জার্মানিতে অভিবাসীদের মতো দেখতে মানুষেরা প্রতিদিন নানাভাবে বর্ণবাদের শিকার হন৷ এমন ৪৫ জন ব্যক্তির অভিজ্ঞতা নিয়ে সম্প্রতি একটি বই বের হয়েছে- নাম ‘পিপল অফ ডয়েচলান্ড'৷
মার্টিনা রিংক এবং সিমোন উসিফো ছবি: Sammy Hart/Eden Verlag
বিজ্ঞাপন
পার্সিয়ান বংশোদ্ভূত এবং যুক্তরাজ্য ও জার্মানিতে বেড়ে ওঠা মার্টিনা রিংক এবং নাইজেরীয় বাবা ও ফ্রেঞ্চ মায়ের সন্তান সিমোন উসিফো বইটির সম্পাদক হিসেবে কাজ করেছেন৷
রিংক বলছেন, মতাদর্শ অনুসারে বর্ণবাদের চেয়ে প্রতিদিনকার যে বর্ণবাদ সেটি অনেকসময় বেশি ক্ষতিকর হতে পারে৷ ‘‘প্রতিদিনকার বর্ণবাদ যে কারো কাছ থেকে আসতে পারে৷ এমনকি আপনাকে খুব ভালোভাবে চেনেন, এমন কোনো ব্যক্তিও তার অজান্তে বর্ণবাদী আচরণ করে বসতে পারেন,'' বলে মনে করেন তিনি৷
উসিফো বলেন, বর্ণবাদী মানুষের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেয়া এই বইয়ের উদ্দেশ্য নয়৷ বরং এর মাধ্যমে বর্ণবাদের ধরণ সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করতে চান তারা৷
বইয়ে যাদের অভিজ্ঞতা তুলে ধরা হয়েছে তার মধ্যে কয়েকজন তারকাও আছেন৷ যেমন লেখক ও অ্যাক্টিভিস্ট ড্যুৎসেন টেকাল, টিভি উপস্থাপক ও গায়ক মোলা আডেবিসি ও সাবেক পেশাদার ফুটবলার হানস সারপাই৷
বর্ণবাদ রোখার সাত উপায়
কিছু মানুষের কাজই বিভেদ সৃষ্টি করা, বিদ্বেষ ছড়ানো৷ বর্ণ, ধর্ম, জাতপাত, সংখ্যা, ভাষা বা সংস্কৃতির ভিত্তিতে বর্ণবাদ ছড়ানোর এসব প্রয়াস রুখে দেয়া খুব জরুরি৷ কীভাবে তা সম্ভব? দেখুন সাতটি উপায়...
ছবি: Imago Images/PhotoAlto/F. Cirou
বাকস্বাধীনতার ‘হামলা’ পরিহার
ব্যক্তি থেকে পরিবার, পরিবার থেকে সমাজ, সমাজ থেকে রাষ্ট্র- এভাবে ছোট থেকে খুব বড় পরিসরে বিভিন্ন রূপে থাকে বর্ণবাদ৷ মুখের কথায়ও তা ব্যাপকভাবে ছড়াতে পারে৷ ক্যানাডার অ্যালবার্টা সিভিল লিবার্টিজ রিসার্চ সেন্টার বলছে, মত প্রকাশের স্বাধীনতার নামে ‘ব্যক্তিগত মতামত’ হিসেবে যা কিছু বলা বা লেখার মাধ্যমেও তা ব্যাপক হারে ছড়ায়৷ তাই ধর্ম, বর্ণ, ভাষা, সংস্কৃতি ইত্যাদির নামে পক্ষপাত বা ঘৃণা প্রকাশ পরিহার করুন৷
ছবি: AP
উদারতায় শ্রেষ্ঠত্ব, অহঙ্কারে নয়
উদারতায় শ্রেষ্ঠত্ব, অহঙ্কারে নয়৷ ধর্ম, জাতপাত, গায়ের রং, উচ্চতা, ভাষা, আঞ্চলিকতা ইত্যাদি দিয়ে শ্রেষ্ঠত্ব জাহির করাও বর্ণবাদের নামান্তর৷ যে সমাজ বা রাষ্ট্রে এসব প্রবণতা যত কম, সেই সমাজ বা রাষ্ট্র তত বেশি বর্ণবাদমুক্ত৷
ছবি: Colourbox
অসহিষ্ণুতা ও উগ্রতা বর্জন
কারো মত বা কাজ পছন্দ না হলে তাকে শারীরিক বা মানসিকভাবে আঘাত করার প্রবণতা প্রায় সব সমাজেই দেখা যায়৷ এমন অসহিষ্ণু এবং বিদ্বেষপূর্ণ আচরণে বর্ণবাদ বিস্তৃতি পায়৷ গালাগাল, হুমকি, তুচ্ছতাচ্ছিল্য করা ইত্যাদিও এমন আচরণের অন্তর্ভুক্ত৷
ছবি: Imago/Indiapicture
ভুক্তভোগীর পাশে দাঁড়ান
যে কোনো স্থানে নির্দিষ্ট ব্যক্ত , শ্রেণি বা গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে অপপ্রচার, অশ্লীলতা কিংবা কুৎসা ছড়ানোর অপপ্রয়াস না রুখলে অপশক্তির সক্রিয়তা বাড়ে৷ ফলে ঘৃণার সঙ্গে সঙ্গে নানা পর্যায়ে বর্ণবাদও বাড়ে৷ মানবিক মূল্যবোধ সম্পন্ন প্রতিটি মানুষের উচিত এসব ক্ষেত্রে ভুক্তভোগীর পাশে দাঁড়ানো৷
ছবি: Imago/E. Biba
রুখে দিন সাইবার দুনিয়ার বর্ণবাদ
বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও চিকিৎসা শাস্ত্র বিষয়ক তথ্যের উৎস সায়েন্সডাইরেক্ট ডটকম দশ বছরের এক গবেষণা শেষে বলেছে, ইন্টারনেটের প্রসারের ফলে সাইবার দুনিয়ায় বর্ণবাদী তৎপরতা ব্য্যাপকহারে বেড়েছে৷ ব্যক্তি এবং গোষ্ঠীগতভাবে চালানো হচ্ছে বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন ধরণের বর্ণবাদী প্রচার৷ যে কোনো সমাজে বর্ণবাদ রুখতে সাইবার দুনিয়ায় মানবিকতার প্রসার জরুরি৷
ছবি: picture-alliance/imageBROKER/J. Tack
প্রমান রাখুন, কর্তৃপক্ষকে জানান
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মানহানিকর যে কোনো বক্তব্যের প্রমাণ রেখে দেয়া উচিত৷ অনেক সময় সম্মান এবং নিরাপত্তার স্বার্থে সাইবার অপরাধ দমন বিভাগকে প্রমাণসহ বিষয়টি জানানো জরুরি হয়ে পড়ে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/MAXAPP/R. Brunel
সংঘাত নয় সমর্থন চান
সব দেশের সব মানুষের সুখে শান্তিতে থাকার অধিকার আছে৷ কারো বর্ণবাদী আচরণে শান্তি বিঘ্নিত হলেও সংঘাতে না যাওয়া ভালো৷ সংঘাতে অনেক সময় সমস্যা বাড়ে৷ তাছাড়া সংখ্যা বা শক্তিতে পিছিয়ে থাকাদেরই বেশি টার্গেট করে বর্ণবাদীরা৷ সেক্ষেত্রে প্রতিকার বা আত্মরক্ষার জন্য ‘প্রতিবেশীদের’ সমর্থন বা সহযোগিতা চান৷
ছবি: picture-alliance/E.Topcu
7 ছবি1 | 7
‘কৃষ্ণাঙ্গ হিসেবে আপনি দেখতে সুন্দর'
১৯৯০ এর দশকে খ্যাতির চূড়ায় ছিলেন টিভি উপস্থাপক ও গায়ক মোলা আডেবিসি৷ সেই সময় একজন গোয়েন্দা তার সঙ্গে দেখা করে বলেছিলেন, নব্য নাৎসিদের একটি ব্যান্ডের ক্যাসেটের কাভারে তাকে ফাঁসি দেয়া ব্যক্তি হিসেবে দেখানো হয়েছে৷ এছাড়া একটি গানে তাকে নিয়ে অবমাননাকর কথা বলা হয়েছে৷
‘‘এর আগ পর্যন্ত বর্ণবাদ নিয়ে আমার কোনো অভিজ্ঞতা ছিল না,'' বলে বইয়ে লিখেছেন তিনি৷ এরপর থেকে তার জীবনযাপন পালটে গেছে বলে জানান তিনি৷ এখন যেখানেই যান নিরাপত্তা প্রহরী নিয়ে যেতে হয় তাকে৷ এছাড়া পেছনের দরজা দিয়ে স্টুডিওতে ঢোকেন বলেও জানান আডেবিসি৷ ‘‘বিমানে আমার সঙ্গে ইংরেজিতে কথা বলা হয়৷ প্রশংসা করার সময় বলা হয় ‘কৃষ্ণাঙ্গ হিসেবে আপনি দেখতে সুন্দর'!''
ছেলে হারানো মা
২০২০ সালে জার্মানির হানাও শহরে বর্ণবাদের শিকার হয়ে প্রাণ হারায় সার্পিল তেমিজ উনভারের ২২ বছর বয়সি ছেলে ফারহাত৷ স্কুলে সে শিক্ষকদের কাছ থেকে বর্ণবাদী সহিংসতার শিকার হয়েছিল বলে বইয়ে জানিয়েছেন উনভার৷ ‘‘হত্যাকারীকে কেন বন্দুক রাখতে দেয়া হয়েছিল,'' বইয়ে প্রশ্ন করেছেন তিনি৷ ‘‘অনেকগুলো ক্লু (সূত্র) ছিল যেগুলো নিয়ে পরে কাজ করা হয়নি৷ আমার চোখে, হত্যাকারীকে বন্দুকের লাইসেন্স দেয়ার মাধ্যমে আমাদের সন্তানদের হত্যা করতে বৈধভাবে অনুশীলন করার সুযোগ দেয়া হয়েছিল৷''
২০২০ সালের ১৪ নভেম্বর ছেলের জন্মদিনে ‘ফারহাত উনভার এডুকেশন ইনিশিয়েটিভ' প্রতিষ্ঠা করেন মা উনভার৷ এই সংস্থার মাধ্যমে স্কুল ও অফিসে বর্ণবাদ কতটা গেঁথে আছে তা দেখানোর চেষ্টা করা হয় বলে জানান তিনি৷
সরকারের প্রতিবেদন
জার্মানিতে বর্ণবাদ নিয়ে সম্প্রতি প্রথমবারের মতো একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে জার্মান সরকার৷ এতে বলা হয়, বর্ণবাদ শুধু শারীরিক সহিংসতা ও মৌখক হামলার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই৷ অভিবাসীদের মতো দেখতে মানুষেরা স্কুল, খেলার ক্লাব, বাসা খুঁজতে গিয়ে বা পুলিশের কাছ থেকে বৈষম্যের শিকার হন৷