নাৎসিদের ঘৃণাভরে স্মরণ করার দিনেই জার্মানিতে প্রকাশিত হলো দুই নাৎসিবাদী অনলাইন অ্যাক্টিভিস্টকে গ্রেপ্তারের খবর৷ ডানপন্থি ভাবাদর্শ প্রচারের উদ্দেশ্যে পরিচালিত একটি ইন্টারনেট প্ল্যাটফর্মের কাজে সক্রিয় ছিলেন তাঁরা৷
বিজ্ঞাপন
২৭ জানুয়ারি তারিখটি ঐতিহাসিকভাবেই গুরুত্বপূর্ণ৷ আন্তর্জাতিক হলোকস্ট দিবস হিসেবে সারা বিশ্বেই দিনটি পালিত হয়৷ এ বছরও যথাযথ গুরুত্বের সঙ্গে পালিত হচ্ছে দিনটি৷ আউশভিৎস বন্দি শিবির থেকে বন্দিদের মুক্ত করার মুহূর্তগুলোও এই দিনে স্মরণ করে জার্মানি৷
এবার হলোকস্ট দিবসের বিশেষ বক্তা হিসেবে জার্মানির সংসদে কথা বলেছেন রুট ক্ল্যুগার৷ তিনি এসেছেন যুক্তরাষ্ট্র থেকে৷ ১৯৪৪ থেকে ১৯৪৫ – এই দুই বছর আউশভিৎস বন্দি শিবিরেই ছিলেন রুট ক্ল্যুগার৷ সংসদে আউশভিৎসের ভয়াবহ সেই দিনগুলোকে নিজের ‘জীবনের সবচেয়ে শীতল শীতকাল' হিসেবে উল্লেখ করেছেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নাৎসিদের নৃশংসতম বর্বরতার এই প্রত্যক্ষদর্শী ৷
এবারের শীতে আরেকটি ঘটনাও প্রত্যক্ষ করছে জার্মানি৷ সাম্প্রতিক সময়ে নব্য নাৎসিদের বিরুদ্ধে ব্যাপক অভিযান পরিচালনা করেছে পুলিশ৷ মঙ্গলবার এ অভিযানের উল্লেখযোগ্য সাফল্যের খবরও পাওয়া গেল৷ জার্মান আইনজীবীরা জানিয়েছেন, বিলেফেল্ড শহর থেকে অন্তত দু'জন অনলাইন অ্যাক্টিভিস্টকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ৷ গ্রেপ্তারকৃতদের একজন নারী৷
জানা গেছে, গ্রেপ্তার হওয়া দু'জন ‘আল্টারমিডিয়া' নামের একটি ইন্টারনেট প্ল্যাটফর্মের ‘অ্যাডমিন'৷ ‘আল্টারমিডিয়া' প্রথমে ফ্রান্স থেকে ব্লগসাইট হিসেবে কাজ শুরু করে৷ ধীরে ধীরে কাজের পরিসর বাড়িয়ে একসময় এটি ডানপন্থি রাজনীতির ‘প্রপাগান্ডা মেশিন' হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে৷
হলোকস্টের চিত্রকলা
নাৎসি বন্দিশিবিরে মৃত্যুর দিন গোণার অবসরেও ছবি এঁকে গেছেন শিল্পীরা৷ ইসরায়েলের ইয়াদ ভাশেম সংগ্রহশালা থেকে আনা কিছু ছবি এখন প্রদর্শিত হচ্ছে বার্লিনে৷
ছবি: Collection of the Yad Vashem Art Museum, Jerusalem
রঙিন ‘ঘেটো’
‘ঘেটো’ বলতে বোঝায় শহরের সেই সংকীর্ণ অংশ, ইহুদিদের যেখানে থাকতে বাধ্য করা হতো৷ পোল্যান্ডের লুড্জ শহরের ঘেটোর এই ছবিটি এঁকেছিলেন ইয়োসেফ কোভনার, যিনি হলোকস্ট থেকে প্রাণ বাঁচাতে সক্ষম হয়েছিলেন৷ ‘হলোকস্টের চিত্রকলা: ইয়াদ ভাশেম সংগ্রহশালা থেকে ১০০টি চিত্র’, এই নাম দিয়ে বার্লিনে জার্মান ঐতিহাসিক সংগ্রহশালায় কোভনার ও অন্যান্য হলোকস্ট শিল্পীদের শিল্পকর্ম প্রদর্শিত হচ্ছে৷
ছবি: Collection of the Yad Vashem Art Museum, Jerusalem
উদ্বাস্তু
প্রদর্শনীতে যে ৫০ জন শিল্পীর ছবি প্রদর্শিত হচ্ছে, তাদের মধ্যে ২৪ জন প্রাণ হারিয়েছিলেন নাৎসিদের হাতে৷ নিহতদের মধ্যে ছিলেন বিশিষ্ট চিত্রশিল্পী ফেলিক্স নুসবাউম, যিনি ১৯৪৪ সালে আউশভিৎসে প্রাণ হারান৷ তাঁর ‘উদ্বাস্তু’ ছবিটি আঁকা হয় ব্রাসেলসে, ১৯৩৯ সালে৷ নুসবাউম ছবিটিতে নির্বাসনের অবর্ণনীয় যন্ত্রণা তুলে ধরতে চেয়েছিলেন৷
ছবি: Collection of the Yad Vashem Art Museum, Jerusalem
আত্মপ্রতিকৃতি
শার্লট সালোমন-এর ছবি এর আগেও জার্মানিতে প্রদর্শিত হয়েছে৷ তাঁর সাতশ’র বেশি ছবির একটি সংগ্রহে দেখা যায়, ইহুদি হিসেবে শার্লট বার্লিনে কী ধরনের জীবন কাটিয়েছিলেন৷ পরে তিনি দক্ষিণ ফ্রান্সে আশ্রয় নেন, কিন্তু ১৯৪৩ সালে তাঁকে সেখান থেকে ধরে আউশভিৎসে পাঠিয়ে দেওয়া হয় এবং বন্দিশিবিরে পৌঁছানোর সঙ্গে সঙ্গে তাঁকে হত্যা করা হয়৷ শার্লট তখন সন্তানসম্ভবা৷
ছবি: Collection of the Yad Vashem Art Museum, Jerusalem
লুকনো মেয়েটির আঁকা ছবি
নেলি টল ও তাঁর মা ইহুদি হওয়া সত্ত্বেও পোল্যান্ডের লুভভ শহরে প্রাণে বাঁচেন কেননা তাঁদের খ্রিষ্টান বন্ধুরা তাঁদের লুকিয়ে রেখেছিলেন৷ একা ঘরে আটক নেলি জলরং দিয়ে ছবি এঁকে সময় কাটাতেন, যেমন ‘মাঠের মধ্যে মেয়েরা’ নাম দেওয়া এই ছবিটি৷ ৮১ বছর বয়সি নেলি টল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে বার্লিনে এসেছেন প্রদর্শনীর উদ্বোধন উপলক্ষ্যে৷
ছবি: Collection of the Yad Vashem Art Museum, Jerusalem
‘ব্যারাকের মাঝখানে রাস্তা’
লিও ব্রয়ার বন শহরের অধিবাসী ছিলেন, প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জার্মান কাইজারের হয়ে যুদ্ধও করেছেন৷ হিটলার ক্ষমতায় আসার পর ১৯৩৪ সালে তিনি প্রথমে দ্য হেগ ও পরে ব্রাসেলসে বসবাস করেন, শিল্পী হিসেবেই, তাঁর ছবিও তখন প্রদর্শিত হয়েছে৷ ১৯৪০ সালের পর ফ্রান্সের একাধিক শিবিরে অন্তরীণ হয়ে থাকেন লিও৷ সেখানকার অভিজ্ঞতা তুলিবদ্ধ করে রেখেছেন বিভিন্ন ছবিতে৷ লিও ব্রয়ার পরলোকগমন করেন ১৯৭৫ সালে, ঐ বন শহরেই৷
ছবি: Collection of the Yad Vashem Art Museum, Jerusalem
দুই শিল্পী
ফরাসি বন্দিশিবিরে লিও ব্রয়ার যে আলোকচিত্রশিল্পীর সঙ্গে নানাভাবে সহযোগিতা করেছিলেন – যেমন মঞ্চসজ্জায় – তাঁর নাম ছিল কার্ল রবার্ট বোডেক৷ দু’জনে গ্রিটিংস কার্ড ইত্যাদিও সৃষ্টি করেছেন৷ বোডেক-কে ১৯৪১ সালে অপরাপর শিবিরে নিয়ে যাওয়া হয় এবং শেষমেষ আউশভিৎসে পাঠানো হয়৷ সেখানেই তিনি নিহত হন ১৯৪২ সালে৷
ছবি: Collection of the Yad Vashem Art Museum, Jerusalem
শিল্পীর গুপ্তজীবন
বেড্রিশ ফ্রিটা থেরেজিয়েনস্টাট বন্দিশিবিরে সরকারি প্রচারপত্র ইত্যাদি তৈরির কার্যালয়ের প্রধান ছিলেন৷ অপরদিকে তিনি ও তাঁর সহকর্মীরা গোপনে নাৎসি ঘেটোগুলির বিভীষিকাকে ছবিতে ধরে রেখেছেন৷ ১৯৪৪ সালে তা ফাঁস হয়ে যাবার পর ফ্রিটাকে আউশভিৎসে জীবন দিতে হয়৷ থেরেজিয়েনস্টাট বন্দিশিবির মুক্ত হবার পর সেখানকার দেয়াল ও মাটির তলা থেকে ফ্রিটার আঁকা ২০০টি ছবি পাওয়া যায়৷
ছবি: Collection of the Yad Vashem Art Museum, Jerusalem
মৃত্যুর পরেও বন্ধুত্ব
লিও হাস তাঁর বন্ধু ফ্রিটাকে বন্দিশিবিরের জীবন নিয়ে ছবি আঁকতে নানাভাবে সাহায্য করেছিলেন৷ সাক্সেনহাউজেন বন্দিশিবিরে লিও হাস-এর ওপর নির্দেশ হয়, মিত্রশক্তিদের পাউন্ড ও ডলার নকল করার৷ যুদ্ধের পর হাস ফ্রিটার পুত্র টোমাসকে দত্তক নেন৷ এছাড়া হাস থেরেজিয়েনস্টাট বন্দিশিবিরে বেড্রিশ ফ্রিটার আরো চারশ’টি লুকনো ছবি আবিষ্কার করেছেন৷
ছবি: Collection of the Yad Vashem Art Museum, Jerusalem
ডাক্তারের ছদ্মবেশে শিল্পী
পাভেল ফান্টল থেরেজিয়েনস্টাটের শিল্পীমহলের সদস্য ছিলেন৷ ডাক্তার হিসেবে তিনি শিবিরের মধ্যে টাইফুস রোগীদের জন্য একটি ক্লিনিক চালাতেন৷ ফ্রিটার মতো তিনিও ধরা পড়েন, তাঁর উপর শারীরিক নিপীড়ন চালানো হয়; পরে তাঁকে আউশভিৎস বন্দিশিবিরে পাঠানো হয়৷ ১৯৪৫ সালের জানুয়ারি মাসে তাঁকে গুলি করে হত্যা করা হয়৷ তাঁর প্রায় ৮০টি ছবি থেরেজিয়েনস্টাট থেকে বার করে আনা সম্ভব হয়েছিল৷
ছবি: Collection of the Yad Vashem Art Museum, Jerusalem
কলা শিক্ষক
ইয়াকব লিপশিৎস যুদ্ধের আগে ভিলনিয়ুস-এর একটি কলা প্রতিষ্ঠানে অধ্যাপনা করতেন৷ ১৯৪১ সালে তিনি কাউনুস শহরের ঘেটোয় গিয়ে বাস করতে বাধ্য হন; সেখানে তিনি অপরাপর শিল্পীদের সঙ্গে গোপনে ঘেটো জীবনের ছবি আঁকতেন৷ ১৯৪৫ সালের মার্চ মাসে কাউফেরিং বন্দিশিবিরে তাঁর মৃত্যু ঘটে৷ যুদ্ধের পরে তাঁর স্ত্রী ও কন্যা কাউনুস ঘেটোয় ফিরে গিয়ে একটি কবরখানায় লুকনো ছবিগুলো উদ্ধার করেন৷ লিপশিৎস নিজেই সেগুলোকে লুকিয়ে রেখেছিলেন৷
ছবি: Collection of the Yad Vashem Art Museum, Jerusalem
চরম দুর্দশার মধ্যেও আত্মমর্যাদা
বার্লিনের জার্মান হিস্টোরিক্যাল মিউজিয়ামের এই প্রদর্শনী চলবে ৩রা এপ্রিল অবধি৷ ছবিগুলিতে একদিকে যেমন দেখতে পাওয়া যাবে নাৎসি বন্দিশিবিরের বিভীষিকা, অপরদিকে এই অমর শিল্পীরা যেন সেই বিভীষিকার মধ্যেই জীবনের জয়গান গেয়ে গেছেন৷ মরিৎস ম্যুলার-এর ‘শীতকালে বাড়ির ছাদে’ সেরকম একটি ছবি৷
ছবি: Collection of the Yad Vashem Art Museum, Jerusalem
11 ছবি1 | 11
গত কয়েক বছরে বেশ কয়েকবারই ‘আল্টারমিডিয়া'-র অ্যাডমিন এবং অন্যান্য কর্মীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে৷ ২০১১ সালে সাবেক ‘অ্যাডমিনিস্ট্রেটর' আলেক্স ম্যোলারকে গ্রেপ্তার করা হয়৷ আদালত তাঁর বিরুদ্ধে ৩০ মাস কারাবাস এবং ৩ হাজার ইউরো জরিমানার শাস্তি ঘোষণা করেছিল৷
এর কয়েকমাস পর গ্রেপ্তার হন রবার্ট রুপ্রেশট নামের আরেকজন৷ ২৭ মাস কারাভোগ করতে হয়েছে তাঁকে৷ দু'জনের বিরুদ্ধেই মূল অভিযোগ ছিল, তাঁরা জার্মানির ‘হেইট স্পিচ আইন' লঙ্ঘন করেছেন৷
এসিবি/ডিজি (এএফপি, রয়টার্স)
জার্মানিতে মত প্রকাশের স্বাধীনতা আছে৷ তবে মত প্রকাশের নামে ঘৃণা ছড়ানো আইনত দণ্ডনীয়৷ আপনি কি ঘৃণা ছড়ানোর বিরুদ্ধে সরকারের এই অবস্তানকে সমর্থন করেন? নীচে আপনার মতামাত জানান৷