স্কুলে শারীরিক নিপীড়ন বর্জন করা হয় ১৯৮৩ সালে৷ বাড়িতেও বাচ্চাদের গায়ে হাত তোলা পুরোপুরি নিষিদ্ধ হয়েছে ২০০০ সাল থেকে৷ আইন করেও যে প্রচলিত সামাজিক প্রথা, আচার-ব্যবহার বদলানো যায়, জার্মানি তার প্রমাণ৷
বিজ্ঞাপন
নয়ত জার্মানিতে স্কুলের মাস্টাররা এককালে বেত হাতে করেই ক্লাসে ঢুকতেন৷ বাড়িতে দুষ্টু ছেলেদের শাসনের পদ্ধতিও কিছু আলাদা ছিল না৷ কিন্তু নাৎসি আমলের দুঃস্বপ্নের পর যে নতুন গণতান্ত্রিক, প্রগতিশীল জার্মানি সৃষ্টি হয়, সেখানে আদর্শ থেকে আইনের দূরত্ব অনেক ছোট হয়ে আসে৷ আরো বড় কথা, মানুষজন সেটাকে মেনে নিয়ে নিজেদের বদলাতে শেখেন৷ অর্থাৎ আগে আইন বদলে, পরে মানুষ বদলানো৷ না, ঘটনাটা ঘটেছিল অন্যভাবে৷
স্কুলে শারীরিক দণ্ডদানের বিরুদ্ধে নিরুচ্চার থেকে সোচ্চার প্রতিবাদের ঢেউ ওঠে বিশেষ করে সত্তরের দশকে, তথাকথিত আটষট্টির প্রজন্মের আধা-হিপি জার্মানরা যখন যাবতীয় কর্তৃত্বমূলক ব্যবস্থা ও আচার-আচরণ প্রত্যাখ্যান করতে শুরু করেন৷ সেই ঢেউ গিয়ে থামে ১৯৮৩ সালে, যখন স্কুলে শারীরিক শাস্তি বর্জন করা হয়৷ শিক্ষকদের জন্য সে ধরনের শারীরিক দণ্ডদান দায়রা অপরাধ বলে ঘোষণা করা হয় তারও দশ বছর পরে, ১৯৯৩ সালে৷ বাড়িতে মারধোরের সমস্যাটা কিন্তু তখনও রয়েই গিয়েছে৷
সন্তানের সাথে সুন্দর সম্পর্ক রাখার কিছু উপায়
বাবা-মায়ের কাছে সন্তানের চেয়ে মূল্যবান কি আরো কিছু আছে? এককথায় ‘না’৷ এ সম্পর্ক খারাপ হলে পরিবারে নানা জটিলতা আর অশান্তির সৃষ্টি হয়৷ সম্পর্ক সুন্দর রাখার কিছু সহজ উপায় থাকছে এই ছবিঘরে৷
ছবি: Colourbox
মায়ের সাথে সম্পর্ক
ছোটবেলায় শিশুরা বেশিরভাগ সময় যে মায়ের সাথেই থাকে – এ কথা ঠিক৷ তাই বলে যে মায়ের সাথে পরেও সম্পর্ক ভালো থাকবে এমন কোনো কথা নেই কিন্তু! সব সময় সম্পর্ক ভালো এবং সুন্দর সম্পর্ক রাখার জন্য অবশ্যই সে সম্পর্ক তৈরি করতে হবে আর সেটা করতে হবে ছোটবেলা থেকেই৷ কিন্তু কিভাবে?
ছবি: Colourbox
সম্পর্ক তৈরি
দায়িত্ব পালন এক বিষয়, আর বন্ধুত্বের সম্পর্ক সম্পূর্ণ অন্য একটা বিষয়৷ ছোটবেলা থেকেই শিশুর সাথে খেলাধুলা করুন, বই পড়ুন৷ শিশুর সাথে বসে টিভিতে শিশুদের অনুষ্ঠান দেখুন৷ শিশুকে অন্য শিশুর সাথে মিশতে, খেলতে দিন৷ এতেই বোঝা যাবে আপনার শিশুর পছন্দ, অপছন্দ, ভালো লাগা আর না লাগার কথা৷ শিশুর পছন্দকে গুরুত্ব দিন তবে ওর পছন্দই যেন সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব না পায়৷
ছবি: Stadt Stuttgart/Kraufmann/Hörner
বাবার দায়িত্ব
সময়ের দাবির কারণে কিছুটা পরিবর্তন এলেও এখনো দেখা যায় যে, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে সন্তানরা বেশিরভাগই মায়ের সাথে যতটা সহজ, বাবার সাথে তেমনটা নয়৷ তাই বাবাও সন্তানের জন্য কিছুটা সময় বের করে সন্তানের সাথে থাকুন৷ জার্মানিতে অনেক বাবাকেই দেখা যায় ছুটির দিনে সন্তানকে নিয়ে পার্কে, মিউজিয়ামে বা অন্য কোথাও ঘুরতে যেতে৷ এর মাধ্যমে বাবার সাথে সন্তানের গড়ে ওঠে ঘনিষ্ঠতা৷
ছবি: colourbox/S. Darsa
সমান দায়িত্ব
সন্তানদের সাথে ভালো এবং মধুর সম্পর্ক গড়া মা-বাবার সমান দায়িত্ব তাই দায়িত্ব ভাগ করে নিয়ে সব বিষয়ে কথা বলুন৷ এতে ছেলে-মেয়েরা সহজ হয়ে ওদের দুঃখ, কষ্ট ও সমস্যার কথা জানাতে দ্বিধা করবে না৷ শিশুদের ভয় দেখিয়ে কখনো কাছে আনা যায় না৷ওরা কোনো অপরাধ করলে তা নিয়ে সরসরি আলোচনা করতে হবে৷ ছোটবেলায় সন্তনকে ভয় দেখিয়ে কাজ হলেও, বড় বয়সে কিন্তু আর সে সম্পর্ক সুন্দর থাকে না৷ তাই সন্তানদের সঙ্গে বন্ধুর মতো মিশতে হবে৷
ছবি: Getty Images/D. Silverman
সম্পর্কে দূরত্ব আনে প্রযুক্তির ব্যবহার
আজকাল প্রায়ই দেখা যায় একদিকে মা, একদিকে বাবা, আর অন্যদিকে সন্তান – যে যার মতো ব্যস্ত ফেসবুক, কম্পিউটার বা ট্যাবলেট নিয়ে৷ অর্থাৎ পরিবারের সদস্যদের ভেতর কথাবার্তা তেমন হচ্ছে না৷ তাই প্রয়োজন ছাড়া এই যন্ত্রগুলোকে সরিয়ে রেখে দিয়ে নিজেদের মধ্যে সব বিষয় নিয়ে আলোচনা করার পরামর্শ দিয়েছেন শিশু-কিশোর মনোরোগ বিশেষজ্ঞ গুন্ডুলা গ্যোবেল৷
ছবি: picture-alliance/dpa/Tetra Images
সন্তানের সামনে ঝগড়া নয়!
বাবা-মায়ের নিয়মিত ঝগড়া সন্তানদের মনে ভীষণভাবে রেখাপাত করে, যা বড় বয়সেও তারা ভুলতে পারে না৷ শুধু তাই নয়, যারা খুব বেশি ঝগড়া করেন, তাঁদের অকালমৃত্যুর ঝুঁকি অন্যদের তুলনায় দুই থেকে তিনগুণ বেশি৷ এই তথ্য পাওয়া গেছে ডেনমার্কের কোপেনহাগেন বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীদের করা এক গবেষণার ফল থেকে৷ তাছাড়া বাবা-মা সারাক্ষণ ঝগড়া করলে সন্তানরা বিষণ্ণতায় ভোগে, যা পরবর্তিতে তাদের ভেতরে থেকে যায়৷
ছবি: Fotolia
আলোচনার বিকল্প নেই
পরিবারের সুখ-শান্তি রক্ষায় আলোচনার কোনো বিকল্প নেই৷ তাই ‘‘শিশুকে শিশু না ভেবে একজন সম্পূর্ণ মানুষ হিসেবে গণ্য করে আলোচনায় ওকেও অংশ নিতে নিন৷ শিশুর কথা মনোযোগ দিয়ে শুনুন এবং ওকে বলার সুযোগ দিন৷ এর মধ্য দিয়ে আপনার সন্তানটিও বুঝবে যে সে পরিবারের একজন সদস্য এবং ওর মতামতেরও মূল্য আছে৷ এতে শিশুর দায়িত্ববোধ এবং অন্যদের প্রতি শ্রদ্ধাও বাড়বে’’, বলেন বিশেষজ্ঞরা৷
ছবি: picture alliance/zb/Hans Wiedl
বকা বা ভয় দেখাবেন না!
আজকের যুগের জীবনযাত্রা মোটেই সহজ নয়, কিন্তু তারপরও মা-বাবা তাঁদের দৈনন্দিন জীবনের চাপ সন্তানদের ওপর চাপিয়ে দেবেন না৷ কারণ শিশুদের মন খুবই নরম, ওরা সব বাবা-মায়ের সব কথার উত্তর না দিলেও তা ওদের মনে নেতিবাচক প্রভাব ভেলে, খুব সহজেই৷ দৈনন্দিন সমস্যার কথাও সন্তানদের সাথে শেয়ার করুন৷ হয়ত ওদের কাছে থেকেই পেয়ে যাবেন সমস্যার সমাধান৷বকাঝকা করে বা ভয় দেখিয়ে সন্তানদের কাছে আনা যায় না৷
ছবি: Sandy Schulze/Fotolia
স্বপ্ন আর বাস্তব – এক নয়!
প্রতিটি বাবা-মা চান তাঁদের সন্তান সব কিছুতেই ভালো করুক, যা খুবই স্বাভাবিক৷ তবে এটাও মনে রাখা দরকার যে, ‘স্বপ্ন আর বাস্তব’ – এক নয়৷ তাই পরীক্ষায় ভালো ফলাফল হয়নি বা অন্য কোনো প্রতিযোগিতায় মনের মতো সাফল্য দেখাতে পারেনি বলে তাকে বকাঝকা না করে বরং আরও একটু বেশি যত্ন নিন, সাহস দিন আগামীবারের জন্য৷ তাছাড়া পরীক্ষায় ভালো রেজাল্ট করাই জীবনের একমাত্র লক্ষ্য হওয়া উচিত নয়, কখনোই!
সন্তান এবং বাবা-মায়ের ভেতর এমন সম্পর্ক তৈরি করার চেষ্টা করতে হবে যেন, একে-অপরকে নির্দ্বিধায় সব কথা বলতে এবং বুঝতে পারা যায়৷
ছবি: Colourbox
10 ছবি1 | 10
শিক্ষকের পরে বাবা-মা
২০০০ সালে জার্মান সরকার একটি আইন প্রণয়ন করেন, যে আইনে বাড়িতে ছেলে-মেয়েদের শারীরিক দণ্ডদান নিষিদ্ধ করা হয়৷ জার্মান সিভিল কোড-এর ১৬৩১ ধারা সংশোধন করে দাঁড়ায়: ‘‘শিশুদের অহিংসভাবে প্রতিপালিত হবার অধিকার আছে৷ শারীরিক দণ্ডদান, মানসিক আঘাত বা অপরাপর অবমাননাকর পদক্ষেপ অনুমতিযোগ্য নয়৷''
এ তো গেল আইন৷ কিন্তু সেই আইনকে বাস্তবের সঙ্গে মেলানোর একটি ভালো দৃষ্টান্ত ছিল জার্মান সরকারের সামনে: সুইডেন, যারা ১৯৭৯ সালেই ছোটদের শারীরিক দণ্ডদান সংক্রান্ত আইন সংশোধন করেছিল৷ সুইডেনের দেখাদেখি জার্মান সরকারও আইনের সঙ্গে সঙ্গে একটি পূর্ণাঙ্গ গণসচেতনতা বৃদ্ধি অভিযান শুরু করেন৷ সে অভিযানের দায়িত্ব ছিল পরিবার মন্ত্রণালয়ের হাতে – তা-তে যোগ দিয়েছিল বহু সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, এনজিও এবং বিশেষজ্ঞরা৷ অভিযানের লক্ষ্য ছিল, বাবা-মায়েদের শারীরিক দণ্ডদানের কুফল সম্পর্কে অবহিত করা এবং অহিংস, ইতিবাচক অভিভাবকত্বের পন্থা প্রদর্শন করা৷
আইন প্রণয়নের বছর দুয়েকের মধ্যেই একটি গবেষণা থেকে দেখা যায় যে, সেই আইন শিশুদের শারীরিক দণ্ডদানের আইনগত বাধাবিপত্তি সম্পর্কে সচেতনতা বাড়িয়েছে; শারীরিক দণ্ডদান যে এক ধরনের সহিংসতা, সে বিষয়ে চেতনা বাড়িয়েছে; এবং শারীরিক নিপীড়ন না করে শিশুদের অন্য কি ধরনের সাজা বা শাস্তি দেওয়া যেতে পারে, সে ব্যাপারে পারিবারিক আঙ্গিকে আলাপ-আলোচনা ও তর্কাতর্কি বাড়িয়েছে! অর্থাৎ আইন প্রণয়নের মতো একটি শুকনো ঘটনা জনতার মনোভাব ও আচরণ প্রভাবিত করতে সক্ষম, যদি প্রচারণা ও গণশিক্ষামূলক অপরাপর কর্মসূচি তার সঙ্গে যুক্ত হয়৷
কাজেই ২০০৯ সালে জার্মানির তৎকালীন পরিবারমন্ত্রী উর্সুলা ফন ডেয়ার লাইয়েনকে সগর্বে ঘোষণা করতে শোনা গেছে, ‘‘শিশুদের উপর সহিংসতা আজ অতীতের ঘটনা৷ আজ আর প্রায় কোথাও শারীরিক দণ্ডদানের বিধি নেই৷'' এককালে জার্মান অভিভাবকরা তাদের কড়া শাসনের জন্য সুবিদিত ছিলেন, আজ তা পুরোপুরি বদলে গেছে – বলেন ফন ডেয়ার লাইয়েন৷
সাধারণভাবে বলা যেতে পারে: জার্মান বাবা-মায়েরা আজকাল ছেলে-মেয়েদের সঙ্গে কথা বলে তাদের আচার-আচরণ পরিবর্তন করার চেষ্টা করেন৷ তার একটা কারণ সম্ভবত এই যে, কঠোর সময়ানুবর্তিতা আর শৃঙ্খলার মতো আদি জার্মান গুণাগুণগুলির কদরও অনেকটা শিথিল হয়ে এসেছে৷
প্রিয় পাঠক, জার্মানির মতো আমরাও কি সন্তানকে না পিটিয়ে তার সঙ্গে কথা বলে তার আচরণে পরিবর্তন আনতে পারিনা? জানান নীচে মন্তব্যের ঘরে...