জার্মানিতে ট্রান্সজেন্ডার অধিকার আইন চালু হতে যাচ্ছে
প্রতিবেদন: জুলি গ্রেগসন/এআই২৮ অক্টোবর ২০২৪
জার্মানিতে পহেলা নভেম্বর থেকে আনুষ্ঠানিক নথিতে সহজে লিঙ্গ পরিবর্তন এবং নাম বদলানোর এক নতুন আইন চালু হবে৷ ট্রান্সজেন্ডার, ইন্টারসেক্স এবং ননবাইনারি মানুষরা এই আইনকে স্বাগত জানিয়েছেন৷ তবে রক্ষণশীলরা এটির বিরোধিতা করেছেন৷
বিজ্ঞাপন
জার্মানির নতুন ‘সেল্ফ-ডিটারমিনেশন অ্যাক্ট' ব্যবহার করে শুক্রবার থেকে ১৮ বছর বা তার বেশি বয়সিরা আনুষ্ঠানিক নথিতে থাকা নিজেদের নাম, লিঙ্গ পরিচয় পরিবর্তন বা জেন্ডার মার্কার তুলেও দিতে পারবেন৷
এই পরিবর্তনের আবেদন করা এবং তা ব্যক্তিগতভাবে ঘোষণার মধ্যে তিনমাস অপেক্ষার একটি বাধ্যবাধকতা রয়েছে৷ তবে এই আইন চালুর শুরুর দিকে এধরনের পরিবর্তনের আগে দুইটি মনস্তাত্ত্বিক মূল্যায়ন এবং আদালতে শুনানির যে নিয়মের কথা বলা হয়েছিল তা বাতিল করা হয়েছে৷
সমাজ পরিবর্তনের আশা করছেন শিশির
04:18
১৪ বছরের বেশি বয়সি অপ্রাপ্তবয়স্করাও এই পরিবর্তন করতে পারবে তবে সেজন্য তাদের অভিভাবকের অনুমতি বা আইনি সহায়তা নিতে হবে৷ অভিভাবকরা শিশুদের পক্ষে পরিবর্তনের প্রক্রিয়ার জন্য আবেদন করতে পারবেন তবে শিশুদেরও সরকারি নিবন্ধন দপ্তরে উপস্থিত থাকতে হবে এবং তাদের সম্মতি দিতে হবে৷
এই আইনের মাধ্যমে শুধুমাত্র আমলাতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় পরিবর্তন আনা যাবে৷ চিকিৎসার ক্ষেত্রে এর কোনো প্রভাব নেই৷
জার্মান ট্রান্স* অ্যাসোসিয়েশন (বিভিটি)-এর নীতি বিষয়ক কর্মকর্তা ক্যালে হ্যুম্ফনার নতুন এই আইনকে স্বাগত জানিয়েছেন৷ তিনি মনে করেন যে নিজের লিঙ্গ নিজেই সনাক্তের ব্যাপারটি এখন আরো সহজে এবং কম খরচে করা যাবে৷
হ্যুম্ফনার আরো একটি বিষয়কে গুরুত্ব দিয়েছেন৷ তাহচ্ছে নতুন আইনি প্রক্রিয়ার কারণে যারা নিজেদের লিঙ্গ পরিচয় পরিবর্তনে আগ্রহী তাদের আগের মতো বিব্রতকর প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হবে না৷
চরম ডানপন্থি রাজনীতির রোষে ট্রান্স ব্যক্তিরা
জার্মানির চরম ডানপন্থি রাজনীতির রোষে পড়েছে ট্রান্সজেন্ডার বা তৃতীয় লিঙ্গের মানুষেরা৷ কিন্তু এই ধারার প্রভাব পড়ছে সমাজের অন্যত্রও৷ বিস্তারিত ছবিঘরে...
ছবি: Guido Schiefer/IMAGO
জার্মানির আইন ও বিতর্কের সূত্রপাত
২০২৩ সালে জার্মান সরকার একটি বিল পাস করে নতুন আইন আনে৷ এই ‘সেলফ-ডিটারমিনেশন’ অ্যাক্টটি জার্মানিতে ট্রান্স, ইন্টারসেক্স বা নন-বাইনারি পরিচিতির মানুষদের লিঙ্গ বদলানোর কাজে সহায়তা করবে৷ এই আইন পাস হবার পর থেকেই এ বিষয়ে বিভ্রান্তিকর তথ্য, গুজব ও ঘৃণা ছড়ানো মন্তব্য উঠে আসছে দেশটির চরম ডানপন্থি রাজনৈতিক মহল থেকে৷
ছবি: lev dolgachov/Zoonar/picture alliance
যা বলছে এএফডি
গত বছর, জার্মানির চরম ডানপন্থি দল, এএফডির নেত্রী বিয়াট্রিক্স ফন স্টর্শ বলেন যে, শারীরিক পরিচিতিই লিঙ্গ পরিচিতির ক্ষেত্রে শেষ কথা৷ তার মতে, ট্রান্স ব্যক্তিদের জন্য দেশজুড়ে লিঙ্গ সচেতনতা কেন্দ্র খোলা হচ্ছে যখন, তখন একই সময়ে দেশে অবসরপ্রাপ্তদের জন্য বা স্কুল-কলেজের জন্য পর্যাপ্ত অর্থায়ন সম্ভব হচ্ছে না৷
ছবি: Frederic Kern/Future/IMAGO
কী উদ্দেশ্যে এমন মন্তব্য?
সাশা ক্রানকে চরম ডানপন্থি রাজনীতি ও ট্রান্সভীতি নিয়ে গবেষণা করেন৷ তার মতে, এর আগেও, সমকামীদের আন্দোলনের ক্ষেত্রে বিভ্রান্তিকর মন্তব্য করতে দেখা যায় বলে জানান তিনি৷ ক্রানকে বলেন, ‘‘জার্মানিতে সমকামীদের অধিকারের বিষয়টি বর্তমানে এতটাই স্বাভাবিক পর্যায়ে চলে এসেছে যে এই ইস্যুতে জনগণ এখন আর বিভক্ত হয় না৷ চরম ডানপন্থিরা তাই এখন আরো ছোট একটি গোষ্ঠীকে (ট্রান্স) আক্রমণ করছে, যাতে তাদের একতা ভাঙা যায়৷’’
ছবি: Marius Becker/dpa/picture alliance
সমকামী ও তৃতীয় লিঙ্গের বিরুদ্ধে সংগঠিত অপপ্রচার
২০২৪ সালের জানুয়ারিতে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন বার্ষিক একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে, যেখানে দেখা যায় যে ইইউ-তে এলজিবিটিকিউ প্লাস গোষ্ঠীকে নিয়ে ধারাবাহিকভাবে গুজব ও ভুল তথ্য ছড়ানো হচ্ছে৷ শুধু তাই নয়, বিদেশি শক্তিরাও অনেক ক্ষেত্রে ইইউ সদস্য রাষ্ট্রের মধ্যে বোঝাপড়ায় ব্যাঘাত ঘটাতে এমন গুজবের আশ্রয় নিচ্ছে, বলে জানিয়েছে প্রতিবেদনটি৷
ছবি: Fotostand/Reuhl/dpa/picture alliance
চরম ডানপন্থি আদর্শের শিকড়ে সমকাম বিরোধিতা
জার্মান সংবিধান সংরক্ষণ ও অভ্যন্তরীণ গোয়েন্দা সংস্থা বিএফভি ২০২১ সাল থেকেই চরম ডানপন্থার অভিযোগে এএফডির কার্যকলাপকে খতিয়ে দেখছে৷ সংস্থাটির মতে, ট্রান্স ও সমকাম বিরোধিতা আসলে চরম ডানপন্থি রাজনীতির ভেতরে প্রোথিত৷ ফলে, আধুনিক সমাজ আজ যেভাবে লিঙ্গ ও পরিবারকে দেখে, এএফডির মতাদর্শ তা সরাসরি খারিজ করে৷
ছবি: mufkinnphotos/aal.photo/IMAGO
বাড়ছে তৃতীয় লিঙ্গের সাথে ঘটা অপরাধের সংখ্যা
ট্রান্স ব্যক্তিদের সংস্থা বুন্ডেসফেরবান্ড ট্রান্সের মুখপাত্র ক্যোনিগের মত, ট্রান্স ব্যক্তিদের সামাজিক হুমকি রূপে উপস্থাপন করে এএফডির রাজনীতি৷ অথচ জার্মান স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পরিসংখ্যান বলছে, ২০২১ সালে ৩৪০টি ঘটনা থেকে ২০২২ সালে সমকামবিরোধী ও ট্রান্সবিরোধী অপরাধের সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ৪১৭৷ সমাজকর্মীদের মতে, এই সংখ্যা আরো বেশি হতে পারে কারণ অনেক সময়েই, এই অপরাধগুলো নানা কারণে নথিভুক্ত হয় না৷
ছবি: Ying Tang/NurPhoto/picture alliance
বিপদ শুধু কি ট্রান্স ব্যক্তিদের?
দেশে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ভোট পাওয়া এএফডি জার্মানিতে কেবল ট্রান্স বা সমকামীদের অধিকারের লড়াইয়ের জন্য বাধা হবে না, জানাচ্ছেন ক্যোনিগ৷ তিনি বলেন, ‘‘গত কয়েক দশক ধরে লিঙ্গ বৈষম্য, বর্ণবাদ, সমকামভীতি বা ট্রান্সভীতির ক্ষেত্রে যত অগ্রগতি হয়েছে, তাকে নাকচ করতে চায় এএফডি৷’’ সব ধরনের বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের ওপর এর প্রভাব পড়বে৷
ছবি: Guido Schiefer/IMAGO
7 ছবি1 | 7
তিনি বলেন, ‘‘আগের যাচাই প্রক্রিয়ায় অনেক একান্ত ব্যক্তিগত তথ্যও ফাঁস করতে হতো আগ্রহী ব্যক্তিদের - এমন তথ্য যা আদালতকে জানাতে হতো৷ অনেক আতঙ্কজনক প্রতিবেদন রয়েছে যেখানে আগ্রহীরা জানিয়েছেন যে তাদেরকে নিজেদের যৌন পছন্দ, হস্তমৈথুন চর্চা এবং অন্তর্বাস বাছাইয়ের মতো বিষয় নিয়ে প্রশ্ন করা হয়েছিল৷''
জার্মান সংবাদসংস্থা ডিপিএর প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, জার্মানির রাজধানী বার্লিনের বর্ধনশীল এলজিবিটিকিউ+ সম্প্রদায়ের ১২০০-র মতো মানুষ এখন অবধি আনুষ্ঠানিক নথিতে লিঙ্গ পরিচয় পরিবর্তনের জন্য আবেদন করেছেন৷ ক্যাথলিক সংবাদ সংস্থা কেএনএ জানিয়েছে যে অন্যান্য শহরেও একইরকম আগ্রহ রয়েছে৷
জার্মান সাংসদ এবং ট্রান্সজেন্ডার নারী ন্যুকে স্লাভিক সবুজ দলের পক্ষে আইনটি বাস্তবায়নের জন্য সমঝোতার দায়িত্বে ছিলেন৷ তিনি এই আইনের ভূয়সী প্রশংসা করে জানান যে এটির আন্তর্জাতিক গুরুত্ব রয়েছে৷
স্লাভিক বলেন, ‘‘ডানপন্থি পপুলিস্ট কন্ঠগুলো যখন আবারও চড়া হচ্ছে তখন এই আইনের বাস্তবায়ন এক আশার প্রতীক৷ এবং এটা এমন এক সময় যখন অনেক দেশ ক্যুয়ার মানুষদের অধিকার ইস্যুতে পেছনের দিকে হাঁটায় অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে৷''
জার্মানির জোট সরকার নতুন এই আইনের প্রস্তাব সংসদে উপস্থাপন করার পর সেটি বিরোধী দল রক্ষণশীল খ্রিষ্টীয় গণতন্ত্রী (সিডিইউ) এবং এটির বাভারিয়া অংশ খ্রিষ্টীয় সামাজিক ইউনিয়ন (সিএসইউর) বিরোধিতার মুখে পড়ে৷ উগ্রডানপন্থি পপুলিস্ট দল এএএফডিও খসড়াটির বিরোধিতা করে৷
সংসদে ব্যাপক বিতর্কের প্রেক্ষিতে বিভিন্ন পরিবর্তন এনে ২০২৪ সালের এপ্রিলে আইনটি অনুমোদন করা হয়৷