ডানপন্থিদের কাছ থেকে সাংবিধানিক আদালত রক্ষার উদ্যোগ
২০ ডিসেম্বর ২০২৪
জার্মান সংসদের নিম্নকক্ষ বুন্ডেসটাগে বৃহস্পতিবার দেশটির সাংবিধানিক আদালতের স্বাধীনতা আরো সুরক্ষা সংক্রান্ত একটি প্রস্তাব পাস হয়েছে৷ উচ্চকক্ষ বুন্ডেসরাটে এটি পাস হলে প্রস্তাবটি কার্যকর হবে৷
বিজ্ঞাপন
সাংবিধানিক আদালত পরিচালনার নীতি জার্মানির ‘বেসিক ল' অর্থাৎ সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাব বুন্ডেসটাগে পাস হয়েছে৷ এর মানে হচ্ছে, উচ্চকক্ষে পাসের পর প্রস্তাবটি কার্যকর হলে তার পর থেকে সাংবিধানিক আদালতে কোনো পরিবর্তন আনতে হলে সংসদের দুই-তৃতীয়াংশের ভোট প্রয়োজন হবে৷ কারণ, বেসিক ল বা সংবিধানে পরিবর্তন আনতে এই সংখ্যক ভোটের প্রয়োজন হয়৷
জার্মানিতে ডানপন্থিদের জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকায় তাদের পক্ষে যেন ভবিষ্যতে সাংবিধানিক আদালতে পরিবর্তন আনা কঠিন হয় তা নিশ্চিত করতেই বৃহস্পতিবার বুন্ডেসটাগে ভোটাভুটি অনুষ্ঠিত হয়৷ এতে ৬০০ সাংসদ সাংবিধানিক আদালতকে শক্তিশালী করার পক্ষে ভোট দেন৷ জার্মানির বর্তমান সংসদের সদস্য সংখ্যা ৭৩৩৷
এছাড়া সাম্প্রতিক সময়ে পোল্যান্ড ও হাঙ্গেরিতে আদালতের স্বাধীনতা খর্ব করার চেষ্টা দেখে জার্মানির সাংবিধানিক আদালতের সুরক্ষার উদ্যোগ নেয় বিভিন্ন দল৷
সাংবিধানিক আদালতের বিচারক সংখ্যা ১৬৷ তাদের মেয়াদ ১২ বছর করে৷ আর অবসরের বয়স ৬৮৷
জার্মান সংবিধানের ৭৫ বছর
১৯৪৯ সালে এই সংবিধান গ্রহণ করে পশ্চিম জার্মানি। এরপর এটি বহুবার সংশোধন করা হয়েছে, জার্মান সামরিক বাহিনী বুন্ডেসভেয়ার প্রতিষ্ঠার মতো কিছু বিতর্কিত সংযোজনও করা হয়েছে সংবিধানে।
ছবি: Maja Hitij/Getty Images
'মানুষের মর্যাদা অলঙ্ঘনীয়'
আনুষ্ঠানিকভাবে জার্মান সংবিধান পরিচিত বেসিক ল, বা মৌলিক আইন নামে। এর প্রথম অনুচ্ছেদ শুরু হয়েছে এই বাক্য দিয়ে - 'মানুষের মর্যাদা অলঙ্ঘনীয়'। নাৎসি জার্মানির নজিরবিহীন অপরাধের প্রতিক্রিয়া হিসাবে এই বাক্যটি অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এবং হলোকাস্টের জন্য দায়ী ছিল নাৎসি জার্মানি। জার্মানি এবং ইউরোপ জুড়ে ৬০ লাখ ইহুদি ছাড়াও আরো অনেককে হত্যা করেছিল নাৎসি বাহিনী।
ছবি: Maja Hitij/Getty Images
১৯৪৯: মৌলিক আইন গৃহীত হয়
মৌলিক আইন হিসাবে জার্মান সংবিধান গ্রহণ করা হয় ১৯৪৯ সালের ২৩ মে। তখন অবশ্য এটি শুধুমাত্র পশ্চিম জার্মানির জন্যই প্রযোজ্য ছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জয়ী পশ্চিমা শক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য এবং ফ্রান্স পশ্চিম জার্মানির তিনটি অঞ্চল নিয়ন্ত্রণ করতো। সোভিয়েত ইউনিয়নের নিয়ন্ত্রণে একই বছরের ৭ অক্টোবর জার্মান গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়।
ছবি: picture-alliance/dpa/C. Ohde
১৯৫৬: জার্মান সামরিক বাহিনী
মৌলিক আইন কয়েক দশকে অন্তত ৭০ বার সংশোধন করা হয়েছে। সামাজিক ও ভূ-রাজনৈতিক পরিবর্তনের সঙ্গে সামঞ্জস্য রাখা ছিল এসব পরিবর্তনের লক্ষ্য। এসব পরিবর্তনের মধ্যে বিশেষভাবে বিতর্কিত ছিল পুনঃসামরিকীকরণ। পশ্চিম জার্মানি ১৯৫৫ সালে পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলোর সামরিক জোট ন্যাটোতে যোগ দেয়ার পর জার্মান সশস্ত্র বাহিনী বা বুন্ডেসভেয়ার প্রতিষ্ঠা করে। বাহিনীকে সাংবিধানিক কাঠামো দেয়ার জন্য ১৯৫৬ সালে সংবিধান সংশোধন করা হয়।
ছবি: Nana Ehlers/Bundeswehr/dpa/picture alliance
১৯৬৮: জরুরি অবস্থায় মৌলিক অধিকার সীমিত করা
১৯৬৮ সালে ‘জরুরি অবস্থা‘ সংশোধনীরও সুদূরপ্রসারী ফলাফল ছিল। এই সংশোধনের উদ্দেশ্য ছিল সংকটময় পরিস্থিতিতে, বিশেষ করে প্রাকৃতিক দুর্যোগ, বিদ্রোহ এবং যুদ্ধকালীন সময়ে রাষ্ট্রের কাজ করার ক্ষমতা নিশ্চিত করা। এই সংশোধনীর ফলে বুন্ডেসভেয়ারকে দেশের মধ্যে মোতায়েন, ব্যক্তিগত যোগাযোগে গোপন নজরদারি এবং জরুরি পরিস্থিতিতে নাগরিকদের মৌলিক অধিকার সীমাবদ্ধ করারও সুযোগ তৈরি হয়।
ছবি: Monika Skolimowska/dpa/picture alliance
১৯৯১: একত্রীকরণের পরও একই সংবিধান
মৌলিক আইন যখন প্রণয়ন করা হয় তখন সেটিকে সাময়িক হিসাবেই বিবেচনা করা হয়েছিল। দুই জার্মানি এক হলে নতুন এবং স্থায়ী সংবিধান তৈরি করা হবে, এমনটাই ছিল চিন্তা। কিন্তু দুই জার্মানিকে আলাদা করা বার্লিন দেয়ালের পতন এবং ১৯৯১ সালে জার্মানির পুনরেকত্রীকরণের পরও নতুন সংবিধান প্রণয়ন হয়নি, বরং মৌলিক আইনকেই পুরো জার্মানির জন্য প্রযোজ্য হিসাবে ঘোষণা করা হয়।
পুনরেকত্রীকরণের তিন বছর পর ১৯৯৩ সালে জার্মানিতে রাজনৈতিক আশ্রয়ের জন্য আবেদনের সংখ্যা ব্যাপক সংখ্যায় বৃদ্ধি পায়। এর ফলে মৌলিক আইনে শরণার্থীদের আশ্রয়ের অধিকারটিকে সীমাবদ্ধ করার প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। এই সংস্কারের ফলে জার্মানির নাগরিকত্ব না থাকা ব্যক্তিদের তাদের নিজ দেশে ফেরত পাঠানোর সুযোগ তৈরি হয়। তবে এর আগে সেই দেশকে নিরাপদ দেশের তালিকায় তালিকাবদ্ধ করতে হয়। তালিকায় সাম্প্রতিকতম সংযোজন জর্জিয়া।
ছবি: Lisi Niesner/REUTERS
২০০৯: ঋণ সীমিতকরণ
সরকারি ঋণ সীমিত রাখার লক্ষ্যে ২০০৯ সালে মৌলিক আইনে ‘ডেট ব্রেক‘ অন্তর্ভুক্ত করা হয়। আর্থিক সংকটের পরিপ্রেক্ষিতে প্রবর্তিত এই ব্যবস্থাটি আর্থিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করার জন্য সরকারি ঋণ গ্রহণে সীমা নির্ধারণ করে দেয়। তবে অপ্রত্যাশিত সংকটের ক্ষেত্রে ঋণ সীমা তুলে নেওয়ার সুযোগও রয়েছে, যেমনটি কোভিড মহামারি চলাকালীন করা হয়েছিল। অর্থনৈতিক সঙ্কটের কারণে অনেকে ২০২৪ সালেও ঋণ সীমা শিথিল করার আহ্বান জানাচ্ছেন।
ছবি: Ralph Orlowski/Getty Images
7 ছবি1 | 7
বর্তমানে সংসদের দুই কক্ষ আটজন করে বিচারক নির্বাচন করে৷ কোনো কক্ষের মাইনোরিটি দলের যদি সংসদে এক-তৃতীয়াংশের বেশি আসন থাকে তাহলে দলটি একজন বিচারকের নিয়োগে ভেটো দিতে পারেন৷ বৃহস্পতিবারের ভোটাভুটিতে এই বিষয়েও পরিবর্তন আনার পক্ষে ভোট দিয়েছেন সাংসদরা৷ ফলে প্রস্তাবটি কার্যকর হলে কোনো কক্ষ একজন বিচারকের নিয়োগ নিশ্চিত করতে অসমর্থ হলে অন্য কক্ষ দায়িত্ব নিয়ে নিয়োগ নিশ্চিত করতে পারবে৷