সাবেক চ্যান্সেলর হেলমুট কোল জার্মানিতে অবস্থানরত মোট তুর্কি জনগোষ্ঠীর অর্ধেক তাঁর দেশ থেকে বিদায় করতে চেয়েছিলেন৷ দীর্ঘদিন গোপন হিসেবে রাখা কিছু ব্রিটিশ নথি প্রকাশের পর জানা গেছে এই তথ্য৷
বিজ্ঞাপন
১৯৮২ সালের অক্টোবরে জার্মানির (পশ্চিম) তৎকালীন রাজধানী বনে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী মার্গারেট থ্যাচারের সঙ্গে বৈঠক করেছিলেন জার্মান চ্যান্সেলর হেলমুট কোল৷ সেই বৈঠকে কোল জানান, তুর্কি অভিবাসীদের মধ্য থেকে একটি বড় অংশকে জার্মানি থেকে তাদের দেশে ফেরত পাঠাতে হবে, কেন না তাদেরকে জার্মান সমাজের মূল ধারার সঙ্গে সম্পৃক্ত করা সম্ভব নয়৷ বৃহস্পতিবার স্পিগেল অনলাইন এই তথ্য প্রকাশ করেছে৷
স্পিগেল পত্রিকা কোল এবং থ্যাচারের মধ্যকার বৈঠকে আলোচিত বিষয়াদি নিয়ে তৈরি ‘নোট' থেকে বিভিন্ন তথ্য নিয়েছে৷ নিয়ম অনুযায়ী ৩০ বছর এসব নোট গোপন রাখা হয়েছিল৷ এরপর ব্রিটিশ সরকার সেগুলো প্রকাশ করে৷
বনের সেই বৈঠক নোট করেছিলেন থ্যাচারের ব্যক্তিগত সেক্রেটারি এ.জে.কোলস৷ এতে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘‘চ্যান্সেলর কোল বলেছেন....আগামী চার বছরের মধ্য জার্মানিতে অবস্থানরত তুর্কি জনগোষ্ঠীর সংখ্যা অর্ধেকে কমিয়ে আনার প্রয়োজন হবে৷ তবে কোল জনসমক্ষে তাঁর এই পরিকল্পনার কথা জানাননি৷''
কোলসের তৈরি নোট অনুযায়ী, জার্মান চ্যান্সেলর বলেন, ‘‘বর্তমানে যে সংখ্যক তুর্কি রয়েছে তাদের সবাইকে জার্মান সমাজের মূল ধারায় অঙ্গীভূত করা সম্ভব হবে না৷''
জার্মানির রক্ষণশীল খ্রিষ্টীয় গণতন্ত্রী দল সিডিইউ-র সদস্য কোল ১৯৮২ সালে চ্যান্সেলরের দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত এই দায়িত্ব পালন করেন৷ এরপর সামাজিক গণতন্ত্রী এবং সবুজদের নিয়ে তৈরি মধ্যবামপন্থী সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন তিনি৷ এই সরকার মূলত জার্মানিতে অভিবাসীদের জন্য উদার নীতি চালু করে৷
জার্মানিতে বাড়ি সমস্যায় অভিবাসীরা
অভিবাসীদের বিভিন্ন ক্ষেত্রেই সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়৷ তবে বাড়ির সমস্যাকে একটি বড় সমস্যা হিসেবে ধরা যেতে পারে৷এ সমস্যা জার্মানিতে বসবসারত তুর্কিদের মধ্যেই বেশি দেখা যায়৷ কারণ জার্মানিতে প্রায় ৪০ লাখ তুর্কি আছেন৷
ছবি: Suzheh.sub.ir
অভিবাসী তুর্কিদের সমস্যা বেশি
জার্মানিতে অভিবাসীদের বিভিন্ন ক্ষেত্রেই সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়৷ এগুলোর মধ্যে বাড়ির সমস্যাকে একটি বড় সমস্যা হিসেবে ধরা যেতে পারে৷ জার্মানিতে অভিবাসীদের মধ্যে তুর্কিদের সংখ্যাই সবচেয়ে বেশি প্রায় ৪০ লাখ৷ কাজেই সমস্যাটাও ওদের ক্ষেত্রেই বেশি দেখা যায়৷
ছবি: picture-alliance/dpa
শীতকালে ঠান্ডায় কষ্ট পায়
তুর্কিদের সাধারণত বাসা ভাড়া দেওয়া হয় পুরনো এলাকায় বহু বছরের পুরনো বাড়িগুলোয়৷ সেই সব বাড়িতে হয়ত দরজা ঠিকমতো বন্ধ হয় না বা জানালা দিয়ে বাতাস ঢোকে বা খানিকটা খোলা থাকে৷ অথবা শীতকালে হিটার কাজ করে না, অর্থাৎ ঠান্ডায় কাটাতে হয়৷ বাড়ির মালিককে কয়েকবার বলেও ঠিক করানো যায়নি৷ এভাবেই জানান তিন দশক আগে তুরস্ক থেকে জার্মানিতে আসা আহমেদ খালিফি৷
ছবি: DW/C. Ruta
বাড়ির অবস্থা অস্বাস্থ্যকর
আহমেদ খালিফির ছেলে আদেলের বাড়িতেও প্রায় একই সমস্যা৷ বাড়িটি ৪০ বছরের পুরনো হওয়ায় খুবই স্যাঁতসেঁতে, অন্ধকার এবং অস্বাস্থ্যকর৷ এ ব্যাপারে অবশ্য বাড়িওয়ালার মাথা ব্যথা নেই, কয়েকবার বলেও কোনো কাজ হয়নি৷
ছবি: DW/C. Ruta
অবশেষে নিজেই দায়িত্ব নেন
আবদাল ১৫ বছর এ বাড়িতে আছেন, কিন্তু একবারও রঙ করা হয়নি৷ আর সেকথা বাড়ির মালিককে কয়েকবার বলায় তিনি জানিয়ে দিয়েছেন যে, প্রয়োজনে তিনি যেন নিজেই এ কাজ করে নেন৷ তাই আবদাল এ কাজ ভালো না জানা সত্ত্বেও নিজেই করছেন৷
ছবি: picture-alliance/dpa/dpaweb
শীতের কথা ভেবে ভীত
একটি মাত্র ঘর আর সেখানেই বাচ্চাদের নিয়ে থাকেন আলিয়া৷ ঘরে যেসব জিনিসের জায়গা হয় না, সেসব জিনিস স্থান পেয়েছে বাড়ির বারান্দায়৷ কিন্তু শীতের সময় এসব প্রয়োজনীয় জিনিসের কি হবে – তা ভেবে অস্থির আলিয়া৷ এই অবস্থা অবশ্য শুধু আলিয়ার একার নয়৷
ছবি: DW/C. Stefanescu
অভিবাসীদের বেশি সন্তান
অভিবাসীদের বাড়ির বড় সমস্যা৷ তার কারণ, তাঁরা বড় শহরগুলোর ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় বসবাস করতে পছন্দ করেন৷ তাছাড়া জার্মানদের তুলনায় অভিবাসীরা কম রোজগার করেন এবং তাঁদের সন্তান সংখ্যা বেশি হওয়ায় বাড়ি পেতেও অসুবিধা হয়৷ এছাড়া একই ধরণের বাড়ির জন্য জার্মানদের তুলনায় তাঁদের কাছে বেশি ভাড়াও চাওয়া হয়৷
ছবি: picture-alliance/ZB
বাড়ির অবস্থা করুণ
অভিবাসীদের বাসস্থান সমস্যা অবশ্য নতুন সমস্যা নয়৷ অভিবাসীরা যেসব এলাকায় থাকেন সেই পুরনো বাড়িগুলোকে ঠিকঠাক না করানোয়, দিনদিন সেগুলি জরাজীর্ণ হয়ে পড়ছে৷ এই অবস্থা নিদিষ্ট কোনো শহরে নয়, প্রায় শহরেই এই একই অবস্থা৷
ছবি: Fars
আগুনে পরিবারের আট জনের মৃত্যু
প্রায় চার মাস আগে বাডেন-ভ্যুর্টেমব্যার্গের বাকনাং শহরে একটি বাড়ির বৈদ্যুতিক লাইন ছিল বিপজ্জনক এবং একথা বারবার মালিককে বলার পরও তা ঠিক করা হয়নি৷ যার ফল হয় মর্মান্তিক৷ ঘর গরম বা পানি গরমের জন্য ব্যবহার করা হতো কাঠের চুল্লি৷ ঐ বাড়িতেই আগুন লেগে একজন তুর্কি মা তাঁর সাত সন্তানসহ মারা যান৷ ছবিতে বাকনাং শহরের কিশোর-কিশোরীরা মৃত পরিবারের প্রতি ফুল আর মোমবাতি দিয়ে শ্রদ্ধা জানাচ্ছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
বাড়ি মালিকদের মত
বাড়িওয়ালাদের মধ্যে কেউ কেউ মনে করেন, তুর্কি পরিবারগুলো অনেক বড়, সবসময় হৈচৈ লেগে থাকে এবং তেমন পরিষ্কার- পরিচ্ছন্ন নয়৷ আর সেজন্যই তাঁদের বাড়ি ভাড়া দেওয়ার ব্যাপারে কিছুটা আপত্তি থাকে বাড়িওয়ালাদের৷
ছবি: picture-alliance/dpa
তরুণদের ভিন্নমত
বয়স্ক অভিবাসীরা বাসস্থানের ব্যাপারে যতটা বৈষম্যের শিকার হন বলে মনে করেন, এই প্রজন্মের তুর্কিরা তেমনটা মনে করে না৷ সম্ভবত এই প্রজন্মের ছেলে-মেয়েরা জার্মান ভাষা ভালো জানার কারণেই এমনটা ঘটছে৷
ছবি: Suzheh.sub.ir
10 ছবি1 | 10
‘ভিন্ন ধরনের সংস্কৃতি'
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর দ্রুতই অর্থনৈতিক খাতে উন্নয়ন আনার চেষ্টা করে তৎকালীন পশ্চিম জার্মানি৷ এক্ষেত্রে সফলও হয় তারা৷ এই সাফল্যকে বিবেচনা করা হয় ‘‘ইকোনোমিক মিরাকেল'' হিসেবে৷ ১৯৬০ সালের দিকে তুরস্ক থেকে প্রচুর অতিথি শ্রমিক আনে জার্মানি৷ পাশাপাশি ইটালি, গ্রিস, পর্তুগাল, টিউনিশিয়া এবং সাবেক ইউগোস্লাভিয়া থেকেও অনেক শ্রমিক আসে৷
থ্যাচারের সঙ্গে বৈঠকে কোল বলেছিলেন, ‘‘জার্মানিতে পর্তুগিজ, ইটালীয় এবং এমনকি দক্ষিণ-পূর্ব এশীয়দের নিয়েও কোনো সমস্যা নেই৷ এসব দেশের নাগরিকরা ভালোভাবে সমাজের মূল ধারার সঙ্গে অঙ্গীভূত হচ্ছেন৷''
‘‘কিন্তু তুর্কিরা সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের সংস্কৃতি থেকে এসেছে...'', বলেন কোল৷ এক্ষেত্রে তুর্কি সমাজে জোরপূর্বক বিয়ের বিষয়টি উল্লেখ করেন তিনি৷
বর্তমানে তিন মিলিয়নের মতো তুর্কি বংশোদ্ভূত মানুষ জার্মানিতে বসবাস করছেন৷ এদের অনেকেই জার্মান নাগরিকত্ব গ্রহণ করেছেন৷ সামাজিক গণতন্ত্রী এবং সবুজ দল অভিবাসীদের বিষয়ে নিয়মনীতি উদার করার পর জার্মান নাগরিকত্ব গ্রহণ করেন তারা৷ বর্তমানে জার্মানির মোট জনসংখ্যা ৮২ মিলিয়ন, এদের মধ্যে সাত মিলিয়ন অভিবাসী৷