কিন্তু মিলের ওখানেই শেষ৷ যুদ্ধোত্তর জার্মানির শিক্ষাব্যবস্থা আসলে তার সমাজব্যবস্থা, তার রাজনৈতিক ব্যবস্থা ও তার অর্থনৈতিক সাফল্যের ভিত্তি৷ যে কারণে জার্মানরা বিষয়টিকে এত গুরুত্ব দেন৷
বিজ্ঞাপন
জার্মানিতে রাজনীতি অথবা রাজনৈতিক দলগুলি সম্পর্কে আলোচনা উঠলেই কোনো না কোনো পর্যায়ে যে শব্দটি এসে পড়বে, সেটি হলো ‘বিল্ডুংসপলিটিক'৷ ‘বিল্ডুং' বলতে বোঝায় শিক্ষা৷ কাজেই ‘বিল্ডুংসপলিটিক' কথাটির অর্থ দাঁড়াচ্ছে শিক্ষানীতি বা শিক্ষাসংক্রান্ত নীতি৷ লাল, কালো হলদে কিংবা সবুজ – পক্ষান্তরে সামাজিক গণতন্ত্রী, খ্রিষ্টীয় গণতন্ত্রী, উদারপন্থি কিংবা পরিবেশবাদী – সব দলেরই শিক্ষাব্যবস্থার পরিস্থিতি, পরিবর্তন, পরিশোধন বা প্রয়োজনীয় সংস্কার সম্পর্কে একটা স্পষ্ট ধারণা থাকা চাই৷
যেমন মুক্ত গণতন্ত্রী এফডিপি দল চিরকালই দাবি করে আসছে যে, তারা ‘বিল্ডুং' বা শিক্ষা ব্যাপারটা অন্যান্য দলের চেয়ে ভালো বোঝে৷ সামাজিক গণতন্ত্রীরা শ্রমিক শ্রেণির কল্যাণে ‘এলিটিস্ট', অর্থাৎ অভিজাত কিংবা বাছাই কিংবা ‘উঁচুদরের' শিক্ষা প্রতিষ্টানগুলির বিরোধী; তারা চায় সকল শ্রেণির ছেলে-মেয়েদের জন্য সমান সুযোগ৷ সবুজরা চায় কর্তৃত্ববিহীন, কম শাসনের শিক্ষা পদ্ধতি; খ্রিষ্টীয় গণতন্ত্রীরা স্বভাবতই আরেকটু বেশি শৃঙ্খলা ও পড়ার চাপ৷ উদারপন্থিদের বাছাই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বা প্রতিভাধর ছাত্র-ছাত্রীদের বিশেষ সুযোগ-সুবিধা দিতে কোনো আপত্তি নেই৷
জার্মানিতে পড়তে আসার আগে যা যা জানা প্রয়োজন
প্রতি বছর বিপুল সংখ্যক বিদেশি শিক্ষার্থী জার্মানিতে উচ্চশিক্ষা নিতে আসেন৷ জার্মানিতে কম খরচে উচ্চমানের শিক্ষা পাওয়া যায়৷ তবে জার্মানির উদ্দেশ্যে বিমানে চড়ার আগে শিক্ষার্থীদের কিছু বিষয় জেনে রাখা প্রয়োজন৷ পড়ে নিন সেগুলো৷
ছবি: DW
টিউশন ফি নেই, তবে
জার্মানির ১৬টি রাজ্যের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে কোনো টিউশন ফি নেই৷ এটা সত্য৷ তবে এক্ষেত্রে শর্ত প্রযোজ্য৷ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় সুনির্দিষ্ট ডিগ্রি প্রোগ্রামে আবেদন করলে বিনা খরচায় পড়ার সুযোগ আছে৷ সেক্ষেত্রে স্থানীয়রা যেসব শর্ত মনে লেখাপড়া করে, বিদেশিদেরও সেগুলো মানতে হবে৷ ‘স্টাডি এবরোড’ প্রোগ্রাম এবং প্রাইভেট ইন্সটিটিউটে পড়াশোনা ফ্রি নয়৷
ছবি: Fotolia/Janina Dierks
বেশি কাজের মানসিকতায় লাগাম টানুন
একজন বিদেশি শিক্ষার্থী হিসেবে পড়ালেখার ফাঁকে আপনি কতটা কাজ করতে পারবেন, সেটা নির্ধারণ করে দেয়া থাকে৷ ইউরোপীয় ইউনিয়ন বা ইইউ-র কোনো দেশের পাসপোর্টধারী নয়, এমন শিক্ষার্থীরা বছরে ১২০ দিন পূর্ণদিবস কিংবা ২৪০ দিন অর্ধদিবস কাজ করতে পারেন৷ এছাড়া সেমিস্টার চলাকালে সপ্তাহে ২০ ঘণ্টার বেশি কাজ করা যাবে না৷ ভালো কথা, গোপনে বাড়তি কাজের চেষ্টা করবেন না৷ ধরা পড়লে বড় সমস্যা হতে পারে৷
ছবি: Fotolia/MNStudio
যথাযথভাবে অনুদানের আবেদন করুন
আশার কথা হচ্ছে, বিদেশি শিক্ষার্থীদের জন্য বিভিন্ন অনুদান এবং ফেলোশিপের ব্যবস্থা রয়েছে জার্মানিতে৷ আপনার বিষয় যাই হোক না কেন, আপনি যদি তাতে মেধাবী হন এবং উচ্চশিক্ষার জন্য পরিশ্রমে আগ্রহী হন, তাহলে অনুদানের জন্য আবেদন করতে পারেন৷ ‘জার্মান অ্যাকাডেমিক এক্সচেঞ্জ সার্ভিস’ বা ডিএএডি এক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি সহায়তা করে থাকে৷ তবে অনুদানের আবেদন প্রফেশনালদের মতো হওয়া চাই৷
ছবি: DW
ভিসা জটিলতা
উন্নয়নশীল দেশগুলোর শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে জার্মানিতে পড়তে আসার ভিসা পাওয়া একটু জটিল৷ তাঁদের বেশকিছুদিন সময় হাতে রেখে ভিসার আবেদন করতে হয়৷ আর জার্মানিতে আসার পর মাঝেমাঝেই যেতে হয় ‘আউসলান্ডারবেহ্যোর্ডে’ বা বিদেশিদের জন্য নির্ধারিত সরকারি কার্যালয়ে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
সব কিছুর কপি রাখুন
জার্মানিতে আসার পর আপনি নিয়মিতই বিভিন্ন চিঠি পাবেন৷ এমনকি কবে কবে বাড়ির সামনে কোন কোন ধরনের ময়লা রাখা যাবে, সেটাও জানবেন চিঠির মাধ্যমে৷ বুদ্ধিমানের কাজ হবে সব চিঠি জমা করে রাখা৷ তবে প্রয়োজন অনুযায়ী উত্তর দিতে ভুল করবেন না যেন৷ জার্মানিতে বসবাসের এক বিরক্তিকর দিক হচ্ছে দেশটির জটিল আমলাতান্ত্রিক প্রক্রিয়া৷ সেই প্রক্রিয়ার অংশ এ সব চিঠি৷
ছবি: picture-alliance/dpa
জার্মান বলতে পারলে অনেক সুবিধা
এটাও সত্য, জার্মানির বড় শহরগুলোতে জার্মান না জেনেও বসবাস করা য়ায়৷ এছাড়া বেশ কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন ইংরেজিতে পড়ালেখার সুযোগ রয়েছে৷ তবে কিছুটা জার্মান ভাষা শিখতে পারলে দেশটিতে জীবনযাপন অনেক সহজ হয়ে যাবে৷ আর আপনি যদি পড়ালেখা শেষে জার্মানিতে চাকুরি করতে চান, তাহলে ভাষা জানাটা অনেক জরুরী৷ এক্ষেত্রে ডয়চে ভেলের জার্মান ভাষা শিক্ষা কোর্স আপনাকে সহায়তা করতে পারে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
নিজেকে নিজেরই সহায়তা করতে হবে
যুক্তরাষ্ট্রের প্রাইভেট কলেজগুলো ব্যয়বহুল হলেও শিক্ষার্থীদের অনেক খেয়াল রাখেন৷ শিক্ষার্থী কোনো ক্লাস ক্রমাগত মিস করে গেলে তাকে তা জানানো হয়৷ ক্যাম্পাসে কখন, কোন প্রোগ্রাম হচ্ছে তাও সুনির্দিষ্টবাবে শিক্ষার্থীদের জানাতে উদ্যোগ আছে৷ জার্মান বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম৷ কখন, কোথায় কেন ক্লাস হচ্ছে কিংবা কোন প্রোগ্রাম চলছে তার খোঁজ রাখার দায়িত্ব আপনার৷
ছবি: DW
জার্মানদের সঙ্গে থাকুন
জার্মানির বড় বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বিদেশি শিক্ষার্থীদের আবাসনের ব্যবস্থা করে থাকে৷ তবে তাদের সেবা নেয়া বাধ্যতামূলক নয়৷ অনেক সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের বেছে দেয়া অ্যাপার্টমেন্ট শিক্ষার্থীর পছন্দ হয় না৷ আশার কথা হচ্ছে, অনেক ওয়েবসাইট রয়েছে যেগুলো থেকে থাকার জায়গা বেছে নেয়া যায়৷ কাজটা কঠিন৷ তবে চেষ্টা করবেন এমন জায়গায় থাকার যেখানে জার্মান শিক্ষার্থীরা থাকেন৷ তখন ভাষা শেখাটা আপনার জন্য সহজ হবে৷
ছবি: Fotolia
আপনি একা নন
শিক্ষার্থী হিসেবে জার্মানিতে বসবাস শুরুর দিকে অনেক কঠিন মনে হতে পারে৷ মনে হতে পারে আপনি একাই বুঝি এত পরিশ্রম করছেন৷ তবে বাস্তবতা হচ্ছে, আপনার আগেও অনেক আপনার মতোই পরিশ্রম করে জার্মানিতে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করেছেন৷ তাই নিজের সমস্যা নিজেই সমাধান করতে শিখুন৷ এ জন্য বিভিন্ন অনলাইন ফোরামের সহায়তা নিতে পারেন৷
ছবি: Fotolia/Amir Kaljikovic
থাকবেন, নাকি চলে যাবেন?
শুরুর দিকে জার্মানিতে বসবাস কঠিন মনে হলেও দেশটি ক্রমশ আপনার ভালো লাগতে শুরু করতে পারে৷ অনেকের ক্ষেত্রে এমন হয়েছে৷ ডিগ্রি, চাকুরি আর নিরাপদ জীবন - এসব বিবেচনা করে আপনি হয়ত একসময় জার্মানিতে থেকে যেতে চাইবেন৷ কিংবা থাকবেন নাকি চলে যাবেন সেই দ্বিধায় পড়ে যাবেন৷ সিদ্ধান্ত নেয়ার দায়িত্ব আপনার, আমরা শুধু আপনাকে আগেভাবে জানিয়ে রাখলাম৷
ছবি: Fotolia/pressmaster
10 ছবি1 | 10
একটু সহজ করে বলা হলেও, এ থেকে বুঝতে পারা উচিত যে, জার্মানিতে শিক্ষা নীতির গুরুত্ব ঠিক কতটা৷ ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিয়েই, যুদ্ধপরবর্তী জার্মান ফেডারাল প্রজাতন্ত্রে শিক্ষাব্যবস্থার দায়িত্ব প্রধানত রাজ্যগুলির উপর ন্যস্ত করা হয়েছে, ফেডারাল সরকারের হাতে রাখা হয়নি৷ কিন্ডারগার্টেন পর্যায়ের পর ছেলে-মেয়েদের স্কুলে যাওয়া ও পাঠানোটা বাধ্যতামূলক৷ সেকেন্ডারি এডুকেশন পর্যায়ে পাঁচ রকমের স্কুলের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে, সমাজের সব শ্রেণির ছেলে-মেয়ের কথা ভেবে৷ তাদের মধ্যে প্রথমেই আসছে গিমনাজিয়ুম বা গ্রামার স্কুল, হাইস্কুলও বলা যেতে পারে, সেই সঙ্গে হায়ার সেকেন্ডারি যোগ করে৷
গিমনাজিয়ুমে আগে শেষ হতো ১৩ বছর পড়াশুনো করার পর – বলতে কি, গিমনাজিয়ুমের শেষে যে ‘আবিটুর' পরীক্ষা হয়, বিদেশে তা ব্যাচেলর বা স্নাতক ডিগ্রির সমমানের বলে গণ্য করা হতো৷ সে তুলনায় ‘রেয়ালশুলে'-র ছাত্র-ছাত্রীরা দশ বছরের মধ্যে স্কুল শেষ করে – যেন ম্যাট্রিক৷ আর ‘হাউপ্টশুলে'-র ছাত্র-ছাত্রীরা ন'বছর পরেই স্কুলের পাঠ শেষ করে ‘মিটলারে রাইফে'-র সার্টিফিকেট পকেটে নিয়ে পেশাগত প্রশিক্ষণের দিকে চলে যায়৷
এভাবেই চলছিল এবং ভালোই চলছিল, কিন্তু সমস্যা দেখা দেয় দু'দিক থেকে: প্রথমত, সন্তানদের সম্পর্কে বাবা-মায়েদের উচ্চাশা ক্রমেই বাড়তে থাকে, ফলে সবাই চান যে, তাদের ছেলে কিংবা মেয়ে গিমনাজিয়ুমে যাক; অর্থাৎ যোগ্যতা বা উপযোগিতার চেয়ে সমানাধিকারের প্রশ্নটাই বড় হয়ে দাঁড়ায়৷
দ্বিতীয়ত, সাধারণভাবে বিদেশি-বহিরাগত-অভিবাসী পরিবারের ছেলে-মেয়েরাই জার্মান শিক্ষাব্যবস্থায় পিছিয়ে পড়তে থাকে ও খানিকটা সেই কারণেই শিক্ষাবিমুখ হয়ে ওঠে৷ অর্থাৎ এখানেও এসে পড়ছে সমানাধিকার ও সমান সুযোগের প্রশ্ন, এবং জার্মান শিক্ষাব্যবস্থা শিল্প-বাণিজ্যের পক্ষে স্কুল স্নাতকদের উপযোগিতার প্রসঙ্গ আপাতত শিকেয় তুলে রেখে বৈষম্য দূরীকরণ ও সামাজিক শান্তি রক্ষার পথ খুঁজতে শুরু করে৷
তবুও এদেশের সরকারি স্কুলগুলিতে কোনো ফি লাগে না; ছাত্র-ছাত্রীদের গায়ে হাত তোলা নিষিদ্ধ; ক্লাশরুমে খ্রিষ্টান ক্রুশ প্রদর্শন নিষিদ্ধ৷ এদেশে শিক্ষকদের পদমর্যাদা – ও পেনশন – সরকারি অফিসারদের মতো৷ জার্মান সমাজ নিজেকে স্বাধীন সমাজ বলে গণ্য করে ও স্বাধীন সমাজই থাকতে চায়৷ সেই স্বাধীনতার একটি বড় রণাঙ্গণ হল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, স্কুল-কলেজ – বিশেষ করে স্কুল৷ স্কুলপ্রাঙ্গণেই আগামী প্রজন্মের নাগরিক ও সেই সঙ্গে গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ নির্ধারিত হয়ে থাকে৷
তাই শিক্ষা বাদ দিয়ে জার্মানিতে রাজনীতি হয় না৷
আপনি কি লেখকের সঙ্গে একমত? লিখুন নীচের মন্তব্যের ঘরে৷