‘ভাইনাক্ট্সহাউস’ বা বড়দিনের বাড়ি বলে জার্মানিতে আগে কিছু ছিল না৷ মার্কিন মুলুক থেকে কিছুদিন আগে আমদানি হয়৷ বড়দিনে আলোকমালা দিয়ে বাড়ি সাজানোর প্রথাটা হ্যালোউইনের মতোই ধীরে ধীরে জার্মানিতে ছড়িয়ে পড়ছে৷
বিজ্ঞাপন
প্রতি বছর এখানে কচিকাঁচাদের জন্য ক্রিসমাসের একটা বড় আকর্ষণ হল এই ‘ভাইনাক্ট্সহাউস’ বা ক্রিসমাস হাউস৷ বড়দিনের চার সপ্তাহ আগে জার্মানির সবচেয়ে বড় ‘বড়দিনের বাড়ি’-টিতে পাঁচ লাখ ত্রিশ হাজার বাতি জ্বলে ওঠে৷ নিম্ন স্যাক্সনির কালে শহরের এই বাড়িটির সম্ভবত গোটা ইউরোপে কোনো জুড়ি নেই৷
ছোট্ট, শান্ত কালে শহরে বড়দিনের এই ভোজবাজির উদ্যোক্তা রল্ফ ফোগ্ট, পেনশনভোগী, যার নেশা হল বড়দিনের আলোকসজ্জা৷ তিনি বলেন, ‘‘সব কিছু ঠিকঠাক হলে আমি আনন্দে হাততালি দিই৷ একটা আশ্চর্য আনন্দের অনুভূতি, বিশেষ করে যখন মানুষজন খুশি হয়ে ‘বাঃ, বাঃ' করে, তখন আমার দারুণ লাগে৷ সবচেয়ে খারাপ হল, যদি বৃষ্টি শুরু হয় আর আমি রিমোট কন্ট্রোলটা চালাতেই ফট্ করে একটা শব্দ হয় – আর সবাই ওখানে দাঁড়িয়ে বলে ‘যাঃ!'’’
জার্মানির সবচেয়ে বড় ‘বড়দিনের বাড়ি’
02:39
তবে তা খুব বেশি একটা ঘটে না৷ এই সুবিশাল বড়দিনের বাড়িটির আলোকসজ্জার পিছনে গোটা ছয় মাসের কাজ রয়েছে৷ সেই আলোকসজ্জা কেমন হবে, তা ঠিক করেন রল্ফের গৃহিণী ন্যার্মিন৷ রল্ফ বলেন, ‘‘ভেতরের সব অলঙ্করণ আর সাজানো ও একা করে, অথবা কেমন হবে, তা ঠিক করে দেয়৷’’ ন্যার্মিন ফোগ্ট মনে করেন, ‘‘এই হাসিখুশি থেকে ও অনেক আনন্দ, অনেক শক্তি পায়, আমি জানি৷’’
বড়দিনের আলোকসজ্জার নকশা থেকে ইলেকট্রিকের কাজ, রল্ফ সবই করেন নিজের হাতে৷ ১৯৯৯ সালে ফোগ্ট দম্পতি যুক্তরাষ্ট্রে গিয়েছিলেন ছেলের কাছে৷ সেখানেই প্রথম বাড়িতে বাড়িতে বড়দিনের আলোকসজ্জা দেখেন রল্ফ ও ন্যার্মিন৷ জার্মানিতে তখন ব্যাপারটা প্রায় অপরিচিত ছিল৷ রল্ফ বলেন, ‘‘একটা বাড়ি আরেকটার চেয়ে সুন্দর! সামনের বাগানে আলোয় আঁকা সব চলন্ত হরিণ আর সন্ত নিকোলাস – এ সব দেখে আমরা ভাবলাম, দেশে ফিরে আমরাও তা করব, শুধু নিজেদের জন্য৷’’
সামান্য একটা খেয়াল থেকে যা জন্ম নিয়েছিল, আজ তা সারা জীবনের স্বপ্ন হয়ে উঠেছে৷ বড়দিনের বাড়ির সেই স্বপ্নের পিছনে রল্ফ ফোগ্ট এযাবৎ খরচ করেছেন প্রায় দেড় লাখ ইউরো৷
রেজিনা নিডেনৎসু/এসি
জার্মানিতে বড়দিনের ১০টি প্রথা
অ্যাডভেন্টের মোমবাতি আর ফুলের স্তবক এলো কোথা থেকে? বড়দিনের বাজারই বা প্রথম কবে শুরু হয়? বড়দিনে জার্মানরা কী খায়? এসব প্রশ্নের উত্তর পাবেন আমাদের ছবিঘরে৷
ছবি: picture-alliance/PIXSELL/N. Pavletic
অ্যাডভেন্টের স্তবক
অ্যাডভেন্টের গোলাকৃতি স্তবকটায় আজকাল চারটি মোমবাতি লাগানো থাকে; বড়দিনের আগের প্রতি রবিবারে একটি করে জ্বালানো হয়, শেষ রবিবারে সবগুলো মোমবাতি জ্বলে৷ অ্যাডভেন্টের স্তবকের স্রষ্টা হিনরিশ ভিশার্ন ১৮৩৯ সালে তাঁর ছেলেমেয়েদের জন্য যে স্তবকটি তৈরি করেছিলেন, সেটি ছিল কাঠের ও তাতে ২৪টি মোমবাতি লাগানো ছিল৷ ক্রিসমাস ইভ অর্থাৎ ২৪শে ডিসেম্বর অবধি ডিসেম্বরের প্রত্যেকটি দিনের জন্য একটি করে মোমবাতি৷
ছবি: picture-alliance/PIXSELL/N. Pavletic
বড়দিনের বাজার
মধ্যযুগেই ক্রিসমাসের আগে বড়দিনের বাজার বসত ও লোকে ভিড় করে সেখানে যেতো৷ সে আমলে মশলাদার গরম ওয়াইন পান করার প্রথা ছিল না, শীতের মরশুমে মানুষজন খাবার-দাবার কিনতেই বড়দিনের বাজারে যেতেন৷ পরে আর সব দেশের মতো জার্মানিতেও কামার, কুমোর, ময়রা বা পুতুল-নাচিয়েরা মেলায় দোকান দিতে শুরু করে৷ বড়দিনের বাজার আজ দুনিয়ার সর্বত্র দেখতে পাওয়া যায়৷
ছবি: picture-alliance/dpa/W. Thieme
হোয়াইট ক্রিসমাস
শীত এককালে ছিল একটি নির্মম, কষ্টদায়ক ঋতু৷ উনবিংশ শতাব্দীতে তার উপর রোম্যান্টিক চেতনার প্রলেপ পড়ে শীত হয়ে ওঠে একদিকে নান্দনিক ও অপরদিকে ধর্ম ও পারিবারিক জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ৷ স্নোম্যান বা বরফের কাকতাড়ুয়ারা আর কাকতাড়ুয়া না থেকে, ছোটদের বন্ধু হয়ে ওঠে৷ কাঠের স্নোম্যানরা আজ ক্রিসমাস ট্রি-তে পর্যন্ত ঝোলে৷
ছবি: picture-alliance/beyond/J. Fankhauser
ক্রিসমাস ট্রি
বড়দিনে সুন্দর করে সাজানো ক্রিসমাস ট্রি’র নীচে পরিবারের সকলের জন্য উপহারগুলি ছড়ানো থাকবে, এই না হলে জার্মানিতে বড়দিন! এককালে বড়লোকদেরই ক্রিসমাস ট্রি কেনার সামর্থ্য ছিল; উনবিংশ শতাব্দীতে ফার ও স্প্রুস গাছের বড় বড় আবাদ হওয়ার ফলে আপামর জনতার জন্যও ক্রিসমাস সুলভ হয়ে ওঠে৷ ক্রিসমাস ট্রি সাজানোর প্রথা জার্মানি থেকে সারা বিশ্বে ছড়িয়েছে, যেমন ছবিতে ২০১৫ সালে টোকিওর একটি ক্রিসমাস ট্রি৷
ছবি: Reuters/Y. Shino
শিশু যিশু, নাকি সন্ত নিকোলাস?
মধ্যযুগে জার্মানির কচিকাঁচারা তাদের বড়দিনের উপহার পেতো ডিসেম্বরের ৬ তারিখে, সন্ত নিকোলাসের কাছ থেকে৷ কিন্তু খ্রিষ্টান সন্তদের নিয়ে ক্যাথলিকদের এত বাড়াবাড়ি জার্মান প্রটেস্টান্টদের ভালো লাগেনি৷ শোনা যায়, প্রটেস্টান্ট ধর্মমতের প্রতিষ্ঠাতা মার্টিন লুথার নাকি স্বয়ং বড়দিনের উপহার দেবার তারিখ বদলে ২৪শে ডিসেম্বর করেন৷ সেই থেকে ‘ক্রিস্টকিন্ড’ বা শিশু যিশু স্বয়ং ছোটদের জন্য বড়দিনের উপহার এনে থাকেন৷
ছবি: Fotolia/ChaotiC_PhotographY
‘বেশেরুং’
বড়দিনের আগের দিন হলো ক্রিসমাস ইভ; ছোটরা তাদের বড়দিনের উপহার পায় এই দিনে – তবে স্যান্টা ক্লস বা ফাদার ক্রিসমাসের কাছ থেকে নয়, ‘ক্রিস্টকিন্ড’ বা শিশু যিশুর কাছ থেকে৷ এই উপহার প্রদানের প্রাচীন প্রথাটির জার্মান নাম হলো ‘বেশেরুং’৷ এককালে কোনো কোনো পরিবারে ‘বেশেরুং’-এর আগে ছোটদের কোনো কবিতা আবৃত্তি করে কিংবা গান গেয়ে শোনাতে হতো – ভাগ্যক্রমে আজকালকার বাবা-মায়েরা আর অতোটা নির্মম নন৷
ছবি: picture alliance/chromorange/E. Weingartner
মিডনাইট মাস
২৪শে ডিসেম্বরের সন্ধ্যায় প্রথম তারা ফোটার পর ‘বেশেরুং’ ও খাওয়া-দাওয়া, কিন্তু তার পরেও একটি গুরুত্বপূর্ণ আচার বাকি থেকে যায়: সেটি হলো মধ্যরাত্রে গির্জায় ‘মাস’ বা প্রার্থনাসভা৷ মজা হলো এই যে, অষ্টাদশ শতাব্দী অবধি এই মিডনাইট মাস সংঘটিত হত ২৫শে ডিসেম্বর বা বড়দিনের সকালে কাকডাকা ভোরে৷ সেটা কি নিরাপত্তার কথা ভেবে?
ছবি: picture alliance / Bildagentur Huber
নেটিভিটি
আস্তাবলে খ্রিষ্টের জন্ম নিয়ে গল্পকাহিনী যেমন আদিগন্ত কাল থেকে চলে আসছে, তেমন সেই সব গল্পকাহিনী নিয়ে নাটক ও যাত্রা জার্মানি তথা ইউরোপের জনজীবন ও লোকসংস্কৃতির একটা অক্ষত ধারা৷ অতীতে খ্রিষ্টের জন্মকাহিনীর সঙ্গে বাইবেলের অন্যান্য দৃশ্যও যোগ হতো; পরে নেটিভিটি প্লে একটা নিজস্ব ধার হয়ে দাঁড়ায়৷ অপরদিকে রয়েছে যিশুখ্রিষ্টের ক্রুশবিদ্ধ হওয়া নিয়ে ওবারআম্যারগাউ-এর ‘প্যাশন প্লে’-র মতো যাত্রাপালা৷
ছবি: picture-alliance/dpa/H. Schmidt
ক্রিসমাস ডিনার
মার্কিনিদের কাছে তাদের ক্রিসমাস টার্কি যা, জার্মানদের কাছে তাদের ক্রিসমাস গুজ বা হাঁস হলো তাই – ও ছাড়া বড়দিনের ভোজ হতেই পারে না৷ অবশ্য অনেকে আবার সসেজ আর একটা সাদামাটা আলুর স্যালাড দিয়েই কাজ চালিয়ে নেন৷ হাঁস না আলু, সেটা আজকাল রুচির ব্যাপার৷ অতীতে কিন্তু বড়লোকরা খেতেন বড়দিনের হাঁস, আর গরীব-গুর্বোরা আলুর ভর্তা দিয়েই ভোজ সারতেন৷
ছবি: Fotolia
টুয়েল্ফথ নাইট
ক্রিসমাস থেকে ৬ই জানুয়ারি হলো ১২টি দিন৷ সেই কারণে ৬ই জানুয়ারি তারিখটিকে বলে টুয়েল্ফথ ডে বা দ্বাদশ দিবস৷ এই ১২টা দিন আবার ইউরোপ জুড়ে ভয়ানক শীত – সেই শীতের রাত্রে নাকি দত্যি-দানোরা ধু ধু করা বরফের উপর দিয়ে ঘুরে বেড়ায়! কাজেই ধূপধুনো জ্বালিয়ে সেই সব অপদেবতাকে তাড়াতে হয়...৷