আজকের যুগে প্রায় সব ক্ষেত্রেই টেকসই ও পরিবেশবান্ধব প্রক্রিয়া চালু করার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে৷ এবার জার্মানিতে বাসি পাউরুটি দিয়ে বিয়ার ব্রিউয়িং সেই প্রবণতার অংশ হয়ে উঠছে৷ স্বাদে কিন্তু কোনো আপোশ করা হচ্ছে না৷
বিজ্ঞাপন
বিয়ার বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় উত্তেজকগুলির মধ্যে পড়ে৷ সোনালী এই পানীয় তৈরি করতে উপাদান হিসেবে মল্ট, হপস, পানি এবং ইস্ট লাগে৷ কিন্তু সেই প্রক্রিয়াকে আরও সৃজনশীল করে তুলতে কিছু মানুষ ‘ব্রেড বিয়ার' তৈরি করছেন৷
বাসি রুটি দিয়ে বিয়ার? সেটা কি আদৌ সম্ভব? বার্লিনের এক বিয়ার প্রস্তুতকারক সেই প্রক্রিয়া জানেন৷ মিশায়েল লেম্বকে এমন বেকিং পণ্য দিয়ে অ্যালকোহল-মুক্ত বিয়ার তৈরি করেন, যা সাধারণত ফেলে দেওয়া হতো৷ এমন ভাবনার প্রেক্ষাপট তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘‘খাবারের অপচয় ও টেকসই প্রক্রিয়া আজ বিশাল চর্চার বিষয় হয়ে ওঠায় আমাদের মাথায় ব্রেড বিয়ারের আইডিয়া এসেছিল৷ বিশেষ করে বিশাল পরিমাণে পাউরুটি তৈরি করা হয়, যার একটা উল্লেখযোগ্য অংশ শেষ পর্যন্ত শুকরের খোরাক হিসেবে অথবা বায়ো গ্যাস প্লান্টে কাজে লাগাতে হয়৷ সেটা সত্যি দুঃখের বিষয়৷ সে কারণে আমরা এই বিয়ারের উপাদান হিসেবে পাউরুটিও ব্যবহার করতে চেয়েছিলাম৷ এভাবে বিষয়টির প্রতিও মনোযোগ আকর্ষণ করতে চেয়েছিলাম৷''
অপচয় রোধে বাসি পাউরুটি দিয়ে বিয়ার তৈরি
04:33
যে সব ব্রিউয়ারি পাউরুটি দিয়ে বিয়ার উৎপাদন করে, তারা আসলে যতটা সম্ভব সম্পদ পুনর্ব্যবহার করতে এবং বর্জ্য এড়াতে চায়৷ প্রায় ২৭,০০০ বোতল ব্রেড বিয়ার তৈরি করতে প্রায় ৭৫ কিলোগ্রাম বাসি পাউরুটির প্রয়োজন হয়৷ বার্লিনের মাস্টার বেকার টেও ক্যোস্টার নিখুঁতভাবে উৎপাদনের পরিকল্পনা করলেও কিছু অবশিষ্ট থেকেই যায়৷ তবে সব ধরনের রুটি বিয়ার তৈরির জন্য উপযুক্ত নয়৷ মাস্টার বেকার হিসেবে টেও ক্যোস্টার বলেন, ‘‘সেই পাউরুটি এমন হতে হবে, যার মধ্যে শস্য ছাড়া অন্য কোনো উপাদান থাকবে না৷ অর্থাৎ কিশমিশ, বাদাম, তেলের বীজ থাকলে চলবে না৷ কারণ গাঁজন প্রক্রিয়ায় বিঘ্ন ঘটবে এবং এমন সুস্বাদু বিয়ার তৈরি হবে না৷''
পাউরুটি দিয়ে পানীয় তৈরি মোটেই নতুন কোনো আবিষ্কার নয়৷ কয়েক'শো বছর ধরে সেই ধারা চলছে৷ যেমন মিশরের ‘বোজা' বা মধ্যযুগে ইউরোপের পূর্বাঞ্চলের ‘কোয়াস'৷ বিগত কয়েক বছরে ব্রেড বিয়ারের পুনর্জন্ম ঘটেছে৷ ফলে মিশায়েল লেম্বকের মতো ক্রাফট বিয়ার ব্রিউমাস্টারের মাথায় নতুন আইডিয়া আসছে৷ তিনি প্রথমে বাসি পাউরুটির ছোট ছোট টুকরো করছেন এবং ব্রিউয়িং প্রক্রিয়ার শুরুতেই সেই মণ্ড যোগ করছেন৷ জটিল প্রক্রিয়ার ধাপগুলি বর্ণনা করে মিশায়েল বলেন, ‘‘এই ম্যাশ টুনে আমরা পানি ও মল্ট গ্রিস্ট মেশাই৷ এনজাইম সক্রিয় করে তোলা হয়, যা তারপর মাড় থেকে শর্করা তৈরি করে৷ সেই প্রক্রিয়ার জন্য প্রায় এক ঘণ্টা সময় লাগে৷ এই বিয়ারের বিশেষত্ব হলো এই যে, আমরা মণ্ডের মধ্যে পাঁচ শতাংশ পাউরুটি দেই৷ তারপর আমরা সেই মণ্ড পাম্প করে লটার টানে ঢুকিয়ে দেই৷ এখানে কঠিন ও তরল আলাদা করা হয়৷ সেই তরলই তথাকথিত ‘বিয়ার ওয়ার্ট', যা আমরা পরে ফোটাই৷''
তারপর শুধু ইস্ট যোগ করা হয়৷ ইস্ট সাধারণত শর্করাকে অ্যালকোহলে রূপান্তরিত করে৷ তবে ব্রেড বিয়ারের ক্ষেত্রে সেটা করা হয় না৷ মিশায়েল লেম্বকে বলেন, ‘‘এই অ্যালকোহল-মুক্ত ব্রেড বিয়ারের জন্য আমরা বিশেষ ধরনের ইস্ট ব্যবহার করি, যা শুধু চিনি গাঁজন করতে পারে৷ উদ্বৃত্ত চিনি বিয়ারেই থেকে যায়৷ ফলে বেশি অ্যালকোহল সৃষ্টি হয় না৷''
জার্মানিতে কোনো পানীয়র মধ্যে অ্যালকোহলের মাত্রা শূন্য দশমিক পাঁচ শতাংশ পর্যন্ত থাকলে সেটিকে অ্যালকোহল-ফ্রি হিসেবে গণ্য করা হয়৷ ব্রিউয়িং প্রক্রিয়ার পর বিয়ার শুধু বোতলে ভরে বিক্রির জন্য প্রস্তুত করা হয়৷ সেই ব্রেড বিয়ারের স্বাদ গ্রাহকদের ভালোই লাগে৷
বর্জ্য এড়ানো ও কাচামাল সাশ্রয়ই হলো মূলমন্ত্র৷ ব্রেড বিয়ার দেখিয়ে দিচ্ছে, যে স্বাদের ক্ষেত্রে কোনো আপোশ না করেও বিয়ার ব্রিউয়িং প্রক্রিয়াও টেকসইভাবে সাজানো সম্ভব৷
ইয়োসেফিনে গ্যুন্টার/এসবি
ছয়টি গ্লাসে পৃথিবীর ইতিহাস
ব্রিটিশ সাংবাদিক ও লেখক টম স্ট্যানডেজের ২০০৫ সালে প্রকাশিত একটি বই নজর কেড়েছিল অনেকের৷ মূলত সেই বইটি নিয়ে এই ছবিঘর৷ পানীয় কেমন করে পৃথিবীর ইতিহাস লিখেছে সেই গল্প বলেছেন লেখক৷
ছবি: picture-alliance/Phanie
ঐতিহাসিক ঘটনার মজার দিক
ব্রিটিশরা যুক্তরাষ্ট্র কেন ছাড়ল? একটা বড় কারণ কিন্তু রামের (এক রকমের মদ) ওপর কর বসানো৷ আচ্ছা কফির সঙ্গে ফরাসী বিপ্লব জড়িয়ে আছে ওতোপ্রোতভাবে, জানতেন আপনি? কিংবা এটা জানেন যে,একজন সোভিয়েত জেনারেল কোকাকোলাকে ভদকা বলে চালিয়ে দিতে চেয়েছিলেন?
ছবি: picture-lliance/The Holbarn Archive/Leemage
শুরুটা বিয়ারের গ্লাসে
বরফ যুগের পরপরই বিয়ারের প্রচলন শুরু৷ অর্থাৎ যিশুর জন্মের প্রায় ১০ হাজার বছর আগে৷ ‘ফার্টাইল ক্রিসেন্ট’ নামে পরিচিত বর্তমান মধ্যপ্রাচ্য ও মিশরে এর জন্ম৷ তখন এখানে এত বুনো শস্য জন্মাত যে উদ্বৃত্ত শস্য ভিজিয়ে রেখে পরে তা থেকে বিয়ার তৈরি শিখে ফেলে স্থানীয়রা৷ এই মদিরায় এমনই মজেছিল তারা এর বিপুল উৎপাদন শুরু করে দেয়৷ তারা খামার তৈরি করে এবং এক জায়গায় স্থায়ী হতে শেখে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/A. Gebert
ওয়াইনের গ্লাসে ‘স্ট্যাটাস সিম্বল’
মেসোপটেমিয়া অঞ্চলের অ্যাসিরিয়া রাজ্যে প্রথম ওয়াইন তৈরি হয়৷ ওয়াইন মূলত সমাজে শ্রেণিবিভাজনকে স্পষ্ট করে তোলার একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুসঙ্গ হিসেবে কাজ করে৷ তখন এটি ছিল এলিটদের পানীয়৷ পরবর্তীতে গ্রিকদের কাছে এসে ওয়াইন আরেকটু সহজলভ্য হলেও ভালো ওয়াইনগুলো ছিল উঁচুশ্রেণির কাছেই৷ রোমানরাও সেই একইপথ অনুসরণ করে৷ তখন বিয়ার ছিল বারবারিয়ানদের পানীয়৷
ছবি: picture allianc/dpa/R.Weihrauch
ইউরোপের অ্যালকোহল
আরবে প্রথম অ্যালকোহল আবিষ্কার হলেও তা ঔষধের কাজে ব্যবহৃত হত৷ কিন্তু ইউরোপীয়রা মদ হিসেবে এর এমন সম্ভাবনা দেখল যে, সারা পৃথিবীতে এর বাজারজাত করা শুরু করল৷ এতে তাদের উপনিবেশ তৈরি করা অনেক সহজ হলো৷ যেমন, ১৬০০ শতাব্দীর দিকে তারা ক্যারিবীয় দ্বীপ বারবাডোসে আখ ও চিনি উৎপাদন শুরু করল৷ রামের অনেক চাহিদা ছিল এবং রামের জন্য এই চিনি দরকার ছিল৷
ছবি: picture-alliance/imageBroker/Creativ Studio Heinemann
রামের কারণে হাতছাড়া অ্যামেরিকা
১৭৩৩ সালে ব্রিটিশরা অ্যামেরিকাতে নিয়ম করল, তারা যদি ব্রিটিশ কলোনি ছাড়া আর কোথাও থেকে গুড় আমদানি করে তাহলে কর দিতে হবে৷ কিন্তু অ্যামেরিকান কলোনিস্টরা তা না মেনে চোরাই পথে উচ্চ মানের ফ্রেঞ্চ গুড় আমদানি করতে লাগল৷ এভাবেই ব্রিটিশ আইন লঙ্ঘন করতে করতে একটা সময় বিপ্লবী যুদ্ধ শুরু করল অ্যামেরিকানরা৷
ছবি: picture-alliance/empics/S. Parsons
কফি বদলে দিল সমাজব্যবস্থা
মধ্যযুগে আরবে কফির প্রচলন শুরু হলো৷ ইউরোপে এল সতেরশ’ শতাব্দীতে৷ এসেই সাড়া ফেলে দিল৷ ইউরোপের বিশেষ করে বুদ্ধিজীবীরা দিনের পানীয় হিসেবে কফিকে গ্রহণ করল কারণ, এটা বিয়ার বা ওয়াইনের মতো মাতাল করে না৷ ঠিকঠাক অবস্থায় কাজ করা যায়৷ ইউরোপজুড়ে কফি হাউজ খুলতে লাগল৷ এমনকি ফরাসী বিপ্লবের কারিগররা এই কফিশপগুলোতেই বিপ্লবের নকশা আঁকা শুরু করেন৷
ছবি: DW/K. Schenk
চীনাদের চা হয়ে উঠল আভিজাত্যের প্রতীক
চীনাদের চা প্রথম ডাচরা আমদানি করল সতেরশ’ শতকে৷ ক্রমে ব্রিটিশরাও তা পছন্দ করল৷ প্রথমে উঁচু শ্রেণির মানুষের কাছে ফ্যাশন হয়ে উঠল এই পানীয়৷ পরে নিচু শ্রেণির মানুষেরাও শ্রেণি উন্নয়ন করতে তা পান করতে লাগল৷ বিশেষ করে নারীদের কাছে এই পানীয় হয়ে উঠল খুবই আকর্ষণীয়৷ কারণ সন্ধ্যার পর কফি হাউজে তাদের ঢোকা নিষেধ ছিল৷ কিন্তু চায়ের দোকানে যেতে পারতেন তারা৷
ছবি: picture-alliance/Phanie
চা ও ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ক্ষমতা
চায়ের জনপ্রিয়তা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে প্রভাবশালী করে তুলল৷ তারা ব্রিটেনে চা রপ্তানি করত এবং এতই আয় করত যে, ব্রিটিশ সরকারি সিদ্ধান্তে হস্তক্ষেপ করতে পারত৷ তারা এমনকি যুক্তরাষ্ট্রে চা রপ্তানি করা শুরু করল, তাও বিনা শুল্কে৷ অথচ তারা ব্রিটিশ সরকারকে বাধ্য করল স্থানীয় অ্যামেরিকান ব্যবসায়ীদের ওপর কর বসাতে৷ মার্কিন বিপ্লবের অনেক কারণের একটি এই কর৷
আরো একশ’ বছর পর কোকা-কোলা আবিষ্কার হলো যুক্তরাষ্ট্রে৷ বৈশ্বিক পানীয়র তালিকায় এটিই অ্যামেরিকার সবচেয়ে বড় অবদান৷ গ্যাস মিশ্রিত পানির সঙ্গে কোকা মিশিয়ে এই পানীয় তৈরি করে খুব দ্রুতই জনপ্রিয় করে তোলেন জন পেমবার্টন নামের এক ব্যক্তি৷ প্রথমে মার্কিনিরা পানীয়টি নিয়ে খুবই রক্ষণশীল থাকলেও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সারা পৃথিবীতে একে ছড়িয়ে দেন৷ অর্থনীতি ও রাজনীতিতেও ভূমিকা রাখতে শুরু করে কোকা-কোলা৷