জার্মানিতে পারিবারিক সহিংসতার ঘটনা ভয়ংকর মাত্রায় বেড়েছে বলে জানিয়েছেন পরিবার মন্ত্রী৷ প্রতি তিনদিনে নিজের সঙ্গী বা পুরোনো সঙ্গীর দ্বারা অন্তত একজন নারীর মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে৷
বিজ্ঞাপন
জার্মানিতে নারী বিষয়ক মন্ত্রী ফ্রান্সিসকা গিফে মঙ্গলবার ২০১৭ সালের পারিবারিক সহিংসতার পরিসংখ্যান তুলে ধরে তা নিরসনে সবাইকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছেন৷ গত তিন বছরে জার্মানিতে পারিবারিক সহিংসতার ঘটনা বেড়েছে ১০ ভাগ৷ তবে এগুলো কেবল তাদের ঘটনা, যারা এ সম্পর্কে থানায় রিপোর্ট করেছেন৷ বাস্তবিক সংখ্যাটা আরও বেশি বলে আশংকা করছেন মন্ত্রী৷
২০১৭ সালে ১ লাখ ৪০ হাজার নারী-পুরুষ তাদের সঙ্গীদের দ্বারা সহিংসতার শিকার হয়েছেন বলে রিপোর্ট করেছেন৷ গড়ে প্রতিদিন অন্তত একজন তার প্রেমিক, স্বামী, প্রেমিকা বা স্ত্রীকে হত্যার চেষ্টা করেছেন৷ এদের ১৪৭ জনের ক্ষেত্রে তাদের সঙ্গীরা সফল হয়েছেন, অর্থাৎ তাদের হত্যা করা হয়েছে৷ এছাড়া ধর্ষণ, শারীরিক নির্যাতন, শ্বাসরুদ্ধ করা এবং যৌন হয়রানির অসংখ্য রিপোর্ট রয়েছে৷ এদের মধ্যে ৮২ শতাংশ মামলায় নারীরা সহিংসতার শিকার হয়েছেন৷ আর গত বছর নারীদের হাতে খুন হয়েছেন ৩২ জন প্রেমিক বা স্বামী৷ এদের মধ্যে দুই তৃতীয়াংশই জার্মান নাগরিক৷
ওয়ার্কার্স ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন-এর চেয়ারম্যান ভল্ফগাং স্টাডলের বলেছেন, তিনি এই পরিসংখ্যান দেখে আতঙ্কিত এবং এ সমস্যা সমাধানের আহ্বান জানাচ্ছেন, যাতে সবাই এ ব্যাপারে সহযোগিতা করে৷
পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, সহিংসতা চালানো পুরুষদের বেশিরভাগই জার্মান এবং তারা সব শ্রেণি-পেশার৷ ৩০ থেকে ৩৯ বছর বয়সের পুরুষরা বেশি সহিংস৷ মদ্যপানও একটি ‘ফ্যাক্টর' হিসেবে কাজ করেছে অনেকক্ষেত্রে৷
জার্মানিতে পারিবারিক সহিংসতা ও নির্যাতনের শিকার নারীদের জন্য ‘নারী আশ্রয়কেন্দ্র' রয়েছে ৩৫০টি, আছে ৬০০টি বিশেষ পরামর্শ কেন্দ্র, যারা প্রতিবছর ৩০ হাজার নারীকে সহায়তা দিয়ে থাকেন৷ এছাড়া ১৭টি ভাষায় ২৪ ঘণ্টা ফোনে সহায়তা দেয়ার ব্যবস্থা রয়েছে৷
নতুন পরিসংখ্যান প্রকাশের পর নারী বিষয়ক মন্ত্রী গিফে এ খাতে অর্থ সহযোগিতা বাড়ানোর ঘোষণা দিয়েছেন৷ এছাড়া নতুন এক ধরনের ফোন লাইন সুবিধা চালু করার কথা জানিয়েছেন তিনি৷ ২০২০ সাল নাগাদ নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতা নির্মূলে প্রচারণা চালাতে সাড়ে তিন কোটি ইউরো ব্যয় করা হবে বলেও জানিয়েছেন তিনি৷
জার্মানিতে নারী আন্দোলন: এক সুদীর্ঘ ইতিহাস
১৭০ বছরেরও বেশি সময় ধরে জার্মান নারীরা সমানাধিকারের জন্য লড়ছেন৷ এই লড়াইয়ে তাঁদের হারজিত দুই-ই ঘটেছে৷ তবে বিশ্বের অন্য সব দেশের মতো জার্মানিতেও এ লড়াই চলছে– চলবে৷
ছবি: Der Stern
জার্মান নারী আন্দোলনের ‘কোকিল’
লুইজে অটো-পিটার্স (১৮১৯-১৮৯৫) ছিলেন জার্মানিতে নারী আন্দোলনের একজন পথিকৃৎ ও ‘সাধারণ জার্মান নারী সমিতি’-র যুগ্ম প্রতিষ্ঠাতা (১৮৬৫)৷ লেখিকা হিসেবে তাঁর ডাকনাম ছিল ‘গানের পাখি৷’
ছবি: picture-alliance/dpa
হেলেনে লাঙ্গে
উনবিংশ শতাব্দীর শেষ অবধি জার্মানিতে মেয়েদের স্কুল-কলেজে পড়াশুনার বিশেষ চল ছিল না৷ ১৮৯০-এর দশকে মেয়েদের স্কুল শিক্ষার দাবিতে যে আন্দোলন শুরু হয়, তার পুরোভাগে ছিলেন শিক্ষক ও নারীবাদী হেলেনে লাঙ্গে (১৯৪৮-১৯৩০)৷ মহিলাদের ভোটাধিকার আদায়ের দাবিতে সোচ্চার ছিলেন তিনি৷
ছবি: picture-alliance/dpa/Bifab
প্রোলেতারীয় নারী আন্দোলনের জননী
শ্রমিক সংগঠনে মহিলাদের প্রতিনিধিত্ব, মহিলাদের ভোটাধিকার ও গর্ভপাতের অধিকারের দাবিতে সক্রিয় ও সোচ্চার ছিলেন ক্লারা সেটকিন (১৮৫৭-১৯৩৩)৷ ক্লারা সেটকিন সে আমলেই জার্মান দায়রা আইনের ২১৮ নং ধারাটির বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছেন৷ গর্ভপাতবিরোধী এই ধারাটির বিরুদ্ধে গত শতাব্দীর সত্তরের দশকেও জার্মানিতে তুলকালাম হয়ে গেছে৷ আন্তর্জাতিক নারী দিবস প্রতিষ্ঠাতেও ক্লারা সেটকিনের অবদান ছিল৷
ছবি: picture-alliance/dpa
আনিটা আউগ্সপুর্গ
আনিটা আউগ্সপুর্গ (বাঁয়ে) ও তাঁর সঙ্গিসাথীরা সামাজিক রীতিনীতির পরোয়া করতেন না৷ আউগ্সপুর্গ তাঁর বান্ধবীর সঙ্গে থাকতেন৷ দু’জনেই মাথার চুল ছোট করে কাটতেন ও পুরুষালি পোশাক পরতেন৷ আইনজীবী হিসেবে তিনি জার্মানিতে মহিলাদের ভোটাধিকারের জন্য লড়াই করেছেন (যে অধিকার শেষমেষ ১৯১৮ সালে আদায় হয়)৷ যৌনকর্মীদের অধিকারের জন্যও তিনি সক্রিয় ছিলেন৷ তাঁর সমিতি একাধিক আন্তর্জাতিক মহিলা সংগঠন সৃষ্টিতে সংশ্লিষ্ট ছিল৷
ছবি: gemeinfrei
নাৎসি আমল
নাৎসিরা ছিল নারীমুক্তিবিরোধী৷ তাদের চোখে নারী অধিকার গোষ্ঠীগুলি ছিল ইহুদি অথবা কমিউনিস্টদের সৃষ্ট৷ নাৎসিদের মতে নারীর ভূমিকা হলো ঘরণী তথা জননীর৷ অপরদিকে পুরুষরা যখন রণাঙ্গণে, তখন এই মহিলাদেরই কলকারখানায় গোলাবারুদ উৎপাদনের কাজে হাত লাগাতে হয়েছে জার্মানিতে৷
ছবি: picture-alliance/akg-images
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর
১৯৪৫ সালে জার্মানির অধিকাংশ বড় বড় শহর তখন বিধ্বস্ত৷ সেই ধ্বংসস্তূপ সরিয়ে নতুন করে দেশ গড়ে তোলার কাজে বিশেষ ভূমিকা রাখেন জার্মানি মহিলারা৷ অপরদিকে নারী অধিকার আন্দোলনগুলিও যেন কিংবদন্তির ফিনিক্স পাখির মতো সেই ধ্বংসাবশেষ থেকে মাথা তোলে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
গর্ভনিরোধ
১৯৬১ সালে জার্মানিতে গর্ভনিরোধক পিল বা বড়ির চল হয়৷ গোড়ায় শুধু বিবাহিত মহিলাদের এই পিল ব্যবহার করার অনুমতি ছিল; ডাক্তারের প্রেস্ক্রিপশনে লেখা থাকতো, মহিলাদের মাসিকের বেদনা উপশমের জন্য এই পিল দেওয়া হচ্ছে৷
ছবি: picture alliance/Everett Collection
আটষট্টির ছাত্র আন্দোলন
১৯৬৮ সালে গোটা পশ্চিম জার্মানি জুড়ে যে ছাত্র আন্দোলনের অবতারণা ঘটে, তার লক্ষ্য ছিল কর্তৃত্ববাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম ও শিক্ষাব্যবস্থার সংস্কার – এবং সেই সঙ্গে যৌন স্বাধীনতাও বটে৷ কিন্তু গোটা ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্ব পুরুষ অধ্যুষিত হওয়ায় মহিলারা নারীমুক্তির জন্য পৃথকভাবে পথে নামেন৷ ছবিতে প্রদর্শিত নিশানটিতে লেখা রয়েছে: নারীমুক্তি = শ্রেণীসংগ্রাম৷
ছবি: picture-alliance/dpa
গর্ভপাত
২১৮ নং অনুচ্ছেদের দরুণ সত্তরের দশকেও জার্মানিতে গর্ভপাত দায়রা অপরাধ বলে গণ্য হতো৷ ১৯৭১ সালে জার্মানির ‘স্ট্যার্ন’ পত্রিকা ৩৭৪ জন মহিলার নাম ছাপে, যারা প্রকাশ্যে স্বীকার করেন যে, তাঁরা গর্ভপাত করিয়েছেন৷ তারপর থেকে সংশ্লিষ্ট আইনটি একাধিকবার সংশোধন করা হয়েছে ও বিশেষ বিশেষ পরিস্থিতিতে ও শর্তে গর্ভপাত বৈধ করা হয়েছে৷
ছবি: Der Stern
অ্যালিস শোয়ার্ৎজার
জার্মানিতে নারীবাদী আন্দোলনের পথিকৃত অ্যালিস শোয়ার্ৎজার জার্মানির প্রথম নারীবাদী পত্রিকা ‘এমা’ প্রতিষ্ঠা করেন ১৯৭৭ সালে৷ মহিলাদের জন্য সৃষ্ট পত্রিকাটিতে ফ্যাশন ও গ্ল্যামারের চেয়ে রাজনীতির উপরই বেশি জোর দেওয়া হতো৷
ছবি: picture-alliance/dpa/R. Scheidemann
কর্মের স্বাধীনতা
ভাবলেও আশ্চর্য হতে হয়, ১৯৭৭ সাল অবধি জার্মানিতে মহিলারা স্বামীর অনুমতি না নিয়ে চাকুরি করতে পারতেন না৷
ছবি: Steinach/IMAGO
পথ যদি না শেষ হয়
শুধু জার্মানিতেই নয়, সারা বিশ্বে নারী আন্দোলন বহু লক্ষণীয় সাফল্য অর্জন করেছে বটে, কিন্তু এখনও অনেক কাজ বাকি রয়ে গেছে৷ জার্মানির সংসদ বা বড় বড় শিল্পসংস্থাগুলিতে আগের মতোই পুরুষদের আধিপত্য৷ জার্মানিতে আজও অনেক ক্ষেত্রে মহিলাকর্মীরা পুরুষ সহকর্মীদের মতো একই কাজ করে কম বেতন পান৷ আর যৌন হয়রানি তো আছেই৷ কাজেই প্রত্যেক নারী দিবসের উপজীব্য হওয়া উচিত – আগের নারী দিবসের দিকে অগ্রণী হও৷