জার্মানিতে নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যাওয়ায় দুশ্চিন্তা বাড়ছে ভোক্তাদের৷ ৩০ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ মূল্যবৃদ্ধি এটি৷ এর ফলে দরিদ্র শ্রেণির মানুষ সবচেয়ে বেশি বিপদে পড়বে৷
বিজ্ঞাপন
একদিকে জাঁকিয়ে শীত, অন্যদিকে বৃষ্টি, তার মধ্যেই পশ্চিম জার্মানির বন শহরের একটা খাবারের দোকানের (টাফেল) সামনে তাঁবু খাটিয়ে অপেক্ষা করছিলেন স্বেচ্ছাসেবকরা৷ টাটকা সবজি, ফল ও অন্য জরুরি জিনিস পাশের সুপারমার্কেট থেকে নিয়ে এসেছেন তারা৷ অবসরকালীন সামান্য ভাতা পান এমন ব্যক্তি, বেকার এবং স্থানীয় গরিব মানুষদের মধ্যে বিতরণ করা হবে বেঁচে যাওয়া বেশ কিছু খাবার, যদিও এগুলো বাজারে বিক্রির মতো টাটকা নয়৷
জার্মানদের প্রিয় ১০টি সুপ
জার্মানরা সুপ তৈরিতে ওস্তাদ৷ প্রায় প্রতিটি মৌসুম ও প্রত্যেক এলাকার জন্য কোনো-না-কোনো বিশেষ সুপের নাম করা যায়৷ বলতে কি, ডাল-ভাত বা রুটি-সবজি মতো জার্মানিতে সুপ আর রুটি একটি আটপৌরে খাবার, যেমন গরীবদের, তেমন বড়লোকদের৷
ছবি: picture-alliance/CHROMORANGE/S. Bogdanski
কুমড়োর সুপ
জার্মানিতে কুমড়ো ফলে না; অথচ হেমন্তে, মানে হ্যালোইনের সিজনে জার্মানির প্রায় সব রেস্টুরেন্টের মেনুতেই কুমড়োর সুপ থাকবেই থাকবে৷
ছবি: picture-alliance/CHROMORANGE/S. Bogdanski
প্যানকেকের সুপ
রেসিপিটা এসেছে খুব সম্ভবত অস্ট্রিয়ার টিরোল এলাকা থেকে, দক্ষিণ জার্মানিতে এই ‘ফ্ল্যেডলে’ সুপের চল খুব৷ প্যানকেকের সরু সরু চাকলি আর মাংসের সুরুয়া দিয়ে তৈরি হয়৷ অন্য সব সুপের মতোই পেঁয়াজ জাতীয় ‘চাইভ’ ও ‘লিক’, তেজপাতা, ‘পার্সলে’, নুন-মরিচ ইত্যাদি যোগ করে স্বাদ বাড়িয়ে নেওয়া হয়৷ তবে প্যানকেকগুলো হয়তো প্রাতরাশ থেকে বেঁচে গেছে!
ছবি: picture-alliance/dpa/B. Weißbrod
সেমোলিনার সুপ
সেমোলিনা মানে গমের শুঁড়ি, না বুঝলে ইটালীয় পাস্তার কথা ভেবে নিন – তাই দিয়ে তৈরি ‘ডাম্পলিং’ কিংবা বড়া৷ সেই বড়া সবজি বা মাংসের ঝোলে দিয়ে এই সুপ তৈরি হয়৷ তাতে অল্পস্বল্প দুধ, ফেটানো ডিম, মাখন, ‘নাটমেগ’, গাজরের টুকরো, ‘চাইভ’ ইত্যাদি দেওয়া যেতে পারে৷ পালং শাক বা মাছের ঝোলে ‘ডাম্পলিং’ দিয়েও এই সুপ বানানো হয় বাভেরিয়ায়৷
ছবি: imago/CHROMORANGE
বিয়ার সুপ
রেসিপিটা বিয়ারের রাজ্য বাভেরিয়া থেকে এসেছে, যেখানকার মানুষ বিয়ার খেতে এত ভালোবাসেন যে, তা দিয়ে সুপ বানাতেও তাদের দ্বিধা নেই৷ পেঁয়াজ কুচিয়ে মাখনে অল্প ভেজে নিয়ে, তাতে টোস্ট করা পাউরুটির গুঁড়ো মিশিয়ে, পরে মাংসের সুরুয়া দিয়ে ফুটিয়ে নিয়ে বিয়ার আর নুন-মরিচ যোগ করলেই হয়ে গেল বিয়ারের সুপ৷ ওপরে চাকলি করে কাটা ‘চাইভ’ বা পেঁয়াজ ছড়াতে পারেন৷
ছবি: picture-alliance/Dumont Bildarchiv/C. Bäck
কড়াইশুঁটির সুপ
এটি পশ্চিমের নর্থ রাইন ওয়েস্টফেলিয়া রাজ্যের একটি ক্লাসিক৷ রঙটা কড়াইশুঁটির মতোই সবুজ, তাতে সসেজের টুকরো দেওয়া থাকতে পারে৷ সাথে দেওয়া হয় একটা ব্রেড রোল৷ কোলন কার্নিভালের সময় খুব চলে৷
ছবি: Imago/allOver-MEV
মাছের সুপ
অবশ্যই উত্তর জার্মানির খাবার, বলতে কি, একেবারে উপকূলের৷ জার্মান সুপ ইনস্টিটিউটের মতে হামবুর্গকে জার্মানির ‘সুপের রাজধানী’ বলা চলে – হবে না-ইবা কেন, হামবুর্গ যে জার্মানির বৃহত্তম বন্দর৷ মাছের সুপে মাছ ছাড়া চিংড়ি, কাঁকড়া, ‘মাসেল’ বা ঝিনুক, সব কিছুই থাকতে পারে৷
ছবি: Imago/D. Schvarcz
আলুর সুপ
বার্লিনের রেস্টুরেন্টগুলোর মেনুতে আলুর সুপ থাকতে বাধ্য, যদিও তাকে সুপ না বলে ‘স্টু’ বলাই ভালো৷ তবে বার্লিন কিংবা কাছের ব্রান্ডেনবুর্গে যবের সুপ, সিরাপ আর আলুবোখারা দেওয়া মাংসের সুপ, অ্যাস্পারাগাসের টুকরো দেওয়া চিংড়ির সুপ- এ সবও পাবেন৷
ছবি: Colourbox/C. Fischer
গুলাশ সুপ
এই সুপটি আদতে হাঙ্গেরি থেকে এসেছে৷ আসলে ঘন করে ঝোল সুদ্ধ রাঁধা মাংস ছাড়া আর কিছু নয়, যা নুডল কিংবা আলুর সঙ্গে খাওয়া যায়৷ সেই রান্নাটিকেই আরো কিছুটা পাতলা করে জার্মানিতে গুলাশ সুপ বলে চালানো হয়, বিশেষ করে শীতকালে৷
ছবি: Colourbox/neirfy
বুনো রসুনের সুপ
রসুন গাছের পাতা আর ফুল থেকেই এই সুপের নাম ও স্বাদ – রসুনের কোয়া থেকে নয়৷ সুপের রঙটাও সাদা নয়, সবুজ৷
ছবি: Fotolia
অ্যাস্পারাগাস ক্রিম সুপ
অ্যাস্পারাগাসের বাংলা নাম হলো শতমূলী৷ এই সবজিটি জার্মানদের বিশেষ প্রিয়, বিশেষ করে বসন্তের শেষে যখন অ্যাস্পারাগাস ওঠে৷ শীতেও গতানুগতিক ক্রিম সুপ বানিয়ে, তারপর ক্যান খুলে তাতে কিছু অ্যাস্পারাগাসের টুকরো মিশিয়ে নিলে বেশ একটা বসন্তের আমেজ পাওয়া যায়, নয় কি?
ছবি: Imago
10 ছবি1 | 10
টাফেলের এক স্বেচ্ছাসেবী গুন্টার গিজা ডয়চে ভেলেকে বলেন, মাসের শেষে নিঃস্ব মানুষজন এসে জিজ্ঞাসা করছেন, আরও একটু বেশি খাবার পাওয়া সম্ভব কি না৷ বোঝাই যাচ্ছে, এই মূল্যবৃদ্ধি উদ্বেগজনক, যা কোনওভাবেই পূরণ করা সম্ভব নয়৷
কয়েক দশকের মধ্যে এমন ঘটনা ঘটেনি
বুধবারের পরিসংখ্যান বলছে, ২০২১ সালে জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে ৩.১ শতাংশ৷ এই মূল্যবৃদ্ধি ৩০ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ৷ তুলনা করলে দেখা যাচ্ছে, ২০২০ সালের ডিসেম্বরের তুলনায় ২০২১ সালের ডিসেম্বরে প্রায় ৫ শতাংশ মূল্যবৃদ্ধি হয়েছে৷
বিশ্বজুড়ে জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে৷ জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি এর একটা বড় কারণ৷ মহামারির নিয়ন্ত্রণবিধি উঠে যাওয়ায় জ্বালানির চাহিদা বেড়েছে৷ পাশাপাশি, ওপেক গোষ্ঠী ধীরে ধীরে মহামারির আবহের ক্ষতির দিকগুলো পুনরুদ্ধার করা শুরু করেছে৷
জ্বালানি ব্যবহারের বাড়তি খরচ, সামগ্রিক উত্পাদন ব্যয়কে বাড়িয়ে তুলছে৷ নির্মাতারা বলছেন, এটি প্রতিযোগিতামূলক মূল্য নির্দিষ্ট করা কঠিন করে তুলেছে৷ মূল্যবৃদ্ধির জেরে গ্রাহকদের নাভিশ্বাস উঠেছে, এদিকে ব্যবসায়ীরাও কূল পাচ্ছেন না৷
করাতের ব্লেড নির্মাতা সংস্থার এক কর্মকর্তা হেইনো বুডেনবার্গ বলেন, ‘‘১৯৫০ সাল পর্যন্ত বস্ত্রশিল্প জার্মানি বেশ উন্নত ছিল, ধীরে ধীরে সম্পূর্ণ ব্যবসা এশিয়ায় চলে যায়৷ আমাদের শিল্পের ক্ষেত্রেও এমনটা হোক তা আমি চাই না৷''
জার্মান সসেজ খাওয়ার সাত উপায়
আপনি ভালোবাসুন বা ঘৃণা করুন - জার্মানি সসেজের জন্য বিখ্যাত৷ এখানে থাকছে মাংস দিয়ে তৈরি এই খাদ্য খাওয়ার সাতটি উপায়৷
ছবি: picture-alliance/dpa/M. Schutt
ব্রাটভ্যুর্স্ট
জার্মানিতে অনেকের পছন্দ এটি আর প্রত্যেক অঞ্চলের আবার ব্রাটভ্যুর্স্টের নিজস্ব সংস্করণ রয়েছে৷ আকার, গঠন আর মশলা গুড়া দিয়ে সাজানোর বিষয়গুলো বিবেচনায় আনলে ৫০ রকমের ব্রাটভুর্স্ট রয়েছে জার্মানিতে৷ যদিও জার্মানরা এখন ‘ব্রাট’ বলতে ‘ব্রাটেন’ মানে ভাজা বা পোড়ানো বোঝায়, আদতে এই শব্দের অর্থ হচ্ছে সুন্দর করে কাটা মাংস৷
ছবি: picture alliance/dpa Themendienst/M. Scholz
ন্যুরেনবার্গার
ব্রাটভ্যুর্স্টের বিভিন্ন সংস্করণের মধ্যে ন্যুরেনবার্গে তৈরিটি আকারের কারণে সহজেই সনাক্ত করা যায়৷ এটা অস্বাভাবিক ছোট৷ অনেকটা ছোট আঙ্গুলের মতো৷ ইতিহাসের পাতায় সেই ১৩১৩ সাল থেকে এই ভ্যুর্স্টের অস্তিত্ব রয়েছে৷ এই ভ্যুর্স্ট আগুনে পুড়িয়ে এবং ছয়টি এক সঙ্গে পরিবেশনের রীতি রয়েছে৷
ছবি: picture alliance/chromorange
কারিভ্যুর্স্ট
কারিভ্যুর্স্ট হচ্ছে ভাপে সেদ্ধ করা এক ব্রাটভ্যুর্স্ট যা ক্যাচআপ আর কারি পাউডার দিয়ে সাজিয়ে পরিবেশন করা হয়৷ যে দেশ উচ্চপ্রযুক্তির গাড়ি বানিয়ে বিখ্যাত, সে দেশের কেউ এমন ব্রাটভ্যুর্স্ট উদ্ভাবন করেছেন বললে হয়ত বিশ্বাস হবে না৷ তবে বাস্তবতা হচ্ছে, বার্লিনের পাচক হার্থা হাওয়ার এই বিশেষ সসেজ তৈরি করেছেন এবং সেটি ১৯৫৯ সালে নিজের নামে পেটেন্টও করে নিয়েছেন৷
ছবি: Fotolia/koi88
ভাইসভ্যুর্স্ট
এই সসেজের এমন নামের কারণ হচ্ছে তার রঙ৷ বেশিদিন টিকিয়ে রাখার জন্য এই সসেজের মধ্যে বিশেষ কোনো উপাদান দেয়া হয়না, এমনকি সেদ্ধও করা হয়না৷ ফলে এটি যেদিন তৈরি করা হয়, সেদিনই খেতে হয়৷
ছবি: Fotolia
ব্ল্যুটভ্যুর্স্ট
ব্ল্যুটভুর্স্ট বা রক্ত সসেজ সাধারণত শুকরের রক্ত এবং শুকনো মাংস দিয়ে তৈরি করা হয়৷ যেহেতু এটা আগে থেকেই রান্না করা থাকে, তাই গরম খাওয়ার দরকার নেই, যদিও কেউ কেউ গরম করে নেন৷
ছবি: picture-alliance/dpa/CHROMORANGE
লান্ডজ্যগার
লান্ডজ্যগার হচ্ছে সেদ্ধ করা আধা শুকনো সসেজ যা জার্মান ভাষাভাষী বিভিন্ন দেশে তৈরি করা হয়৷ এটা ফ্রিজে না রাখলেও অনেকদিন খাওয়া যায়, যে কারণে হাইকার এবং সৈন্যদের মাঝে এটি বিশেষ জনপ্রিয়৷
ছবি: Imago/McPHOTO
মেটভ্যুর্স্ট
এটা আরেক ধরনের সসেজ যা অঞ্চল ভেদে ভিন্ন হতে পারে৷ ফ্লেভার দেয়া কিমা করা মূলত শুকর, তবে কখনো কখনো গরুর মাংস দিয়েও এই সসেজ তৈরি করা হয়৷ এগুলো আবার বিশেষ ধোঁয়াশা পরিবেশে সংরক্ষণ করা হয়৷
ছবি: picture-alliance/dpa/M. Schutt
7 ছবি1 | 7
অতীতের ক্ষত
প্রথম বিশ্বযুদ্ধে হেরে যাওয়া এবং তারপর ১৯২৩ সালে দ্রব্যমূল্যের চরম ঊর্ধ্বগতির ফলে দৈনিক হারে অর্থ দেওয়া হত কর্মীদের৷ অর্থের মূল্য কমে যাওয়ার আগে গিয়ে জিনিসপত্র কিনে ফেলতে ছুটোছুটি করতে হত সেইসময়৷ এরপর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এবং পরবর্তীতে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত সংকটে ভুগেছে জার্মানি৷
মার্কিন অর্থনীতিবিদ এবং নোবেলজয়ী রবার্ট শিলারের মতে, তাত্ত্বিক মূল্যবৃদ্ধির ভীতিও অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে৷ বর্তমান মূল্যবৃদ্ধি যথেষ্ট উদ্বেগজনক৷ বিপদে পড়তে পারেন অনেকে৷
টাফেলের স্বেচ্ছাসেবী গিজা ডয়চে ভেলেকে জানান, ৮০ ইউরোর বদলে ১০০ ইউরো দিতে হচ্ছে গ্যাস স্টেশনে৷ দরিদ্র মানুষজন ভাবছেন, পাউরুটি কেনা লাভজনক হবে নাকি সেই টাকায় দুধ কিনবেন৷ সব জিনিসের দাম বেড়ে গিয়েছে৷
ইউরোপিয়ান সেন্ট্রাল ব্যাংক (ইসিবি) উচ্চ সুদের হার দিয়ে মূল্যবৃদ্ধিকে সামলানোর ধারণায় বিশ্বাসী নয়৷ ইসিবির মতে, মহামারির ফলে সরবরাহের সমস্যাগুলির সঙ্গে মূল্যবৃদ্ধির যোগ রয়েছে, তবে এটি অস্থায়ী৷