এমনিতে জার্মানি রিসাইক্লিং চ্যাম্পিয়ন বলে পরিচিত৷ কিন্তু এ দেশেই সবচেয়ে বেশি প্যাকিং মেটিরিয়াল জনিত বর্জ্য তৈরি হয়৷ এক্ষেত্রে মাথাপিছু বর্জ্য সৃষ্টিতে জার্মানরা ইউরোপে নাম্বার ওয়ান৷
ছবি: picture alliance/dpa/P.Pleul
বিজ্ঞাপন
বিভিন্ন ধরনের ট্র্যাশ বা বর্জ্য আলাদা করায় জার্মানদের জুড়ি নেই – কাগজ এখানে, তো প্লাস্টিক ওখানে – খাবারদাবারের অবশিষ্ট এখানে, তো বাগানের ঘাস-পাতা ওখানে – এ সবই আছে৷ সেই বর্জ্যের রিসাইক্লিংও চলছে পুরোদমে৷ বর্জ্যের প্রায় অর্ধেকই জার্মানিতে রিসাইক্লিং করা হয়: এখানেও জার্মানরা বিশ্বচ্যাম্পিয়ন, বলা চলে৷
কিন্তু ‘ডয়চে উমভেল্টহিল্ফে' (ডিইউএইচ) পরিবেশ সংগঠনের সর্বাধুনিক পরিসংখ্যান অনুযায়ী, জার্মানরা রিসাইক্লিং-এ বিশ্বসেরা হলেও, আবর্জনা সৃষ্টিতেও তারা খুব কম যান না৷ দৃশ্যত প্রত্যেক জার্মান বছরে গড়ে ২১৩ কিলোগ্রাম ‘প্যাকেজিং ওয়েস্ট' বা প্যাকিং সংক্রান্ত বর্জ্য সৃষ্টি করেন – যা কিনা দিনে ৬০০ গ্রাম প্যাকিং বর্জ্য!
প্যাকেজিং বর্জ্য রোধে জার্মানির কী করা উচিত?
একদিকে জার্মানিকে যেমন পরিবেশ সচেতন দেশ হিসেবে বলা হয়ে থাকে, তেমনি আবার অন্যদিকে প্যাকেজিং আবর্জনার দিক দিয়ে ইউরোপের মধ্যে এক নম্বরে রয়েছে দেশটি৷ তার কিছু নমুনা পাবেন এই ছবিঘরে৷
ছবি: picture-alliance/Rainer Hackenberg
অপচয়ে জার্মানি এগিয়ে
প্রতিটি জার্মান বছরে গড়ে ২১৩ কিলোগ্রাম, অর্থাৎ দিনে ৬০০ গ্রামের বেশি প্যাকেট আবর্জনা ফেলে৷ সেই হিসেব ফ্রান্সে ফেলা হয় ১৮৫ কিলোগ্রাম৷ অস্ট্রিয়ায় ১৫০ এবং সুইডেনে জন প্রতি বছরে গড়ে ১০৯ কিলোগ্রাম বর্জ্য ফেলা হয়ে থাকে৷ এই পরিসংখ্যানটি জানা গেছে জার্মানির পরিবেশ সংগঠন ‘ডয়চে উমভেল্টহিল্ফে’ বা ডিইউএইচ৷
ছবি: DW/A. Maciol
অপচয় বৃদ্ধি
যদিও সরকার নানাভাবে কমানোর চেষ্টা করছে, তারপরও গত এক দশকে জার্মানিতে প্যাকেট আবর্জনার অপচয় বৃদ্ধি পেয়েছে শতকরা ১৩ ভাগ৷
ছবি: picture alliance/dpa/P.Pleul
‘ওয়ান-টাইম’ ইউজ
রিসাইক্লিং-এর জন্য জার্মানিতে প্লাসটিকের বোতল ফেরত দেওয়া হয়, তবে কিছু কোম্পনি আর সেগুলো ফেরত নিতে তেমন আগ্রহী নয়৷ তারা ‘ওয়ান টাইম’ বা মাত্র একবার ব্যবহারযোগ্য ছোট বোতলের ব্যবহার বাড়াতে চায়৷
ছবি: picture-alliance/Rainer Hackenberg
প্লাস্টিক ব্যাগ
প্লাস্টিক ব্যাগের ব্যবহার কমাতে কিছু কোম্পানি স্বেচ্ছায় পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে৷ যেমন জার্মনির দ্বিতীয় বৃহত্তম সুপার মার্কেট ‘রেভে’ গত জুন মাস থেকে প্লাস্টিক ব্যাগ ব্যবহার নিষিদ্ধ করেছে৷ এই চেইন শপের মতে, এভাবেই ১৪০ মিলিয়ন প্লাস্টিক ব্যাগের ব্যবহার কমানো সম্ভব৷
ছবি: Fotolia/rdnzl
কাপড়ের ব্যাগ
কিছুদিন আগে পর্যন্তও যে কোনো পণ্য কেনা হলে স্বাভাবিকভাবেই সাথে একটি ব্যাগ দেওয়া হতো৷ তবে এখন ব্যাগের সাইজ অনুযায়ী দশ, বিশ বা পঞ্চাশ সেন্ট মূল্যে ব্যাগ পাওয়া যায়৷ লক্ষ্যণীয় যে, ইদানীং পরিবেশ সচেতন প্রায় সকলের কাছেই কাপড়ের ব্যাগ থাকে৷ যা কিনা সহজেই ছোট করে ভ্যানিটি ব্যাগে ভরে রাখা যায়৷
ছবি: DUH
পরিবেশবান্ধব নয়, তবে ট্রেন্ড
ছোট্ট, ছোট্ট প্লাস্টিকের ফেলে দেওয়া যে কাপগুলো দেখছেন, এগুলোতে কফি ভরা থাকে৷ একটি কাপ মেশিনে ঢুকিয়ে দিলে কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই ধূমায়িত ও অতুলনীয় স্বাদের এককাপ কফি খুব সহজেই তৈরি হয়ে যায়৷ বর্তমানে জার্মনিতে এই কফি অত্যন্ত জনপ্রিয় হলেও তা কিন্তু মোটেও পরিবেশবান্ধ নয়৷ কারণ এই কফি পান করলে সাধারণ কফির তুলনায় আবর্জনা হয় ১৬ গুণ বেশি৷
ছবি: picture alliance/dpa/L.Sojka
পরিবেশবান্ধব
জার্মানির ভুপার্টাল শহরে জলবায়ু, পরিবেশ ও জ্বালানি বিষয়ক প্রতিষ্ঠানটি মনে করে, বিভিন্ন কোম্পানি যদি পরিবেশ বান্ধব হয়, তাহলে শতকরা ২০ভাগ বর্জ্য কমানো সম্ভব জার্মানিতে৷
7 ছবি1 | 7
মনে রাখতে হবে, ফ্রান্স, অস্ট্রিয়া ও সুইডেনের ক্ষেত্রে এই পরিসংখ্যান হলো যথাক্রমে ১৮৫ কিলোগ্রাম, ১৫০ কিলোগ্রাম ও ১০৯ কিলোগ্রাম৷ কাজেই প্যাকেজিং বর্জ্যে জার্মানি ইউরোপে পয়লা নম্বর৷ ওদিকে বাকি বিশ্বের মতো জার্মানিতেও গত এক দশকে প্যাকেজিং বর্জ্য বেড়েছে – এ দেশে মোট ১৩ শতাংশ৷ একদিকে কোম্পানিগুলো মুনাফার লোভে প্যাকিং বাড়াচ্ছে, অন্যদিকে সরকার আইন করে সেই প্যাকেজিং কমাতে চাইছেন৷
প্যাকেজিং থেকে মুনাফা
আগে থেকেই অংশে অংশে, এবং বিশেষ করে ছোট পরিমাণে প্যাক করে বিক্রি করার প্রবণতা বাড়ার কথা বলেছে ডিইউএইচ৷ দৃশ্যত একা মানুষদের সংসারের সংখ্যা বাড়ার ফলেই কোম্পানিগুলি এই স্ট্র্যাটেজি অনুসরণ করতে বাধ্য হয়েছে৷ কিন্তু আরেকটি কারণ হলো, প্যাকিং-এর সাইজ বাড়িয়ে, তার ভিতর পণ্যের পরিমাণ কমিয়ে কিংবা সমান রেখে, কোম্পানিগুলো অনেক বেশি মুনাফা করছে৷
সেই সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে ‘ট্রেন্ড', যেমন কফি ক্যাপসুলের ট্রেন্ড৷ সাধারণ কফি বিক্রির চেয়ে ১৬ গুণ বেশি প্যাকেজিং লাগে এই কফি ক্যাপসুলে -– কিন্তু লাভও বাড়ে চারগুণ৷ ঠিক এভাবেই কোম্পানিগুলো আর পানীয়ের বোতল পুনর্ব্যবহার করতে আগ্রহী নয়, যদিও এককালে জার্মানিতে পরিবেশবাদীদের ধ্বজা ছিল পানীয়ের বোতলের ওপর রিফান্ড ও বোতল ফেরৎ নেওয়া৷ কোম্পানিদের দৃষ্টিকোণ থেকে একবার ব্যবহারযোগ্য বোতল সস্তা আর তা রাখবার জন্য জায়গার দরকার পড়ে না৷ ২৫ বছর আগে বোতলের উপর ডিপোজিট নেওয়ার প্রণালী যখন চালু হয়, তখন এই সব বোতলের ৯০ ভাগ ব্যবহারের পর দোকানে ফেরৎ আনা হতো – এখন সেটা কমে দাঁড়িয়েছে ৩০ ভাগে৷ আল্ডি বা লিডল-এর মতো বড় বড় সুপারমার্কেট চেন ডিপোজিট সুদ্ধ প্লাস্টিক বটল রাখাই বন্ধ করে দিয়েছে৷
প্লাস্টিকে ভরে যাওয়া পৃথিবী
লক্ষ লক্ষ টন প্লাস্টিক আবর্জনায় সাগরের পানি ভরে যাচ্ছে, ক্ষতি হচ্ছে মাছ ও অন্যান্য সামুদ্রিক প্রাণীর৷ গতকাল ছিল বিশ্ব সমুদ্র দিবস৷ এ উপলক্ষ্যে আমরা নজর দেব সাগরে প্লাস্টিক দূষণের দিকে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/M.Nelson
টন টন আবর্জনা
প্রতিবছর প্রায় ৮০ লাখ টন প্লাস্টিক আবর্জনা সাগরে গিয়ে পড়ে বলে এলেন ম্যাকআর্থার ফাউন্ডেশনের একটি রিপোর্টে প্রকাশ৷ রিপোর্টে সাবধান করে দেওয়া হয়েছে যে, জরুরিভাবে কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ না করা হলে ২০৫০ সালের মধ্যে সাগরে মাছের চেয়ে প্লাস্টিক আবর্জনার পরিমাণই বেশি হবে৷ প্রশান্ত মহাসাগরের এক প্রান্তে অবস্থিত মিডওয়ে আইল্যান্ডের সৈকতও আজ আবর্জনামুক্ত নয়৷
ছবি: picture-alliance/dpa/R.Olenick
প্লাস্টিকের খদ্দের
সবাই যে প্লাস্টিক অপছন্দ করে, এমন নয়৷ প্লাস্টিক ভেঙে ছোট ছোট টুকরো হয়ে গেলে সাগরের প্রাণীরা তাকে খাদ্য বলে ভুল করে৷ উপশালা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি সাম্প্রতিক গবেষণা থেকে জানা গেছে যে, প্লাস্টিক খাওয়ার ফলে মাছের বৃদ্ধি কমে যায়, মৃত্যুহার বাড়ে৷ মজার কথা, কিছু কিছু মাছ যেন প্লাস্টিক খেতেই ভালোবাসে! কিন্তু এভাবে মাছ থেকে মানুষের খাদ্যচক্রেও এসে পড়ে প্লাস্টিক৷
ছবি: picture-alliance/dpa/R.Olenick
যে প্লাস্টিক খাওয়া যায়
ওসেন কনজারভেন্সি সংস্থার পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ৬৯০টি প্রজাতির সামুদ্রিক প্রাণী প্লাস্টিক দূষণের কবলে পড়েছে৷ কাজেই কোম্পানিগুলি প্লাস্টিক প্যাকেজিংয়ের নানা বিকল্প বের করার চেষ্টা করছে৷ ফ্লোরিডার একটি বিয়ার তৈরির কোম্পানি, ডেলরায় বিচ ক্রাফ্ট ব্রুয়ারি, তাদের ছয় ক্যানের সিক্সপ্যাক বাঁধার রিং, বিয়ার তৈরি থেকে উদ্বৃত্ত গম আর বার্লি দিয়ে বানানোর পরিকল্পনা করছে৷ আগামী অক্টোবরে প্রোডাকশন শুরু হবে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/J. McDonald
বায়োডিগ্রেডেবল প্যাকেজিং
ফেলে দেওয়া প্লাস্টিক প্যাকেজিং সাগরে প্লাস্টিক আবর্জনার একটা বড় অংশ৷ কোম্পানিরা যার বায়োডিগ্রেডেবল, অর্থাৎ সহজে পরিবেশের সঙ্গে মিশে যায়, এমন বিকল্প বার করার চেষ্টা করছে৷ পোল্যান্ডের একটি কারখানায় সে কাজে গমের ফ্যান ব্যবহার করা হচ্ছে৷ ইয়ের্জি ভিসোচকি যে বিওট্রেম প্যাকেজিং আবিষ্কার করেছেন, তা ওভেন কিংবা ডিপ ফ্রিজে ব্যবহার করা চলে; ত্রিশ দিনের মধ্যে ক্ষয় পেয়ে যায়; আবার খাওয়াও চলে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/A. Reszko
প্লাস্টিকের বিকল্প বাঁশ
বাঁশগাছ খুব তাড়াতাড়ি বাড়ে, তাই বাঁশ প্লাস্টিকের বিকল্প হতে পারে৷ বাঁশ থেকে টুথব্রাশ, বাথরুমে পর্দা ঝোলানোর ডান্ডা, রান্নার বাসনকোসন, এমনকি কম্পিউটারের পার্টস পর্যন্ত তৈরি করা যায়৷ টংগু জিয়াংকিয়াও ব্যাম্বু অ্যান্ড উড ইনডাস্ট্রি কোম্পানি বাঁশের কি-বোর্ড, মাউস আর মনিটরের কেস তৈরি করা শুরু করে ২০০৮ সালে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/Z.Haibin
ওসেন স্কিমার
প্লাস্টিকের বিকল্প দিয়ে প্লাস্টিক আবর্জনার পরিমাণ কমানো যেতে পারে, কিন্তু তা সত্ত্বেও লক্ষ লক্ষ টন প্লাস্টিক বহ শতাব্দি ধরে সাগরের পানিতে ভেসে বেড়াবে ও ধীরে ধীরে ক্ষয় পাবে৷ ওলন্দাজ ওসেন ক্লিনআপ সংস্থা একটি ১০০ কিলোমিটার দৈর্ঘের ভাসমান বাঁধ দিয়ে সেই প্লাস্টিক আবর্জনাকে ধরে রাখবে৷ প্রশান্ত মহাসাগরে ২০২০ সালের মধ্যে এরকম একটি ভাসন্ত বাঁধ নিয়োগ করার কথা৷
ছবি: picture-alliance/dpa/E.Zwart
আবর্জনা থেকে ফ্যাশন
প্লাস্টিকের একাংশ রিসাইকেল করায় কোনো বাধা নেই: তা দিয়ে ফুলের টব, বাড়িঘরের ইনসুলেশন, এমনকি জামাকাপড় পর্যন্ত তৈরি করা যায় - যেমন স্পেনের ইকোঅ্যাল্ফ কোম্পানির তৈরি জ্যাকেট৷ ২০০টি মাছধরার নৌকো প্রতিদিন ভূমধ্যসাগর থেকে যে পরিমাণ প্লাস্টিক আবর্জনা সংগ্রহ করে, তা গুঁড়ো করে তা থেকে পলিয়েস্টার ফাইবার বানিয়ে, সেই ফাইবার দিয়ে এই সব জ্যাকেট ও অন্যান্য ফ্যাশনেবল জামাকাপড় তৈরি করা হয়৷
ছবি: AFP/Getty Images/P. Armestre
প্লাস্টিকের ব্যবহার কমাও, রিসাইকল করো
প্লাস্টিকের আবর্জনা অপরিবর্তিত রেখেই তা পুনর্ব্যবহার করা চলে৷ ২০১২ সালে রিও ডি জানিরো-য় জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন সম্মেলনে রিও-র ওয়াটারফ্রন্টে যে সুবিশাল মাছের ভাষ্কর্য প্রদর্শন করা হয়েছিল, তা ছিল প্লাস্টিকের বোতল দিয়ে তৈরি৷
ছবি: picture-alliance/dpa/A.Lacerda
8 ছবি1 | 8
কোম্পানিরা প্যাকেজিং বর্জ্য কমানোর জন্য কিছু কিছু ছোটখাট পদক্ষেপ নিয়েছে, যেমন কমপ্রেসড প্যাকেজিং বা কেনাকাটা নিয়ে যাওয়ার প্লাস্টিক ব্যাগ বিক্রি বন্ধ করা৷ কিন্তু বিশেষজ্ঞদের মতে শুধু কোম্পানি ও গ্রাহকদের সচেতনতার উপর ব্যাপারটা ছেড়ে না দিয়ে, সরকারের এবার সক্রিয় হওয়া উচিত৷ মুশকিল শুধু এই যে, সরকার গত চার বছর ধরে সেই আইনের খসড়া নিয়ে ব্যস্ত রয়েছেন৷
আপনার কি কিছু বলার আছে? লিখুন নীচের মন্তব্যের ঘরে৷