২০০২ সালের আগস্টে, ইলসে নামে একটি নিম্নচাপের ফলে মধ্য ইউরোপে ভারী বৃষ্টিপাত শুরু হয়৷ এর ফলে চেক প্রজাতন্ত্র, অস্ট্রিয়া এবং জার্মানিতে ভয়াবহ বন্যা হয়েছিল৷ প্রথম ক্ষতিগ্রস্ত শহরগুলির মধ্যে একটি ছিল বাভারিয়ার পাসাউ৷ দানিউবের জলসীমা পৌঁছেছিল ১০.৮ মিটারে৷ ১৯৫৪ সালের পর সেটি ছিল সর্বোচ্চ স্তর৷ ৮৫০ জন স্বেচ্ছাসেবক, ডুবুরি দিনরাত ত্রাণের কাজে সাহায্য করেছিলেন৷

অল্প সময়ের মধ্যে পানির স্তর নাটকীয়ভাবে বেড়ে গিয়েছিল৷ এরৎজ পর্বতমালা এবং ড্রেসডেনের পার্শ্ববর্তী এলাকাকেও সতর্ক করা হয়৷ এলবে নদীর ছোট উপনদী, যেমন ম্যুগলিৎস, ভাইসেরিৎস নদীতে প্রবল স্রোত বইছিল৷ কয়েক ঘণ্টার মধ্যে পিরনা শহর প্লাবিত হয়৷ ড্রেসডেনের বাড স্ক্যান্ডাউয়ের কাছে একটি গাড়িকে জলে ভেসে যেতে দেখা গিয়েছিল৷

ঐতিহাসিক শহর ড্রেসডেনের কেন্দ্রের কিছু অংশ এলবে এবং ভাইসারিৎস নদীর জলে প্লাবিত হয়৷ বন্যায় জুইঙ্গার প্রাসাদ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল৷ এই প্রাসাদেই রয়েছে ওল্ড মাস্টার্স গ্যালারি এবং বিখ্যাত সেম্পেরওপের অপেরা হাউস৷ দুটি ভবন জার্মানির বারোক স্থাপত্যের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য নিদর্শনের মধ্যে পড়ে৷ ক্ষতির পরিমাণ ছিল প্রায় ৪ কোটি ৭০ লাখ ইউরো৷

পিরনায় এলবে নদীর জলসীমা ছিল ১১.৫ মিটার (প্রায় ৩৮ ফুট)৷ ড্রেসডেনে নদীর জলস্তর ছিল ৯.৪ মিটার৷ এর আগে কখনো ড্রেসডেনে জলস্তর এভাবে বাড়েনি৷ শিলারপ্লাৎজে জল দুই মিটারের বেশি গভীর ছিল এবং শহরের কিছু অংশ ফাঁকা করতে বাধ্য হয়েছিল কর্তৃপক্ষ৷

স্যাক্সনি রাজ্য এবং একাধিক শহরও বন্যার কবলে পড়ে৷ ভাইসেনস্টাইনের মতো গ্রামগুলো বাইরের জগত থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে৷ মাইসেনের কেন্দ্র সম্পূর্ণভাবে প্লাবিত হয়৷ ছবিতে দেখা যাচ্ছে, এক বাসিন্দা নিজে অস্থায়ী নৌকা তৈরি করছেন৷ তখন ত্রাণকর্মীরা উদ্ধারকাজে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন৷

জার্মান তৎকালীন চ্যান্সেলর গেয়ারহার্ড শ্র্যোডার, বুন্ডেসটাগ নির্বাচনের প্রচারে ব্যস্ত ছিলেন সেইসময়৷ স্যাক্সনির রাজ্যের প্রধান জর্জ মিলব্রাডটের সঙ্গে মুল্ডে নদীর জলে প্লাবিত গ্রিমা শহর পরিদর্শন করেন তিনি৷ শ্র্যোডার নিজেকে সহানুভূতিশীল ‘চ্যান্সেলর’ হিসাবে দেখাতে চেয়েছিলেন বলে দাবি সমালোচকদের৷ তার বিরোধী এডমুন্ড স্টোয়বার সেই সময় নর্থ সিতে ছুটি কাটাচ্ছিলেন৷শ্র্যোডার সেই নির্বাচনে জয়ী হন৷

২০ আগস্ট তোরগাউ-এর কাছে একটি বাঁধ ভেঙে যায় এবং এলবে থেকে পানি আশেপাশের গ্রামাঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে৷শুধুমাত্র স্যাক্সনিতেই, দুর্যোগে ২১ জন প্রাণ হারান৷ আজ ২০ বছর পরে, স্যাক্সনির বাসিন্দারা অনেক বেশি সুরক্ষিত৷ ২০০২ সাল থেকে বন্যা সুরক্ষা প্রকল্পে প্রায় ৩০০ কোটি ইউরো বিনিয়োগ করেছে স্যাক্সনি৷

বন্যার স্রোত স্যাক্সনি থেকে উত্তর দিকে বইছিল৷ ব্র্যান্ডেনবুর্গের প্রিগনিৎজ জেলায় ত্রাণের কাজ চলেছিল একটানা৷ কর্তৃপক্ষ সেইসময় ৩৭টি গ্রাম খালি করার নির্দেশ দেন৷এলবে নদীর স্রোতে বাঁধ দিতে বালির ব্যাগ ব্যবহার করেছিলেন বুন্দেসভারের সৈন্যরা৷

মেকলেনবুর্গ-ওয়েস্টার্ন পোমেরানিয়া, লোয়ার স্যাক্সনি এবং শ্লেসভাইগ-হলস্টাইন রাজ্যেও পৌঁছেছিল বন্যার জল৷ কোথাও কোথাও বন্যার ঢেউ ছিল তিন থেকে চার মিটার উঁচু৷এই ছবিটি লোয়ার স্যাক্সনির পুরানো শহর হিটজ্যাকারের, যেখানে কোনো নদীবাঁধ ছিল না৷ ২৩ আগস্টের মধ্যে এই শহরের অনেকটা অংশ জলে ডুবে গিয়েছিল৷

লোয়ার স্যাক্সনি এবং মেকলেনবার্গ-ওয়েস্টার্ন পোমেরেনিয়ার বিশাল এলাকা প্লাবিত হয়৷ হিটজ্যাকারের কাছে একটি মোড়ের এই গাড়ির যাত্রীরা পালিয়ে গিয়ে প্রাণ বাঁচাতে পেরেছিলেন৷ এলবে বরাবর উত্তরের এলাকাগুলিও ফাঁকা করা হয়৷ বাসিন্দাদের সরানো হয় নিরাপদ স্থানে৷

যতটা আশঙ্কা করা হয়েছিল, পানি সব জায়গায় ততটা বাড়েনি৷ লাওয়েনবার্গের কাছে সেনারা বাঁধ পোক্ত করার কাজ করছিলেন, এমন ছবি তুলেছেন আলোকচিত্রী৷বন্যায় সবচেয়ে কম ক্ষতি হয়েছিল এই এলাকার৷ এলবে নদীর উৎস থেকে অনেকটাই দূরে এই বাঁধ৷ এখানে নদী গভীর এবং প্রশস্ত৷এখানে বন্যার ফলে আলাদা কোনো স্রোত ছিল না৷

বন্যায় জার্মানি জুড়ে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল৷ রিয়েসার কাছে সেতু, রেলপথের রাস্তা সম্পূর্ণ ভেঙে পড়েছিল৷ ঘরবাড়ি এবং বাঁধও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল, ফসল নষ্ট হয়েছিল৷ ২০০২ সালের এলবে বন্যা এখনো জার্মান ইতিহাসের সবচেয়ে ব্যয়বহুল প্রাকৃতিক দুর্যোগ হিসাবে বিবেচিত হয়৷ মোট ক্ষতির পরিমাণ এক হাজার ১৬০ কোটি ইউরো৷

শুধু ঘরবাড়ির ক্ষতি নয়, বন্যায় ক্ষত তৈরি হয়েছিল মানুষের মনেও৷ কারণ এই বন্যায় কয়েক ডজন মানুষের মৃত্যু হয়ে৷ সেই সময় সাহায্য করতে এগিয়ে আসে একাধিক সংস্থা৷ জার্মান রেড ক্রস একাই বন্যাপীড়িত মানুষদের সাহায্যে প্রায় ১৪ কোটি ৬০ লাখ ইউরো সংগ্রহ করেছিল৷ ছবিতে দেখা যাচ্ছে ভিটেনবুর্গের কাছে একটি বাড়ির প্রায় বেশিরভাগটা ডুবে গিয়েছে৷ বাড়ির বাসিন্দা ছাদে দাঁড়িয়ে রয়েছেন হতাশ মুখে৷

আগস্টের শেষের দিকে, ড্রেসডেনের এলবে নদীর ভেসে যাওয়া সেই তীরের কাদা শুকিয়ে গিয়েছিল৷ ২০০২ সালের বন্যার সময়, জার্মানিতে সর্বোচ্চ পরিমাণ বৃষ্টি হয়েছিল৷কয়েক দিনে যা বৃষ্টি হয়েছিল, তা প্রায় ছয় মাসের সমান৷ জলবায়ু পরিবর্তনে এই দেশে ভারী বৃষ্টির সম্ভাবনা বেড়েছে৷