জার্মানিতে প্রতি ২৫ জনে একজন আশ্রয়প্রার্থী
৫ জুলাই ২০২৫
রক্ষণশীলদের নেতৃত্বে থাকা দেশটির নতুন সরকার এই সংখ্যাটি কমাতে নানা ধরনের উদ্যোগ নিচ্ছে৷
জার্মানির সেন্ট্রাল রেজিস্টার অফ ফরেইন ন্যাশনালস জানিয়েছে, ২০২৪ সালে আন্তর্জাতিক আইনের অধীনে সুরক্ষা মর্যাদা পাওয়া মানুষের সংখ্যা তার আগের বছরের তুলনায় অন্তত এক লাখ ৩২ হাজার বেড়েছে৷ এই পরিসংখ্যানে আশ্রয়প্রার্থী এবং অস্থায়ী সুরক্ষা মর্যাদা পাওয়া মানুষদেরও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে৷
জার্মানির ফেডারেল পরিসংখ্যান অফিসের তথ্য বলছে, ৩৩ লাখ স্বীকৃত শরণার্থীর মধ্যে ইউক্রেন থেকে আসা ১০ লাখেরও বেশি যুদ্ধ শরণার্থী রয়েছেন৷ সিরীয়দের সংখ্যা সাত লাখ ১৩ হাজার৷ আফগানিস্তানের নাগরিকদের সংখ্যা তিন লাখ ৪৮ হাজার৷ ইরাকি আছেন এক লাখ ৯০ হাজার৷ তুরস্কের নাগরিকের সংখ্যা এক লাখ ৫৭ হাজার৷ আর আফ্রিকার বিভিন্ন দেশ থেকে আসা মানুষের সংখ্যা দুই লাখ ৭৭ হাজার৷ তাদের মধ্যে অন্তত অর্ধেক এসেছেন সোমালিয়া, ইথিওপিয়া এবং ইরিত্রিয়াসহ হর্ন অফ আফ্রিকার অন্যান্য দেশগুলো থেকে৷
পরিসংখ্যান বলছে, আট কোটি ৩৩ লাখ মানুষের দেশ জার্মানির প্রতি ২৫ জনে একজন আশ্রয়প্রার্থী৷ তবে, জার্মানির বিভিন্ন রাজ্য বা অঞ্চল ভেদে এই সংখ্যার তারতম্য হতে পারে৷
শরণার্থীদের মধ্যে তারুণ্যের আধিক্য
পরিসংখ্যান বলছে, জার্মানিতে অবস্থানরত শরণার্থীরা জার্মানদের তুলনায় তরুণ৷ কারণ, ২০২৪ সালে শরণার্থীদের গড় বয়স ছিল ৩২ বছর৷ জার্মানির মোট জনসংখ্যার গড় বয়স ৪৫ বছর ছয় মাস৷
জার্মানিতে ইউক্রেনীয়দের গড় বয়স ৩৫ বছর৷ সিরিয়ান এবং আফগান শরণার্থীদের গড় বয়স যথাক্রমে ২৮ এবং ২৭ বছরের একটু কম৷
স্বীকৃত শরণার্থীদের অন্তত ৪৫ শতাংশ নারী৷ ইউক্রেনীয়দের মধ্যে নারীর সংখ্যা অন্তত ৬০ ভাগ৷ কারণ, রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধের কারণে বেশিরভাগ ইউক্রেনীয় পুরুষেরা দেশ ছাড়েননি বা তাদের ছাড়তে দেয়া হয়নি৷
পরিসংখ্যান আরো বলছে, জার্মানিতে স্বীকৃত শরণার্থীদের চার ভাগের এক ভাগ ১৮ বছরেরও কম বয়সি শিশু এবং কিশোর-কিশোরী৷
ইউরোপে সর্বোচ্চ সংখ্যক শরণার্থী জার্মানিতে
৩৩ লাখ শরণার্থীর মধ্যে ৮২ শতাংশের বা ২৭ লাখের বেশি মানুষের জার্মানিতে বসবাসের অনুমতি রয়েছে৷ আবেদন নিষ্পত্তির অপেক্ষায় রয়েছেন চার লাখ ২৭ হাজার জন৷
এক লাখ ৭১ হাজার আশ্রয়প্রার্থীর আশ্রয় আবেদন প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে৷ তাদের দেশ ছেড়ে যেতে বলা হলেও তারা এখনও জার্মানিতেই রয়েছেন৷ এ সব ক্ষেত্রে জোরপূর্বক নির্বাসন বা স্বেচ্ছায় প্রত্যাবর্তন সম্পন্ন করতে এক মাস থেকে বছর পর্যন্ত সময় লাগতে পারে৷
আরো এক লাখ ৩৬ হাজার আশ্রয়প্রার্থীকে তথাকথিত সহনশীলতা বা ডুলডুং-এর আওতায় জার্মানিতে থাকার অনুমতি দেয়া হয়েছে৷ মূলত এসব আশ্রয়প্রার্থীর আশ্রয় আবেদন মঞ্জুর হয়নি৷ কিন্তু শারীরিক অবস্থাসহ বিশেষ বিবেচনায় তাদের প্রত্যাবাসন না করে জার্মানিতে অস্থায়ীভাবে থাকার অনুমতি দেয়া হয়েছে৷
আশ্রয়নীতিতে বড় পরিবর্তন চান চ্যান্সেলর ম্যার্ৎস
রক্ষণশীল রাজনৈতিক দল সিডিইউ/সিএসইউ নেতা ফ্রিডরিশ ম্যার্ৎস মাস দুয়েক আগে জার্মানির চ্যান্সেলর নির্বাচিত হয়েছেন৷ ক্ষমতাগ্রহণের পরপরই পূর্ব ঘোষণা অনুযায়ী আশ্রয় ইস্যুতে কঠোর হয়েছেন তিনি৷ শরণার্থীর সংখ্যা কমানোর ক্ষেত্রে বেশ মনোযোগী তার সরকার৷
জার্মানিতে সুরক্ষা চাওয়া বেশিরভাগ মানুষ মূলত স্থল সীমান্ত পাড়ি দিয়ে দেশটিতে আসেন৷ জার্মানির সঙ্গে সেসব দেশেরই সীমান্ত রয়েছে সেগুলোর মধ্যে সুইজারল্যান্ড ছাড়া অন্য দেশগুলো ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য৷ যদিও সুইজারল্যান্ড ইইউর ঘনিষ্ঠ অংশীদার৷ প্রতিটি দেশই নিরাপদ হিসেবে বিশ্বজুড়ে পরিচিত৷
ম্যার্ৎসের যুক্তি হলো, আশ্রয়প্রার্থীদের জার্মানিতে পৌঁছানোর আগে অন্য ইইউ দেশে (এবং সুইজারল্যান্ডে) তাদের আশ্রয় আবেদন করা উচিত৷ ডাবলিন রেগুলেশন অনুযায়ী, আশ্রয়প্রার্থীরা প্রথম যে ইইউ দেশে পৌঁছান সেখানে তাদের আবেদন জমা দিতে হয়৷
কিন্তু অনেক আশ্রয়প্রার্থী সেটা করেন না৷ বিশেষত পরিবারের সঙ্গে যোগ দিতে কিংবা যে অঞ্চলটিতে নিজের সংস্কৃতির প্রতিনিধিত্ব আছে, আশ্রয়প্রার্থীরা সেখানেই পৌঁছাতে চান৷
কিন্তু বর্তমান জার্মান সরকার সেই সুযোগটিকেও সীমিত করে আনছে৷ কারণ, প্রতিবেশী নয়টি দেশের সঙ্গে থাকা সীমান্তে কড়া পাহারার পাশাপাশি সীমান্ত থেকে আশ্রয়প্রার্থীদের ফিরিয়ে দিচ্ছে দেশটি৷ প্রতিবেশী দেশগুলো এই সিদ্ধান্তের সমালোচনা করলেও নিজেদের অবস্থানে অনড় জার্মান সরকার৷
স্থগিত পারিবারিক পুনর্মিলন
অস্থায়ী সুরক্ষা মর্যাদা পাওয়া শরণার্থীদের পারিবারিক পুনর্মিলনের অধিকার স্থগিত করেছে জার্মানি৷ এ সংক্রান্ত সরকারের একটি পরিকল্পনায় অনুমোদন দিয়েছে জার্মান পার্লামেন্ট বুন্ডেসটাগ৷ এই বিতর্কিত ও সমালোচিত সিদ্ধান্তের কারণে সবচেয়ে বেশি ভুক্তভোগী হবে সিরিয়ান পরিবারগুলো৷
মানবাধিকার সংস্থা প্রো অ্যাসিল বলেছে, পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন থাকার কারণে বড় ধরনের মানসিক চাপ তৈরি হতে পারে৷ এতে সমাজে অন্তর্ভু্ক্তির পথ কঠিন হওয়ার পাশাপাশি অনিয়মিত অভিবাসনের ঝুঁকিও বাড়ছে৷ সন্তান, বাবা-মা বা স্বামী/স্ত্রীর সঙ্গে পুনর্মিলনের কোনো আইনি পথ না থাকলে কিছু মানুষ জার্মানিতে থাকা প্রিয়জনের কাছে পৌঁছাতে অনিয়মিত এবং অনিরাপদ পথ বেছে নেয়ার ঝুঁকি নেবেন বলে শঙ্কা করছে এনজিওটি৷
আশ্রয়প্রার্থীর সংখ্যা কমানোর উদ্যোগ
চ্যান্সেলর হিসেবে দায়িত্ব নেয়ার আগেই ফ্রিডরিশ ম্যার্ৎস বলেছিলেন, প্রতি বছর জার্মানিতে আশ্রয় চাইতে আসা মানুষের সংখ্যা এক লাখের নিচে রাখতে চান তিনি৷
বর্তমান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আলেকজান্ডার ডোব্রিন্ট অবশ্য বলেছেন, বার্ষিক আশ্রয়প্রার্থীর সংখ্যা দুই লাখের নিচে নামিয়ে আনতে চান তিনি৷
জার্মানির সাপ্তাহিক ম্যাগাজিন ফোকাস-কে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘‘অবশ্যই একটি দেশের শরণার্থীদের সমাজে অন্তর্ভুক্ত করার একটি সীমা থাকে৷ আর তাই অতীতের ঊর্ধ্বসীমা নিয়ে কথা বলা সঠিক ছিল৷''
তিনি বলেন, ২০২৩ এবং ২০২৪ সালে ছয় লাখেরও বেশি আশ্রয়প্রার্থীর আশ্রয় আবেদন নেয়া হয়েছে৷ এছাড়াও দশ লাখেরও বেশি ইউক্রেনীয়, ইইউ আইনের অধীনে বিশেষ সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছেন৷
ডোব্রিন্ট বলেছেন, এমন বাস্তবতায় ‘‘আমরা তাত্ত্বিকভাবে দুই লাখের নীচে রাখার কথা বললেও আজকের দৃষ্টিকোণ থেকে এই সংখ্যাটিও অনেক বড়৷''
তিনি আরো বলেন, আশ্রয়প্রার্থীর সংখ্যা কমানোর পাশাপাশি নিয়মিত অভিবাসনের পথ শক্তিশালী করা প্রয়োজন৷ কারণ, জার্মানির শ্রমবাজারে দক্ষ শ্রমিকের ঘাটতি প্রতিনিয়ত তীব্র হচ্ছে৷
সের্টান স্যান্ডারসন/টিএম/এসবি
প্রথম প্রকাশ: ৪ জুলাই ২০২৫ ইনফোমাইগ্রেন্টস
অভিবাসী বিষয়ক সংবাদমাধ্যম ইনফোমাইগ্রেন্টস তিনটি প্রধান ইউরোপীয় সংবাদমাধ্যমের নেতৃত্বে একটি যৌথ প্লাটফর্ম৷ প্লাটফর্মটিতে রয়েছে জার্মানির আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম ডয়চে ভেলে, ফ্রান্স মিডিয়া মোন্দ, এবং ইটালিয়ান সংবাদ সংস্থা আনসা৷ এই প্রকল্পের সহ-অর্থায়নে রয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন৷