জার্মানির হানাও শহরের শিশাবারে হামলার পেছনে উগ্র ডানপন্থি উদ্দেশ্য রয়েছে বলে মনে করছেন তদন্তকারীরা৷ হামলায় নিহত নয়জনের অধিকাংশই বিদেশি বংশোদ্ভূত৷ জার্মান চ্যান্সেলর আঙ্গেলা ম্যার্কেল এই হামলার নিন্দা জানিয়েছেন৷
বিজ্ঞাপন
জার্মান চ্যান্সেলর আঙ্গেলা ম্যার্কেল জানিয়েছেন, জার্মানির হানাও শহরের শিশাবারে বুধবার রাতের হামলার সঙ্গে সম্ভবত উগ্র ডানপন্থি চরমপন্থার সম্পর্ক রয়েছে৷ তিনি বলেন, ‘‘অন্য জাতিসত্ত্বা, ধর্ম এবং চেহারার প্রতি বিদ্বেষ থেকে হামলাকারী উগ্র ডানপন্থি চরমপন্থা, বর্ণবাদী উদ্দেশ্যে এই হামলা চালিয়েছে বলে এই মুহূর্তে নানা ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে৷’’
তিনি বলেছেন, ‘‘বর্ণবাদ একধরনের বিষ৷ ঘৃণা একধরনের বিষ৷ আর এই ঘৃণা আমাদের সমাজে এখনো আছে৷’’
হানাও হামলার পর বৃহস্পতিবার দেয়া বক্তব্যে চ্যান্সেলর ম্যার্কেল আরো বলেন, জার্মানি প্রতিটি মানুষের সম্মানজনক জীবনযাপনের অধিকার নিশ্চিতে বদ্ধপরিকর, তা তিনি যে বর্ণের বা জাতিরই হোন না কেন৷ সংক্ষিপ্ত বিবৃতিতে গতকালের হামলার শিকার এবং তাদের পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানিয়েছেন টানা চতুর্থবার ক্ষমতায় থাকা জার্মানির এই চ্যান্সেলর৷
জার্মানিতে নিরাপত্তা শঙ্কায় মুসলিমরা
জার্মানির হেসে রাজ্যের হানাও শহরে দক্ষিণপন্থি সন্ত্রাসীর গুলিতে নয় জন মারা গেছেন৷ দু’দিন আগেই নাশকতার পরিকল্পপনা করা কয়েকজন দক্ষিণপন্থিকে গ্রেফতার করে পুলিশ৷ মুসলিম সমাজ সরকারের কাছে নিরাপত্তা বাড়ানোর আহ্বান জানিয়েছেন৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/M. Probst
বারে গুলি
১৯ ফেব্রুয়ারি জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্টের কাছে হানাও শহরের একাধিক স্থানে হামলায় নয়জন প্রাণ হারান৷ পরে হামলাকারী ও তার মা-কে মৃত অবস্থায় উদ্ধার করেছে পুলিশ৷
ছবি: Reuters/R. Orlowski
নিরাপত্তা শঙ্কায় মুসলিমরা
ডয়চে ভেলেকে দেয়া সাক্ষাৎকারে জার্মানিতে মুসলিমদের কেন্দ্রীয় কাউন্সিলের মহাসচিব আবদাসসামাদ এল ইয়াজিদি বলেন, মুসলিমরা ‘খুবই অনিরাপদ’ বোধ করছেন৷ তিনি বলেন, দক্ষিণপন্থার এমন উত্থান আগে কখনো দেখা যায়নি৷
ছবি: imago images/IPON
দেশজুড়ে নাশকতা সৃষ্টির চেষ্টা
এই ঘটনার দু’দিন আগে জার্মান পুলিশ দেশটির ছয় রাজ্যে ১৩টি স্থানে অভিযান চালিয়ে এক ডজন ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করে৷ অভিযোগ রয়েছে, এরা রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গ, আশ্রয়প্রার্থী ও মুসলিমদের ওপর হামলার পরিকল্পনা করেছিলেন৷ তারা চেয়েছিলেন জার্মানিতে একটি গৃহযুদ্ধ পরিস্থিতি তৈরি করতে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/S. Stein
নাশকতা পরিকল্পনার মূল হোতা পাঁচ উগ্র ডানপন্থি
জার্মান বার্তা সংস্থা ডিপিএ ঘটনার তদন্তকারীদের বরাত দিয়ে জানিয়েছে, এই পরিকল্পনার মূল হোতা ছিলেন পাঁচ জন উগ্র ডানপন্থি সন্ত্রাসী৷ বাকিরা এদের অর্থ জোগাচ্ছিলেন৷ এদের সবাই জার্মান ও পুরুষ৷
ছবি: picture-alliance/dpa/U. Deck
অস্ত্রের খোঁজে
যে ছয় রাজ্যে অভিযান চালানো হয় তা হলো: বাডেন-ভ্যুটেমব্যার্গ, বাভেরিয়া, লোয়ার স্যাক্সনি, নর্থ-রাইন ওয়েস্টফালিয়া, রাইনল্যান্ড-পালাটিনাটে এবং স্যাক্সনি-আনহাল্ট৷ দলটি ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে তৈরি করা হয়েছিল বলে ধারণা করা হচ্ছে৷ পুলিশ সম্ভাব্য হামলায় ব্যবহার করার অস্ত্রেরও খোঁজ করছে৷ জার্মান গণমাধ্যম জানিয়েছে, তারা হাতে তৈরি অস্ত্র ও হামলার আইডিয়া সম্বলিত ছবি পরস্পরের সঙ্গে শেয়ার করেছেন৷
ছবি: Getty Images/T. Lohnes
মসজিদে নিরাপত্তা চান মুসলিমরা
ডানপন্থি সন্ত্রাসীদের গ্রেপ্তারের পর মুসলিমরা মসজিদগুলোকে সুরক্ষিত করার আহ্বান জানিয়েছেন৷ জার্মান মুসলিমদের কেন্দ্রীয় কাউন্সিলে আইজিএমজি-র চেয়ার আইমান মাজিয়েক পত্রিকা ড্যের স্পিগেলকে বলেন, ‘‘বিষয়টি নিয়ে রাষ্ট্রের ভাবা উচিত৷’’ যেসব জায়গায় আগেও হামলা হয়েছে সেগুলোতে, বিশেষ করে পুলিশের উপস্থিতি জোরদার করার আহ্বান জানান তিনি৷
ছবি: Imago Images/M. Schüler
বছরে একশ’ হামলা
জার্মানির বিভিন্ন মসজিদে বছরে প্রায় একশ’ হামলার ঘটনা নিবন্ধিত হয় বলে জানিয়েছে দেশটির মসজিদগুলোর সবচেয়ে বড় অ্যাসোসিয়েশন ডিটিব৷ গত কয়েক সপ্তাহে উনা, হাগেন, এসেন ও বিয়েলফেল্ডের মসজিদগুলোতে বোমা হামলার হুমকি দেয়া হয়েছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/P. Zinken
উগ্র ডানপন্থার উত্থান
গত জুনে ভাল্টার ল্যুবকে নামের এক রাজনীতিককে হত্যা এবং হালেতে একটি সিনাগগে হামলার ঘটনায় জার্মানিতে উগ্র ডানপন্থা আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে বলে সবার টনক নড়েছে৷ সম্প্রতি সামাজিক গণমাধ্যমে বেশ কিছু পোস্টও সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে৷
ছবি: DW/D. Regev
8 ছবি1 | 8
প্রসঙ্গত, স্থানীয় সময় বুধবার রাত দশটার দিকে হানাও শহরের একটি শিশাবার এবং পার্শ্ববর্তী ক্যাফেতে প্রবেশ করে গুলিবর্ষণ করে ৪৩ বছর বয়সি বন্ধুকধারী৷ সেখানে বেশ কয়েকজন হতাহত হন৷ এরপর হামলাকারী সেই ঘটনাস্থল থেকে আড়াই কিলোমিটার দূরে একটি গাড়ি এবং স্পোর্টস বারেও হামলা চালায়৷ সেখানেও হতাহতের ঘটনা ঘটেছে৷ পরবর্তীতে হামলাকারী এবং তার মা-কে মৃত অবস্থায় একটি অ্যাপার্টমেন্ট থেকে উদ্ধার করেছে পুলিশ৷
হামলাকারী অতীতে আরব এবং মুসলমান দেশগুলো সম্পর্কে নেতিবাচক মন্তব্য করেছিল বলে জানা গেছে৷ বুধবারের হামলার দায় স্বীকার করা হয়েছে এমন একটি চিঠি এবং ভিডিও বার্তাও পরীক্ষা করছে পুলিশ৷
এদিকে, বুধবারের ঘটনায় নিহতদের মধ্যে অন্তত পাঁচজন তুর্কি নাগরিক ছিলেন বলে দাবি করেছেন জার্মানিতে নিযুক্ত তুরস্কের রাষ্ট্রদূত আলী কামাল আয়দিন৷ দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে লিখেছে, ‘‘এই হামলা এটাই প্রমাণ করে যে, ইউরোপে ‘বর্ণবাদ এবং ইসলামবিদ্বেষ’ বাড়ছে৷’’
হানাওয়ে হামলার ঘটনার পর জার্মানির চারটি সবচেয়ে বড় ইসলামিক অ্যাসোসিয়েশন উগ্র ডানপন্থিদের চরমপন্থা রুখতে আরো উদ্যোগ গ্রহণের আহ্বান জানিয়েছে৷ মুসলমানদের সমন্বিত কাউন্সিল কেআরএম জানিয়েছে, তারা গত কয়েকমাস ধরেই ইসলামবিদ্বেষের বিরুদ্ধে একটি পরিষ্কার অবস্থান নিতে কর্তৃপক্ষের প্রতি দাবি জানিয়েছে আসছিলেন৷
এদিকে, হানাও হামলার ভুক্তভোগীদের পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানিয়ে বাৎসরিক কার্নেভাল উৎসব বাতিল করেছে ডয়চে ভেলে৷ শুক্রবার ডয়চে ভেলের প্রধান কার্যালয়ে এই উৎসব আয়োজনের কথা ছিল৷ প্রতিষ্ঠানটির মহাপরিচালক পেটার লিমবুর্গ এক বিবৃতিতে লিখেছেন, ‘‘হানাওতে বর্ণবাদী সন্ত্রাসী হামলা এক অবিশ্বাস্য ঘটনা৷ ডয়চে ভেলেতে আমরা সবাই প্রতিদিন যে মূল্যবোধ ধরে রাখতে কাজ করি, সেই মূল্যবোধের উপর এই হামলা হয়েছে৷ সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যময়তা জার্মানিকে বিশেষ মর্যাদা দিয়েছে এবং আমাদের সমৃদ্ধ করেছে৷ এই কাপুরুষোচিত হামলা আমাদেরকে আমাদের নীতি থেকে সরাতে পারবে না৷’’
তিনি লিখেছেন, ‘‘যখন অন্যরা বিলাপ করছে, তখন আমরা উৎসব করতে পারি না৷ ভুক্তভোগীদের পরিবারের প্রতি আমরা সমবেদনা জানাচ্ছি৷ একটি আন্তর্জাতিক এবং অসাম্প্রদায়িক গণমাধ্যম হিসেবে আমরা এই বার্তাও দিতে চাই যে, জার্মান সমাজে এসব চলতে পারে না৷’’
উল্লেখ্য, জার্মানিতে গত কয়েকবছরে মসজিদসহ মুসলমানদের উপর হামলার বেশ কিছু ঘটনা ঘটেছে৷ দেশটি ২০১৫ সালে দশলাখের বেশি শরণার্থীকে আশ্রয় দেয়ার পর এধরনের হামলা বেড়ে যায়৷
এআই/এসিবি (এপি, এএফপি, ডিপিএ)
ইউরোপে কোন দেশগুলোতে সবচেয়ে বেশি মুসলমানের বাস
অ্যামেরিকান থিংক ট্যাংক পিউ রিসার্চ সেন্টার বলছে, ২০১৬ সালে ইউরোপের মোট জনসংখ্যার ৪ দশমিক ৯ ভাগ ছিল মুসলমান৷ ২০৫০ সালের মধ্যে ইউরোপের মোট জনসংখ্যার ৭.৫ ভাগ হবে মুসলমান৷
ছবি: Nikolay Doychinov/AFP/Getty Images
ফ্রান্স
২০১৬ সালের ঐ পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ইউরোপের দেশগুলোর মধ্যে বর্তমানে ফ্রান্সে সবচেয়ে বেশি মুসলমানের বাস৷ দেশটির মোট জনসংখ্যার ৮ দশমিক ৮ ভাগ অধিবাসী মুসলমান৷ বর্তমানে সেখানে ৫৭ লাখ ২০ হাজার মুসলমান বাস করছেন৷
ছবি: AP
জার্মানি
জার্মানিতে ২০১৬ সালে মুসলমানদের মোট সংখ্যা ছিল ৪৯ লাখ ৫০ হাজার, যা মোট জনসংখ্যার ৬ দশমিক ১ ভাগ৷
ছবি: Getty Images/S. Gallup
যুক্তরাজ্য
যুক্তরাজ্যে ৪১ লাখ ৩০ হাজার মুসলমানের বাস, যা মোট জনসংখ্যার ৬ দশমিক ৩ ভাগ৷
ছবি: picture-alliance/empics/D. Dawson
ইটালি
এই দেশটিতে ২৮ লাখ ৭০ হাজার মুসলমানের বাস, যা দেশটির মোট জনসংখ্যার ৪ দশমিক ৮ ভাগ৷
ছবি: Getty Images for Les Benjamins/S. Alemdar
নেদারল্যান্ডস
নেদারল্যান্ডসে ইসলাম ধর্মাবলম্বী মানুষের সংখ্যা ১২ লাখ ১০ হাজার, যা দেশটির মোট জনসংখ্যার শূন্য দশমিক এক ভাগ৷
ছবি: AP
স্পেন
স্পেনে বর্তমানে ১১ লাখ ৮০ হাজার মুসলমানের বাস, যা দেশটির মোট জনসংখ্যার ২ দশমিক ৬ ভাগ৷