বহুদিন ধরেই এটার অবস্থান ছিল ছায়াঢাকা৷ তবে ইউক্রেন সংকটের পর থেকে চিত্রটা অনেক পাল্টেছে৷ ক্রমেই শিক্ষার্থীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে মিউনিখের ইউক্রেনি ফ্রি ইউনিভার্সিটিতে৷ রাজনৈতিক সংকট বিশ্ববিদ্যালয় জগতেও প্রভাব ফেলছে৷
বিজ্ঞাপন
ইউক্রেনের প্রবাসী ইউনিভার্সিটি ‘ইউক্রেনি ফ্রি ইউনিভার্সিটি’ সংক্ষেপে ইউএফইউ মিউনিখে অবস্থিত৷ শীতল যুদ্ধের সময় অ্যামেরিকার একটি ফাউন্ডেশনের সহায়তায় গড়ে ওঠে এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান৷ ইউক্রেন সংকটের কারণে এটি আবার চাঙা হয়ে উঠেছে৷ ইউক্রেন সংকট শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের মধ্য কীরকম প্রভাব বিস্তার করছে এবং বিশ্ববিদ্যালয়টির আর্থিক অবস্থাই বা কেমন? এ বিষয়ে এক ঝলক দৃষ্টি দেওয়া যাক৷
শিক্ষার মাধ্যম ইউক্রেনি
সেমিনারের পেপারটি কেমন হয়েছে, সে ব্যাপারে স্টেফান কিছুটা উদ্বিগ্ন ছিল৷ কিন্তু অধ্যাপকের মাথা নাড়া দেখে স্বস্তি পায় সে৷ ‘‘মায়দান ও ইউক্রেনি ভাষায় এর প্রভাব’’ লেখাটি ভালোই হয়েছে৷ ইউএফইউ-এর ক্লাস চলে ইউক্রেনি ভাষায়৷ তাই শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের এই ভাষায় দখল থাকতে হয়৷ চলতি সংকট, মায়দানে বিক্ষোভ, রাজনৈতিক পরিস্থিতি ইত্যাদি সম্পর্কে ক্লাসে তুলে ধরা হয়৷ বলেন জন্মসূত্রে অস্ট্রিয়ান শিক্ষক মিশায়েল মোসার৷
জার্মানিতে কাজ করতে পারেন
বাভারিয়ার সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় কর্তৃক স্বীকৃত ইউএফইউ৷ এখান থেকে ডিগ্রি পাওয়া ব্যক্তিরা জার্মানির যে কোনো জায়গায় কাজ করতে পারেন৷ ইউক্রেন বা পূর্ব ইউরোপীয় দেশগুলির সঙ্গে যে সব প্রতিষ্ঠানের ব্যবসায়িক সম্পর্ক রয়েছে, সে সব প্রতিষ্ঠানে কাজ পাওয়ার ভাল সুযোগ রয়েছে ইউএফইউ-এর ডিগ্রিধারীদের৷ তবে ব্যাচেলর কোর্স পড়ানো হয় না এখানে৷ তার মানে প্রত্যেক শিক্ষার্থীরই আগে কোনো ডিগ্রি থাকতে হয়৷
তারাস-এর জার্মানি সম্পর্কে ব্যক্তিগতভাবে কোনো ধারণা ছিল না৷ তবুও ইউক্রেনে ইতিহাস নিয়ে পড়াশোনা শেষ করে ইউএফইউতে ভর্তি হয়েছে এই তরুণ৷ ‘‘ইউক্রেনের শিক্ষা বিভাগ সাবেক সোভিয়েত আমলের রাজনৈতিক সংস্কৃতি দ্বারা প্রভাবিত৷ যে সব বিষয়ে আমার আগ্রহ, এখানে সেসব বিষয় পড়ার সুযোগ পেয়ে আমি আনন্দিত৷’’ বলে তারাস৷ বিশেষ করে তার ভালো লাগে: প্রত্যেক শিক্ষক নিজেদের রাজনৈতিক মতামত প্রকাশ করতে দ্বিধা বোধ করেন না বলে৷
দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন
পশ্চিম ইউক্রেন থেকে আসা তারাসের কাছে আর একটা ইতিবাচক দিক হলো, এই বিশ্ববিদ্যালয়ে দেশের অন্যান্য অঞ্চলের ছেলে-মেয়েদের সঙ্গে পরিচিত হওয়া৷ ইউক্রেন রাষ্ট্রের উন্নতির ব্যাপারে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি বিভিন্ন রকম, কিন্তু সংঘর্ষ হওয়ার মতো কিছু ঘটে না৷ সবাই নিজেকে ইউক্রেনি বলে মনে করে৷ দেশটি ভেঙে পড়ুক তা কেউ চায় না৷ অনেকে মিউনিখ থেকেই মায়দানের বিক্ষোভকারীদের সহায়তা করেছে৷ সংগ্রহ করেছে চাঁদা৷
সেরা শিক্ষার্থীদের রাজ্যসভা ভবনে থাকার সুযোগ
জার্মানির মিউনিখ শহরের কেন্দ্রস্থলে বাভেরিয়ার রাজ্যসভা ভবনে সেরা শিক্ষার্থীরা বিলাসবহুল জীবনযাত্রার সুযোগ পাচ্ছেন৷ সংসদ সদস্যদের কাছাকাছি থেকে অনেক কিছু শেখারও সুযোগ পাচ্ছেন তাঁরা৷
ছবি: Andreas Praefcke
৫০ জন সেরা শিক্ষার্থী
জার্মানির মিউনিখ শহরের কেন্দ্রস্থলে বাভেরিয়ার রাজ্যসভা ভবনে ৫০ জন সেরা শিক্ষার্থী বিলাসবহুল জীবনযাত্রার সুযোগ পাচ্ছেন৷ এঁদের মধ্যে এই দু’জন ভাগ্যবান শিক্ষার্থীও রয়েছেন৷
ছবি: Gerhard Brack
বিশাল প্রাসাদ
বিশাল প্রাসাদের লোহার গেট দিয়ে ঢুকছেন কালো ব্রিফকেস বগলে নিয়ে স্যুট পরা কোনো এক রাজনীতিবিদ৷ তাঁর গাড়ির পাশেই সাইকেল দাঁড় করিয়ে মাথায় বেসবল ক্যাপ পরে কোনো একজন ছাত্র প্রাসাদের ঐ একই গেট দিয়ে ঢুকছেন নিজের থাকার ঘরে৷
ছবি: Bayerischer Landtag
রাজকীয় ব্যাপার
প্রাসাদের ঝকঝকে মেঝেতে লাল কার্পেট, দেয়ালে সব বড় বড় পেইনটিং আর লম্বা করিডোর পেরিয়ে ছাত্রদের যেতে হয় নিজেদের ঘরে৷
ছবি: Bayerischer Landtag
দ্বিতীয় রাজা মাক্সিমিলিয়ন
১৮৫২ সালে বাভেরিয়ার দ্বিতীয় রাজা মাক্সিমিলিয়ন ছাত্রদের জন্য একটি ফাউন্ডেশন গঠন করেন৷ তাঁর লক্ষ্য ছিল মেধাবী ছাত্র-ছাত্রীদের পড়াশোনার সুযোগ করে দেওয়া৷ ছাত্ররা বাবা-মায়ের আর্থিক সাহায্য ছাড়া এবং পড়াশোনার পাশাপাশি টাকা রোজগারের কোনো চিন্তা না করে পুরো মনোযোগ যেন লেখাপড়ায় খরচ করতে পারে৷
ছবি: picture alliance/akg
‘এক্সক্লুসিভ’ ছাত্রদের হোস্টেল
এই লক্ষ্য নিয়েই দ্বিতীয় রাজা মাক্সিমিলিয়ন সেরা ছাত্রদের জন্য এই বৃত্তির সুযোগ করে দেন৷ এটা জার্মানির ‘এক্সক্লুসিভ’ ছাত্রদের হোস্টেল৷ ছাত্র আন্দ্রেয়াস বলেন, ‘‘কারো প্রতিভা থাকলে এখানে তারা তাদের সে চাহিদা পূরণের সুযোগ পায়৷’’
ছবি: Fotolia/mylivi
বৃত্তি পাওয়ার প্রধান শর্ত
সংসদ সদস্যদের পাশে থেকে নিজেদের যোগ্য মানুষ হিসেবে তৈরি করার সুযোগ পাওয়ার জন্য এই ছাত্রাবাসে থাকার সুযোগ পাওয়া একেবারে সহজ ব্যাপার নয়৷ ‘‘এখানে বৃত্তি পাওয়ার প্রধান শর্ত, আবিট্যুর, অর্থাৎ স্কুল ফাইনালের ফলাফল হতে হবে ১,০ গ্রেড এবং নিজ স্কুল থেকে সুপারিশ করা চিঠি৷
ছবি: Bayerischer Landtag
চেয়ারম্যান হান্সপেটার বাইসার
সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের কাছেও ছাত্রদের প্রমাণ করতে হয় যে, তাঁরা শুধু স্কুলে মেধাবী ছাত্রই নন, তাঁরা অন্য ছাত্রদের চেয়ে ব্যক্তিত্ব সম্পন্নও৷ এছাড়া, থাকতে হবে সামাজিক সচেতনতাবোধ এবং বিভিন্ন কর্মতৎপরতায় নিয়োজিত করার মানসিকতা’, বলেন এই ছাত্রাবাস কমিটির সম্মানিক চেয়ারম্যান হান্সপেটার বাইসার৷
ছবি: Gerhard Brack
বিশাল ডাইনিং হল
হান্সপেটার বাইসার নিজেও একসময় এই বৃত্তি পেয়ে এই হোস্টেলেই ছিলেন৷ তিনি প্রতিদিন ঠিক দুপুর একটায় প্রাসাদের বিশাল ডাইনিং হলে বসার পর, ছাত্ররা যাঁর যাঁর আসন নেন৷ সবাইকে যে প্রতিদিন খাবার টেবিলে হাজির হতে হবে, তেমন ধরাবাঁধা নিয়ম নেই৷ প্রতিবছরই কয়েকজন করে নতুন ছাত্রকে এই বিশেষ ছাত্রাবাসে থাকার জন্য বৃত্তির সুযোগ দেওয়া হয়৷
ছবি: Bayerischer Landtag
লোভনীয় লাইব্রেরি
ছাত্রী ইভা মনে করেন, ছাত্রাবস্থায় এমন রাজকীয়ভাবে থাকা খাওয়া বা জীবনযাপন অনেকের কাছেই স্বপ্নের মতো৷ তিনি আরো বলেন, পরীক্ষার আগে বেশিরভাগ সময়ই লাইব্রেরিতে কাটে, এখানেই অন্যদের সাথে আলোচনা হয়৷
ছবি: Bayerischer Landtag
মিউনিখের ম্যাক্সমিলেনিউম স্ট্রিট
বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব যেমন ফ্রান্স ইয়োসেফ স্ট্রাউস, যিনি দীর্ঘদিন বাভারিয়া রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন, তিনি এবং পদার্থবিদ্যায় নোবেল বিজয়ী ভ্যার্নার হাইসেনব্যার্গ-ও এই বিশেষ ধরণের বৃত্তি পেয়ে ছাত্রাবস্থায় এই বিলাসবহুল হোস্টেলে থাকতেন৷
ছবি: Andreas Praefcke
10 ছবি1 | 10
জার্মানিতে শিক্ষার্থীরা যেভাবে বসবাস করেন
এর আগে কখনো প্রথম সেমিস্টারে এত ছাত্র দেখা যায়নি৷ ক্লাসে পড়াশোনার পাশাপাশি একটি থাকার জায়গাও তো চাই? থাকার জায়গা পাওয়া কিন্তু মোটেই সহজ ব্যাপার নয়৷ এই ছবিঘরের মধ্য দিয়ে জানা যাক কে কোথায় জায়গা পায়৷
ছবি: DW/V. Wüst
অনিশ্চয়তা
নতুন সেমিস্টার শুরু হয়েছে, কিন্তু হোস্টেলগুলোতে জায়গা নেই৷ এখন শিক্ষার্থীরা কি করবে? মাথা গোঁজার একটা ঠাঁই তো চাই! একটা ব্যবস্থা তো করতেই হবে! মিউনিখ এবং ফ্রাংকফুর্ট সবচেয়ে ব্যয়বহুল শহর৷ বাভারিয়া রাজ্য একটি ঘর ভাড়া গড়ে ৪৯৩ ইউরো আর ফ্রাংকফুর্টে ৪২১ ইউরো৷
ছবি: picture-alliance/dpa
মায়ের কাছে থাকা
শতকরা ২৭ জন শিক্ষার্থী পড়াশোনার সময় মায়ের কাছেই থাকে৷ এতে করে শুধু যে খরচ কম হয় তা নয়, মায়ের কাছে থাকার আরামই আলাদা৷ কাপড়চোপড় সবসময় ধোঁয়া থাকে আর ফ্রিজ থাকে ভর্তি, অর্থাৎ খাওয়া-দাওয়ার চিন্তা নেই৷ তাছাড়া সন্তান যত বড়ই হোক না কেন বাবা-মায়ের কাছে তারা সবসময়ই আদরের৷
ছবি: Fotolia/Jeanette Dietl
জরুরি অবস্থায় জিমে থাকা
প্রথম সেমিস্টারে প্রায় সমস্যা হয় বড় শহরগুলোতে, বিশেষ করে মিউনিখ, কোলোন বা ফ্রাংকফুর্টে৷ এত ভাড়া দিয়ে অনেকের পক্ষেই বাসা নেওয়া সম্ভব হয় না, তাই অনেক সময় ক্যাম্পাসের জিমে একটি ম্যাট্রেস পেতেই রাতে ঘুমোতে হয়৷
ছবি: picture-alliance/dpa
হোস্টেলে জায়গা পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার!
শতকরা মাত্র ১২ জন ছাত্র হোস্টেলে জায়গা পেয়ে থাকে৷ বেশিরভাগ সময় সেখানে দুই তিনজনকে একসাথে থাকতে হয়৷ কোলোনের একটি ছাত্রদের হোস্টেলের ভাড়া ২৩০ ইউরো৷
ছবি: picture-alliance/dpa
থাকার জন্য কন্টেনার
৮০’র দশক থেকেই অনেক ছাত্র কন্টেনার-এ থাকা শুরু করে৷ কন্টেনার ঘরগুলো খুবই ছোট ছোট৷
ছবি: Manfred Kovatsch
নিরাপত্তা প্রহরী হিসেবে থাকা
কোনো কোনো মালিক তাঁদের ফ্যাক্টরি, হাসপাতাল বা স্কুলের ঘরগুলো একেবারে খালি রাখতে চান না৷ তাই অনেক সময় ছাত্রদের নিরাপত্তা কর্মী হিসেবে সেখানে থাকতে দেন৷ তবে সেখানে কিছু নিয়ম-কানুন মেনে চলতে হয়৷ যেমন ধূমপান করা, কুকুর-বেড়াল পোষা বা কোনো ধরনের পার্টি করার অনুমতি থাকেনা সেখানে৷
ছবি: DW/L.Heller
বিদায় বাড়ি !
তবে সব শিক্ষার্থী কিন্তু বাবা-মায়ের সাথে থাকতে পারেনা কারণ বিশ্ববিদ্যালয় প্রায়ই থাকে বাড়ি থেকে অনেক দূরে৷ অর্থাৎ মায়ের হোটেল থেকে এবার বিদায়ের পালা!
ছবি: DW/V. Wüst
7 ছবি1 | 7
তারাসের সহপাঠী কাটারিনা এসেছে পূর্ব ইউক্রেন থেকে৷ সেখানে রুশপন্থি বিচ্ছিন্নতাবাদীরা নিজস্ব প্রজাতন্ত্র গঠনের চেষ্টা করছে৷ তার মাতৃভাষা রুশ৷ কাটারিনা বলে, ‘‘আমরা এখানে খুব আলোচনা করি৷ আমি লক্ষ্য করছি, আমার মতামতের পরিবর্তন হচ্ছে৷ আগে আমি মনে করতাম পশ্চিম ইউক্রেনীয়রা রুশ ভাষাভাষী মানুষদের প্রতি বৈরিভাবাপন্ন৷ এখন আমি বুঝতে পারছি সেটা ঠিক নয়৷’’
অনেকেই ফিরবে না
কাটারিনা ইউএফইউতে প্রথম সেমিস্টারে পড়ছে৷ ইউক্রেনে জার্মান ভাষা নিয়ে পড়াশোনা করার পর মিউনিখে এক বছর সামাজিক বছর করেছে৷ তার জার্মান ভাষাজ্ঞান বেশ ভালো৷ জার্মানির যে কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে টিউশন ফি ছাড়াই পড়াশোনা করতে পারতো সে, কিন্তু ইউক্রেনি সংস্কৃতি ও ইতিহাস সম্পর্কে আরো জানার আগ্রহ তার প্রবল৷ আর তাই প্রতি সেমিস্টারে ৬০০ ইউরো টিউশন ফি দিয়ে ইউএফইউ-তে পড়াশোনা করছে এই ছাত্রী৷
এই প্রতিষ্ঠানের অধিকাংশ শিক্ষার্থীর কাছে একটা বিষয় স্পষ্ট: ইউক্রেনের পরিস্থিতির পরিবর্তন না হলে স্বদেশে ফিরবে না তারা৷ যদিও ইউক্রেনি কর্মদাতাদের কাছে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রির বিশেষ মূল্য রয়েছে৷