাখানোর জন্য ছিল বেবি অয়েল৷ চুল রং করানোর জন্যও ছিল বিশেষ ব্যবস্থা৷
ছবি: picture-alliance/dpa/M. Hibbeler
ক্যাটওয়াক!
বিশ্ববিখ্যাত মডেলদের মতো ক্যাটওয়াকেও অংশ নিয়েছে গরু-সুন্দরীরা৷ কান খাড়া করে, নিতম্বটা একটু যৌনাবেদনময়ীর ভঙ্গিতে তুলে সামনের দিকে সতর্ক দৃষ্টি রেখে আত্মবিশ্বাসী পদক্ষেপে যারা এগিয়ে যেতে পেরেছে, তাদেরই ‘ফুল মার্কস’ দিয়েছেন বিচারকরা!
ছবি: picture-alliance/dpa/M. Hibbeler
সাফল্যের মূল মন্ত্র
প্রশিক্ষকরা প্রতিযোগীদের পই পই করে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, ‘‘পরিমিত খাবে এবং ঘুমাবে৷ শরীর কখনো নোংরা করবে না৷’’ প্রতিদিন শাওয়ারের নীচে দাঁড়াতে হতো প্রতিযোগীদের৷ চার পায়ের খুরও পরিষ্কার করা হতো প্রতিদিন৷ বিশ্রাম নিতে হতো বাঁধা সময় মেনে৷ এ সব সু-অভ্যাস রপ্ত করে তবেই সবাই ফাইনালে হাজির হয়েছিল বিচারকদের প্যানেলের সামনে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/I. Wagner
সুন্দরীরা নিলামে!
হলস্টাইন গরুদের জার্মানি, লুক্সেমবুর্গসহ ইউরোপের এ অঞ্চলে অনেক কদর৷ দুধ দেয়া গরুদের মধ্যে এই হলস্টাইন গরুই সবচেয়ে বেশি আছে এ অঞ্চলে৷ এমন গরুর ক্রেতার অভাব নেই৷ এ প্রতিযোগিতায় অনেক কৃ্ষকই এসেছিলেন রথ দেখার পাশাপাশি কলাও বেচার লক্ষ্য নিয়ে৷ অর্থাৎ সুন্দরী গরুটা যখন প্রতিযোগিতার জন্য নিজেকে তৈরি করছে, তখনও ক্রেতা খুঁজেছেন গরুর মালিক৷ নিলাম হয়েছে এবং সেই নিলামে বিক্রিও হয়েছে অনেক ‘সুন্দরী’!
ছবি: picture-alliance/dpa/M. Hibbeler
এবং এবারের বিজয়িনী....
জার্মানি আর লুক্সেমবুর্গের গরু সমাজে সবচেয়ে সুন্দরী কে? দু’বছরের জন্য এ প্রশ্নের উত্তর সবার জানা হয়ে গেছে৷ আট বছর বয়সি ‘সুন্দরী’ লেডি গাগা জিতে নিয়েছে এবারের ‘হলস্টাইন শো’৷ পপস্টার ‘লেডি গাগা’-র নামে নাম রাখার পর এবার তাদের প্রিয় গরুটি সেরার স্বীকৃতিও পেল৷ কৃষক হেনরিক ভিলে সত্যিই ভীষণ গর্বিত৷