গাড়ি চালানোর কথা উঠলে অনেকে বলেন, ‘‘জার্মানির মহাসড়কে কোনো নির্দিষ্ট গতিসীমা নেই৷ যেভাবে খুশি গাড়ি চালানো যায়৷'' এ কথা আংশিক সত্য৷ মহাসড়কের অনেক জায়গায় গতিসীমা নেই৷ তবে অন্যত্র আছে কড়া নিয়ম, যা না মানলে কঠোর জরিমানা৷
বিজ্ঞাপন
জার্মানিতে গাড়ি চালানো আনন্দের ব্যাপার৷ বিশেষ করে জার্মান ভাষায় ‘অটোবান' হিসেবে পরিচিত মহাসড়কগুলো অত্যন্ত মসৃণ এবং মজবুতভাবে তৈরি৷ হাজার হাজার কিলোমিটার পথ একইভাবে, একই ডিজাইনে তৈরি করা হয়েছে যেগুলো জনবসতি এবং বড় শহরের বাইরে থেকে চলে গেছে৷ হঠাৎ কোথাও ভাঙা রাস্তায় চাকা আটকে যেতে পারে এমন শঙ্কা নিয়ে গাড়ি চালাতে হয় না এদেশে৷ কিংবা নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে বেপরোয়া গাড়ি চালানো জার্মান চালকও খুব একটা নেই৷ মোটের উপর মহাসড়কে সাইকেল কিংবা পায়ে হেঁটে মানুষের চলাচল নিষিদ্ধ৷ তাই নিয়মকানুন জানা থাকলে, মহাসড়কে দ্রুত গতিতেও গাড়ি চালানো যায় নিরাপদে৷ আর দুর্ঘটনায় প্রাণহানীও আমাদের দেশের তুলনায় অনেক কম৷
ইউরোপের কিছু কঠিন ও মজার ট্রাফিক আইন
খুব সাবধানে গাড়ি চালাতে হয় ইউরোপে৷ পথচারীর গায়ে কাঁদা বা পানি ছিটালে জরিমানা, বেশি জোরে বা বেশি আস্তে চালালে জরিমানা, এমনকি নিজের গাড়ি পরিষ্কার না করলেও রেহাই নেই৷ ছবিঘরে থাকছে এমনই কিছু ট্রাফিক আইনের কথা৷
ছবি: picture-alliance/dpa/M. Förster
পানি ছিটাবেন না
ইউরোপের রাস্তায়ও বৃষ্টি হলে একটু-আধটু পানি জমে৷ অনেক সময় জলাবদ্ধতাও সৃষ্টি হয়৷ তবে জনগণের সেবা নিশ্চিত করতে কর্তৃপক্ষ সদা তৎপর৷ এমনকি কোনো চালক অসতর্কতাবশত কারো গায়ে পানি ছিটিয়ে দিলে, সঙ্গে সঙ্গেই আইন দাঁড়ায় ভুক্তভোগীর পাশে৷ ব্রিটেনে এ অপরাধে ১০০ পাউন্ড জরিমানা হয় চালকের৷ ‘ওভারটেক’ করে মাঝের লেন দখল করে চালাতে শুরু করলে আরো বিপদ৷ জরিমানার অঙ্কটা তখন ১ হাজার পাউন্ড বা ১,৪০০ ইউরো!
ছবি: imago/Petra Schneider
গাড়ি পরিষ্কার না করলেও জরিমানা!
রুমানিয়ার রাস্তায় ভুলেও কখনো নোংরা গাড়ি নিয়ে নামবেন না৷ আপনার গাড়ি শহরের সৌন্দর্য হানির কারণ হলে কিন্তু ট্রাফিক পুলিশ আপনাকে ছাড়বে না৷ এমনকি শুধু নাম্বারপ্লেট, হেডলাইট বা পেছনের লাইট পরিষ্কার না করলেও গুনতে হবে মোটা অঙ্কের জরিমানা৷
ছবি: picture-alliance/dpa/Imaginechina
বেশি ধীরে চালালেও মুশকিল
সুইজারল্যান্ডে কখনো কখনো একটু বেশি আস্তে গাড়ি চালালেও সমস্যা৷ বিশেষ করে তিন লেনের রাস্তার একেবারে বাঁ দিকের লেন দিয়ে কেউ নিজের খুশিমতো শামূকের গতিতে গাড়ি চালাবে, তা হবে না৷ এমন ক্ষেত্রে কোনো গাড়ির গতিবেগ যাতে ঘণ্টায় ১০০ কিলোমিটার (৬২ মাইল)-এর কম না হয়, তা নিশ্চিত করার চেষ্টা চলছে৷ আগামী ২০১৬ সাল থেকে দেশে এমনই একটি আইন কার্যকর করবে সুইস সরকার৷
ছবি: picture-alliance/dpa
বরফ হইতে সাবধান
শীতে গাড়ির দিকে বিশেষ নজর দিতে হয়৷ নভেম্বর থেকে এপ্রিল – এই পাঁচমাস আইসল্যান্ডে রাস্তায় রাস্তায় বরফের কথা মাথায় রাখতেই হয়, লাগাতে হয় বিশেষ চাকা৷ অস্ট্রিয়া, এস্টোনিয়া, ফিনল্যান্ড এবং জার্মানিতে শীতের সময় এমন চাকা ব্যবহার করা বাধ্যতামূলক নয়, তবে নিজের স্বার্থেই বেশির ভাগ মানুষ শীত এলে চাকা বদলে নেন৷ আসলে বরফ পড়লে ওই ধরনের চাকা ছাড়া গাড়ি চালানো কখনো কখনো অসম্ভব হয়ে পড়ে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/A. Heimken
পার্কিং
ফিনল্যান্ডে রাস্তাঘাট নিয়মিত পরিষ্কার করা হয়৷ কখন কোন রাস্তা পরিষ্কার করা হবে, তা নির্দিষ্ট কিছু জায়গায় কিংবা ইন্টারনেটে বিজ্ঞপ্তি দিয়ে, এমনকি অনেকক্ষেত্রে এসএমএস-এর মাধ্যমে জানিয়ে দেয়া হয়৷ গাড়ি ঘণ্টার পর ঘণ্টা কোথাও রেখে দেবেন সে উপায়ও নেই৷ কতক্ষণের মধ্যে সরাতে হবে তা প্রথমে জানানো হয় এসএমএস-এ, তারপরও না সরালে নগর কর্তৃপক্ষই সরিয়ে দেবে! তবে আপনার গাড়ি সরানোর খরচটা কিন্তু আপনার!
ছবি: picture-alliance/dpa/T. Wennström
দিনেও জ্বালাতে হবে আলো
সুইডেন, নরওয়ে আর ডেনমার্কে গাড়ি চালানো শেখানোর সময়ই বলে দেয়া হয়, ‘যখনই আঁধার নামবে, তখনই আলো জ্বালাতে হবে৷’ তার মানে, দিনের বেলায় মেঘ করলে, কিংবা শীতের কুয়াশাঢাকা আকাশের নীচেও গাড়ির লাইট জ্বালানোটা বাধ্যতামূলক৷ ২০১১ সাল থেকে সব ইইউভুক্ত দেশেই গাড়িতে ‘ডে-টাইম রানিং লাইট’ রাখার আইন কার্যকর করার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে৷ ‘ডে-টাইম রানিং লাইট’ এমন এক বাতি, যা গাড়ির চাকা ঘুরলেই টুক করে জ্বলে ওঠে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/A. Heimken
চশমা একটা কেন?
চোখে সমস্যা আছে? স্পেনে গাড়ি চালাতে যান, ড্রাইভিং লাইসেন্সেই তা লিখে দেয়া হবে৷ আর একবার লিখে দিলে সবসময় আপনাকে দু-দু’টো চশমা সঙ্গে রাখতে হবে৷ একটা চোখে, অন্যটা গাড়ির ড্যাশবোর্ডে৷ চশমা না পরার কোনো অজুহাত দেখানোর পথ বন্ধ করতেই এই ব্যবস্থা৷ ‘চশমাটা বাসায় রেখে চলে এসেছি’ বললেও মাফ নেই৷ জরিমানা গুনতেই হবে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
সময় আর জায়গা অনুযায়ী গতি
জার্মানির অটোবান, অর্থাৎ হাইওয়েতে গাড়ির নির্দিষ্ট কোনো গতিসীমা নেই৷ তবে যেভাবে খুশি চালানোর উপায়ও নেই৷ গাড়ি চালাতে হয় জায়গা এবং সময় বুঝে৷ সে অনুযায়ী নির্ধারিত গতিসীমা লেখা থাকে রাস্তার পাশে৷ লোকালয়েও স্থান এবং সময়টাই গুরুত্বপূর্ণ৷ স্কুলের সামনে নির্ধারিত গতিসীমা অতিক্রম করলে জরিমানা তো হবেই, বাড়তি শাস্তি হিসেবে ‘পেনাল্টি পয়েন্ট’-ও যোগ হবে আপনার রেকর্ডে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/M. Förster
8 ছবি1 | 8
জার্মানিতে ট্রাফিক আইন মানতে চালকদের বাধ্য করতে কয়েকটি কড়া উদ্যোগ রয়েছে৷ চলুন জেনে নেয়া যাক সেগুলো:
প্রথমত, জার্মানিতে গাড়ি চালানোর লাইসেন্স পেতে কঠিন এক পরীক্ষায় অবতীর্ন হতে হবে৷ তাত্ত্বিক পরীক্ষায় মোট নম্বরের চেয়ে পাঁচ নম্বর কম পেলেই ফেল হিসেবে বিবেচনা করা হয়৷ আর ব্যবহারিক পরীক্ষা দেয়ার আগে অন্তত ৩২ ঘণ্টার বেশি একজন প্রফেশনাল প্রশিক্ষকের কাছ থেকে গাড়ি চালানোর প্রশিক্ষণ গ্রহণ করতে হয়৷ এরপর একজন পরীক্ষকসহ আধাঘণ্টার মতো গাড়ি চালানোর পরীক্ষা হয়৷ এতে ফেল করা বেশ সহজ৷ পরীক্ষকের সামনে বড় কোন ভুল করলে বা ছোট ছোট কয়েকটি ভুল করলে ব্যবহারিক পরীক্ষায় ফেল হিসেবে বিবেচিত হন একজন পরীক্ষার্থী৷ আর তাত্ত্বিকে পাশ না করে ব্যবহারিক পরীক্ষা দেয়া যায় না৷ গাড়ির লাইসেন্স পাওয়ার এই কঠিন প্রক্রিয়া পাশ করে যখন একজন গাড়ি চালানো শুরু করেন তারপক্ষে নিয়মকানুন ভুলে যাওয়া বা স্বাভাবিক অবস্থায় এলোপাথাড়ি গাড়ি চালানো কঠিন৷
দ্বিতীয়ত, জার্মানির রাস্তাঘাটে রয়েছে অসংখ্য স্পিডক্যামেরা৷ কিছু ক্যামেরা আবার মোবাইল, অর্থাৎ হঠাৎ করে কোনো এক রাস্তায় বসিয়ে দেয়া হয়৷ এ সব ক্যামেরার কাজ হচ্ছে আপনি সেই রাস্তায় নির্ধারিত গতির চেয়ে বেশি গতিতে গাড়ি চালালে আপনার চেহারা এবং গাড়ির নম্বর প্লেটের ছবি তুলে ফেলা৷ এরপর আপনার ঠিকানায় চলে যাবে বিল৷ গাড়ির গতি নির্ধারিত গতির যত বেশি হবে জরিমানার হার ততই বেশি৷ নির্ধারিত সীমার বেশি হলে অনেক সময় লাইসেন্স নির্দিষ্ট সময়ের জন্য বাতিল এমনকি চালক মানসিকভাবে সুস্থ কিনা সে পরীক্ষাও করা হতে পারে৷
তৃতীয়ত, জার্মানিতে পুলিশ হঠাৎ হঠাৎ চালক মদ্যপান করেছেন কিনা তা যাচাইয়ের জন্য চৌকি বসায়৷ পরিমিতমাত্রার চেয়ে বেশি এলকোহল পান করে গাড়ি চালানো গুরুতর অপরাধ৷ এই অপরাধ লাইসেন্স হারাতে পারেন একজন চালাক৷ পাশাপাশি আর্থিক জরিমানাতো রয়েছেই৷ মোটের উপর মদ্যপ অবস্থায় একজন গাড়ি চালালে তার দোষ ছাড়া দুর্ঘটনা ঘটলেও তাকে দোষী করা হয়৷
চতুর্থত, গাড়ি চালানোর ক্ষেত্রে সিটবেল্ট না বাধা এবং গাড়ি চালানোর সময় মোবাইল ব্যবহারের মতো বিষয়গুলো নজরদারিতে রাখা হয় দুর্ঘটনা এড়াতে৷ পাশাপাশি জার্মান মহাসড়কে বিভিন্ন দুর্ঘটনা প্রতিরোধক প্রচারণাও চালানো হয়৷ সবমিলিয়ে নিয়মনীতির দিক থেকে দুর্ঘটনা এড়ানোর সর্বোচ্চ চেষ্টা করা হয়৷ আর তারপর দুর্ঘটনা ঘটলে দোষীদের জার্মান আইনে উপযুক্ত শাস্তি নিশ্চিত করা হয়৷ এক্ষেত্রে পালিয়ে বাঁচার সুযোগ তেমন নেই৷
আমার মনে হয়, জার্মানির মতো বাংলাদেশেও গাড়ি চালানোর লাইসেন্স দেয়ারক্ষেত্রে কড়াকড়ি আরোপ এবং স্বচ্ছতার সঙ্গে পরীক্ষার মাধ্যমে উপযুক্ত ব্যক্তিকে গাড়ির লাইসেন্স দেয়া হলে দুর্ঘটনা কমানো সম্ভব হবে৷ পাশাপাশি চালু করা যেতে পারে উপরে উল্লেখিত অন্যান্য বিষয়ও৷ প্রশ্ন হচ্ছে, বাংলাদেশ সরকার কি এ সব করার ক্ষমতা রাখে?