গরিবি হটানোর মানে গরিব হটানো, যা উন্নয়নের নামে, বিশ্বকাপের নামে কিংবা শৃঙ্খলা ও সুন্দর পরিবেশের নামে করা যায় – যেমন ধনী দেশ জার্মানিতে৷ এখানে রাস্তায় বাস করা নিরাশ্রয় মানুষদের সংখ্যা বেড়েই চলেছে৷
বিজ্ঞাপন
হামবুর্গ, বার্লিন, ফ্রাংকফুর্ট অথবা মিউনিখ, জার্মানির সব বড় শহরেই এদের পাওয়া যাবে: সেই সব মানুষ, যাঁরা চাকরি হারিয়ে, স্ত্রী-সন্তানের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে, শেষমেষ মাথা গোঁজার স্থানটুকুও হারিয়ে রাস্তার ভবঘুরেতে পরিণত হয়েছেন৷ এঁরা যে ঠিক বুভুক্ষু, এমন নয়৷ অসুখ করে রাস্তায় পড়ে থাকলে এঁদের তুলে নিয়ে গিয়ে হাসপাতালে রাখা হয়, প্রয়োজনে চিকিৎসা এমনকি অস্ত্রোপচার করা হয়৷ কিন্তু সেরে উঠলে আবার রাস্তায়৷
জার্মান ভাষায় এঁদের বলে ‘পেনার', অর্থাৎ সহায়-সম্বলহীন নিষ্কর্মা মানুষ৷ কাজকর্ম নেই, সরকারি ভাতা-ভরতুকি নিয়ে বেঁচে থাকা৷ অনেকেরই ধূমপান ও মদ্যপানের প্রতি আসক্তি৷ একটা মানুষ সমাজের সিঁড়ি দিয়ে গড়িয়ে নীচে পড়তে পড়তে যতদূর নামতে পারে আর কি! কিন্তু বিগত কয়েক দশকে এই জীবনযুদ্ধে পরাজিতদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বাড়ি থেকে পালিয়ে আসা কিশোর-কিশোরী, তরুণ-তরণী৷ চাকরি, পরিবার, আশ্রয় হারিয়ে রাস্তায় নেমে এসেছেন বহু মানুষ৷ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন, শৃঙ্খলাবদ্ধ জার্মানির পথেঘাটে এঁরা যেন বেমানান৷ তাই এঁদের জনসমক্ষ থেকে, লোকচক্ষু থেকে সরানোর প্রয়াস৷
জার্মানিতে বাড়ি সমস্যায় অভিবাসীরা
অভিবাসীদের বিভিন্ন ক্ষেত্রেই সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়৷ তবে বাড়ির সমস্যাকে একটি বড় সমস্যা হিসেবে ধরা যেতে পারে৷এ সমস্যা জার্মানিতে বসবসারত তুর্কিদের মধ্যেই বেশি দেখা যায়৷ কারণ জার্মানিতে প্রায় ৪০ লাখ তুর্কি আছেন৷
ছবি: Suzheh.sub.ir
অভিবাসী তুর্কিদের সমস্যা বেশি
জার্মানিতে অভিবাসীদের বিভিন্ন ক্ষেত্রেই সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়৷ এগুলোর মধ্যে বাড়ির সমস্যাকে একটি বড় সমস্যা হিসেবে ধরা যেতে পারে৷ জার্মানিতে অভিবাসীদের মধ্যে তুর্কিদের সংখ্যাই সবচেয়ে বেশি প্রায় ৪০ লাখ৷ কাজেই সমস্যাটাও ওদের ক্ষেত্রেই বেশি দেখা যায়৷
ছবি: picture-alliance/dpa
শীতকালে ঠান্ডায় কষ্ট পায়
তুর্কিদের সাধারণত বাসা ভাড়া দেওয়া হয় পুরনো এলাকায় বহু বছরের পুরনো বাড়িগুলোয়৷ সেই সব বাড়িতে হয়ত দরজা ঠিকমতো বন্ধ হয় না বা জানালা দিয়ে বাতাস ঢোকে বা খানিকটা খোলা থাকে৷ অথবা শীতকালে হিটার কাজ করে না, অর্থাৎ ঠান্ডায় কাটাতে হয়৷ বাড়ির মালিককে কয়েকবার বলেও ঠিক করানো যায়নি৷ এভাবেই জানান তিন দশক আগে তুরস্ক থেকে জার্মানিতে আসা আহমেদ খালিফি৷
ছবি: DW/C. Ruta
বাড়ির অবস্থা অস্বাস্থ্যকর
আহমেদ খালিফির ছেলে আদেলের বাড়িতেও প্রায় একই সমস্যা৷ বাড়িটি ৪০ বছরের পুরনো হওয়ায় খুবই স্যাঁতসেঁতে, অন্ধকার এবং অস্বাস্থ্যকর৷ এ ব্যাপারে অবশ্য বাড়িওয়ালার মাথা ব্যথা নেই, কয়েকবার বলেও কোনো কাজ হয়নি৷
ছবি: DW/C. Ruta
অবশেষে নিজেই দায়িত্ব নেন
আবদাল ১৫ বছর এ বাড়িতে আছেন, কিন্তু একবারও রঙ করা হয়নি৷ আর সেকথা বাড়ির মালিককে কয়েকবার বলায় তিনি জানিয়ে দিয়েছেন যে, প্রয়োজনে তিনি যেন নিজেই এ কাজ করে নেন৷ তাই আবদাল এ কাজ ভালো না জানা সত্ত্বেও নিজেই করছেন৷
ছবি: picture-alliance/dpa/dpaweb
শীতের কথা ভেবে ভীত
একটি মাত্র ঘর আর সেখানেই বাচ্চাদের নিয়ে থাকেন আলিয়া৷ ঘরে যেসব জিনিসের জায়গা হয় না, সেসব জিনিস স্থান পেয়েছে বাড়ির বারান্দায়৷ কিন্তু শীতের সময় এসব প্রয়োজনীয় জিনিসের কি হবে – তা ভেবে অস্থির আলিয়া৷ এই অবস্থা অবশ্য শুধু আলিয়ার একার নয়৷
ছবি: DW/C. Stefanescu
অভিবাসীদের বেশি সন্তান
অভিবাসীদের বাড়ির বড় সমস্যা৷ তার কারণ, তাঁরা বড় শহরগুলোর ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় বসবাস করতে পছন্দ করেন৷ তাছাড়া জার্মানদের তুলনায় অভিবাসীরা কম রোজগার করেন এবং তাঁদের সন্তান সংখ্যা বেশি হওয়ায় বাড়ি পেতেও অসুবিধা হয়৷ এছাড়া একই ধরণের বাড়ির জন্য জার্মানদের তুলনায় তাঁদের কাছে বেশি ভাড়াও চাওয়া হয়৷
ছবি: picture-alliance/ZB
বাড়ির অবস্থা করুণ
অভিবাসীদের বাসস্থান সমস্যা অবশ্য নতুন সমস্যা নয়৷ অভিবাসীরা যেসব এলাকায় থাকেন সেই পুরনো বাড়িগুলোকে ঠিকঠাক না করানোয়, দিনদিন সেগুলি জরাজীর্ণ হয়ে পড়ছে৷ এই অবস্থা নিদিষ্ট কোনো শহরে নয়, প্রায় শহরেই এই একই অবস্থা৷
ছবি: Fars
আগুনে পরিবারের আট জনের মৃত্যু
প্রায় চার মাস আগে বাডেন-ভ্যুর্টেমব্যার্গের বাকনাং শহরে একটি বাড়ির বৈদ্যুতিক লাইন ছিল বিপজ্জনক এবং একথা বারবার মালিককে বলার পরও তা ঠিক করা হয়নি৷ যার ফল হয় মর্মান্তিক৷ ঘর গরম বা পানি গরমের জন্য ব্যবহার করা হতো কাঠের চুল্লি৷ ঐ বাড়িতেই আগুন লেগে একজন তুর্কি মা তাঁর সাত সন্তানসহ মারা যান৷ ছবিতে বাকনাং শহরের কিশোর-কিশোরীরা মৃত পরিবারের প্রতি ফুল আর মোমবাতি দিয়ে শ্রদ্ধা জানাচ্ছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
বাড়ি মালিকদের মত
বাড়িওয়ালাদের মধ্যে কেউ কেউ মনে করেন, তুর্কি পরিবারগুলো অনেক বড়, সবসময় হৈচৈ লেগে থাকে এবং তেমন পরিষ্কার- পরিচ্ছন্ন নয়৷ আর সেজন্যই তাঁদের বাড়ি ভাড়া দেওয়ার ব্যাপারে কিছুটা আপত্তি থাকে বাড়িওয়ালাদের৷
ছবি: picture-alliance/dpa
তরুণদের ভিন্নমত
বয়স্ক অভিবাসীরা বাসস্থানের ব্যাপারে যতটা বৈষম্যের শিকার হন বলে মনে করেন, এই প্রজন্মের তুর্কিরা তেমনটা মনে করে না৷ সম্ভবত এই প্রজন্মের ছেলে-মেয়েরা জার্মান ভাষা ভালো জানার কারণেই এমনটা ঘটছে৷
ছবি: Suzheh.sub.ir
10 ছবি1 | 10
জার্মানি শীতের দেশ, এখানে রাস্তায় শোয়াটা বছরের অধিকাংশ সময় কষ্টকর, শীতে তো প্রায় অসম্ভব৷ তাই পোড়োবাড়ি অথবা কারখানা, পার্কিং হাউসের আনাচ-কানাচ, বাজারের বড় দোকানের সামনের অ্যালকোভ – সর্বত্র কাঁথা-কম্বল পেতে রাত কাটান এই সব মানুষ৷ কখনো কোনো পেট্রোল স্টেশনের বাথরুম পরিষ্কার করে কিছু খেতে পান; কখনো পুরনো বোতল কুড়িয়ে কিছু টাকা রোজগার৷ দিন কাটে৷
জার্মানি ধনী দেশ৷ ২০১২ সালে এখানকার বেসরকারি পরিবারগুলির মোট সম্পত্তি ছিল ৬ দশমিক ৩ ট্রিলিয়ন ইউরো, অর্থাৎ পরিবার প্রতি ৮৩ হাজার ইউরো৷ এ তো হলো সামগ্রিক পরিসংখ্যান, কিন্তু জার্মান অর্থনৈতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠানের বিবরণে এ-ও বলা হয়েছে যে, ইউরো মুদ্রার আর কোনো দেশে ধনী-দরিদ্রের ব্যবধান এত দৃষ্টিকটু নয়৷ জার্মানির জনসংখ্যার এক-পঞ্চমাংশের কোনো সম্পদই নেই৷ সাত শতাংশের সম্পত্তির চেয়ে ঋণ বেশি৷
জার্মানিতে বাড়ি ভাড়া নিতে গেলে যে ধরনের স্থায়ী চাকরি, আর্থিক সঙ্গতি ইত্যাদি দেখাতে হয়, তা না থাকার ফলে ‘নিরাশ্রয়' – বস্তুত স্থায়ী ঠিকানাহীন মানুষদের সংখ্যা বেড়েই চলেছে৷ পরিসংখ্যান বলে, ২০১০ সাল থেকে ২০১২ সালের মধ্যে এ ধরনের নিরাশ্রয় মানুষদের সংখ্যা বেড়েছে ১৫ শতাংশ৷ তা সত্ত্বেও, এই ‘নিরাশ্রয়'-দের সংখ্যা সাকুল্যে দু' লাখ চুরাশি হাজার – আট কোটি মানুষের দেশে৷ ২০১৬ সাল অবধি তা নাকি বেড়ে দাঁড়াবে তিন লাখ আশি হাজারে৷
অভিবাসী মানসিক রোগীদের চিকিৎসায় বড় বাধা ভাষা
মানসিক সমস্যায় চিকিৎসকের সাথে ভালোভাবে কথা বলা মানসিক রোগ চিকিৎসার সবচেয়ে জরুরি বিষয়৷ এই চিকিৎসায় রোগী ও ডাক্তারের মধ্যে ভাষাগত সমস্যা হলে ফলপ্রসু চিকিৎসা বাধাগ্রস্হ হয়৷
ছবি: BPtK
রবার্ট কখ ইন্সটিটিউট-এর হিসেব
রবার্ট কখ ইন্সটিটিউটের হিসেব অনুয়ায়ী জার্মানিতে প্রতি তিনজনের একজন প্রাপ্ত বয়স্ক বছরে অন্তত দুবার মানসিক সমস্যায় ভোগেন৷ তবে সবাইকেই যে মনোরোগ বিশেষজ্ঞের কাছে যেতে হয় তেমন নয়৷
ছবি: Fotolia/ lassedesignen
রোগী এবং ডাক্তারের সম্পর্ক
যাঁদের কষ্ট বেশি তাঁদের অবশ্যই ডাক্তারের কাছে যাওয়া উচিত৷ রোগীর সুস্থ্ হওয়া অনেকটাই নির্ভর করে ডাক্তার এবং রোগীর মধ্যে প্রয়োজনীয় তথ্য বিনিময়ে ভাষাগত মিলের ওপর৷
ছবি: picture alliance/Klaus Rose
দোভাষী
জার্মান ভাষা খুব কম জানেন বা একেবারেই জানেন না এমন অভিবাসী মানসিক রোগীদের খুবই সমস্যায় পড়তে হয়৷ জার্মান ভাষা জানা পরিবারের কেউ সাথে থাকলেও অনেক সময় সবকিছু ঠিকভাবে বোঝানো সম্ভব হয়না৷
ছবি: DW/M. Witt
শতকরা ৯০ জন!
গেলজেন কির্শেনের গেজাম্ট স্কুলে শতকরা ৯০ জন ছাত্রছাত্রীই অভিবাসী পরিবার থেকে আসা, যাঁরা এক অক্ষরও জার্মান ভাষা জানেনা৷ বুলগেরিয়া এবং রোমানিয়া থেকে ওদের বাবামায়েরা জার্মানিতে কাজ করতে এসেছেন গত বছর৷ দুটি দেশই ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য৷
ছবি: DW/S. Auer
উন্নত শিক্ষার বিশেষ ক্লাস
এরই মধ্যে গেলজেন কির্শেন স্কুলের বাচ্চাদের জন্য আলাদাভাবে ভাষা শেখার ব্যবস্থা করা হয়েছে৷ ছাত্রছাত্রীরা যেন তাড়াতাড়ি ভাষা শিখে স্কুলে ঠিকমতো পড়াশোনা করতে পারে সেজন্যই এই উদ্যোগ এবং প্রতিটি ক্লাসে ১৫জন শিক্ষার্থী থাকে-একথা বলেন আখিম এলভার্ট৷
ছবি: DW/S. Auer
সাহায্য সংস্থা ‘স্প্রিন্ট’
এই শূন্যস্থানগুলো কেবল বিশেষ প্রশিক্ষনপ্রাপ্ত দোভাষীই পূরণ করতে পারে৷ রোগী এবং ডাক্তারের দেশের ভাষা এবং সংস্কৃতি সম্পর্কেও জানা থাকে তাঁদের৷ স্প্রিন্ট-এ এ বিষয়ে ১৮মাস প্রশিক্ষন দেওয়া হয়৷স্প্রিন্ট-এর প্রধান হাইকে টিমেন বলেন, ‘সাধারণ রোগের চেয়ে মানসিক রোগ নিরূপন করা অনেক কঠিন৷’
ছবি: picture-alliance/dpa
আরো বিশেষজ্ঞ প্রয়োজন
মনোরোগ বিশেষজ্ঞদের সংগঠনের প্রেসিডেন্ট রাইনার রিস্টার বলেন, কোলোনের মতো বড় শহর যেখানে ৬০,০০০ জার্মান পাসপোর্টধারী তুর্কির বসবাস, সেখানে মাত্র দুজন তুর্কিভাষী মনোরোগ বিশেষজ্ঞ রয়েছেন, যা মোটেই যথেষ্ট নয়৷
ছবি: BPtK
7 ছবি1 | 7
মধ্য ইউরোপের আবহাওয়া, সমাজ ও সংস্কৃতি যাঁরা জানেন, তাঁরা বুঝবেন, সব পেয়েছির দেশেও ‘সর্বহারা' মানুষ থাকে এবং সমাজ ও সংস্কৃতির কল্যাণের জন্যই তাঁদের দিকে নজর দেওয়া প্রয়োজন৷ জার্মানিতে নজর দেওয়া হচ্ছে ঠিকই: দেখা হচ্ছে, কোন পন্থায় এই নিরাশ্রয় মানুষগুলোকে যেখানে তাঁরা শীতের রাতে মাথা গোঁজেন, সেখান থেকে সরিয়ে রাখা যায়৷ কোথাও হয়ত কাঁটাতারের বেড়া দেওয়া হচ্ছে; কোথাও ব্রিজের নীচে তোষক পেতে শোয়া নোটিশ লাগিয়ে নিষিদ্ধ করা হচ্ছে৷ রেলওয়ে স্টেশন কি সাবওয়ে থেকে তাঁদের তাড়ানোর জন্য লোক আছে৷ বড় বড় দোকানের ঢোকার মুখটায় কল থেকে জল ছিটিয়ে নিরাশ্রয়দের বিতাড়ন করা হচ্ছে৷ লন্ডনে দোকানের গেটের সামনে স্পাইক, অর্থাৎ কাঁটা বসিয়ে নিরাশ্রয়দের দূরে রাখা হচ্ছে৷
কি দোকানপাট, কি রেলওয়ে স্টেশন, সর্বত্রই এখন অর্থকরী ‘বাণিজ্যিকীকরণের' যে প্রক্রিয়া চলেছে, সেই প্রক্রিয়ায় গরিব মানুষদের কোনো স্থান নেই – শুদ্ধ বাংলায় যাকে বলে কিনা ‘গরিবি হটাও'৷