শুধু বিদ্যুৎ গ্রিডের উপর নির্ভরশীল না থেকে বাসার জ্বালানির একাংশ উৎপাদন করলে কেমন হয়? জার্মানিতে সরকারি উৎসাহে বারান্দায় সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রবণতা বেড়েই চলেছে৷ বিনিয়োগের খরচও দ্রত উঠে আসছে৷
বিজ্ঞাপন
জার্মানিতে বাসার বারান্দায় সৌর বিদ্যুৎ কেন্দ্রের আকর্ষণ বেড়েই চলেছে৷ ব্যালকনি সোলার প্লান্ট ছাদের উপর ফটোভোল্টাইক সিস্টেমের মতোই কাজ করে, তবে অনেক ছোট আকারে৷ সেটা বারান্দায় বসানো যায়, বারান্দার রেলিংয়ে ঝুলিয়ে দেওয়া যায়৷ তাছাড়া সাধারণ ব্র্যাকেটই ইনস্টলেশনের জন্য যথেষ্ট৷
ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে রোব্যার্ট ডিটরিশ প্রায় এমন একশো ইউনিট বসিয়েছেন৷ গোটা প্রণালী ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, ‘‘সাধারণত বারান্দার সিস্টেমে একটি বা দুটি সোলার মডিউল থাকে৷ সেই মডিউলের ক্রিস্টাল সূর্যের আলোকে ডিসি কারেন্টে রূপান্তরিত করে৷ এই ইনভার্টার ডিসি-কে সাধারণ বাসায় ব্যবহৃত এসি বিদ্যুৎ হিসেবে ব্যবহারের যোগ্য করে তোলে৷ তারপর আমি এই গ্রাউন্ডেড প্লাগ সকেটে ঢুকিয়ে দেই৷ তখন সেই শক্তি বাসায় ব্যবহার করা যায়৷ আমি তখন সোলার সিস্টেম ব্যবহার করে মিক্সার বা কেটলি চালাতে পারি৷''
বারান্দায় উৎপাদিত বিদ্যুৎ দ্রুত ব্যবহার করলে সরাসরি উপকার পাওয়া যায়৷ বাড়তি বিদ্যুৎ পাবলিক গ্রিডে চলে যায়৷ জার্মানির ফেডারেল নেটওয়ার্ক সংস্থার বিশেষজ্ঞদের মতে, এই সিস্টেমের মাধ্যমে অনেক অর্থ সাশ্রয় করা যায়৷ সংস্থার প্রতিনিধি পেটার স্ট্রাটমান বলেন, ‘‘কোনো বাসায় ভালো রৌদ্রোজ্জ্বল অবস্থানে দক্ষিণমুখী একটা বড় বারান্দা থাকলে ব্যালকনি সিস্টেম ব্যবহার করে ১৫ শতাংশ বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যেতে পারে৷''
খুবই আকর্ষণীয় সম্ভাবনা বটে৷ কাগজেকলমে গোটা জার্মানি জুড়ে প্রায় চার লাখ বাসায় ব্যালকনি সিস্টেম চালু আছে৷ তবে পর্যবেক্ষকদের মতে, আসল সংখ্যা এর প্রায় দ্বিগুণ৷ ফাইনের ঝুঁকি থাকলেও অনেকে নিজেদের বারান্দার বিদ্যুৎকেন্দ্র নথিভুক্ত করেন নি৷ গোটা ইউরোপজুড়ে এমন প্রণালীর জনপ্রিয়তা বাড়ছে৷
সৌরতে ঝুঁকছে জার্মানি
04:09
সমালোচকদের মতে, এই সব প্যানেল খুবই দৃষ্টিকটু৷ বিশেষ করে হেরিটেজ তকমাযুক্ত ভবনের জন্য একেবারেই উপযুক্ত নয়৷ ঠিকমতো ইনস্টল করা না হলে সেগুলি ভবনের বাইরের অংশের ক্ষতি করতে পারে অথবা নিরাপত্তার জন্য হুমকি হতে পারে৷ তবে বাড়ির মালিক না হয়েও ভাড়াটিয়া হিসেবে এমন প্যানেল ব্যবহারের পথ আরো সহজ হয়ে উঠেছে৷
বার্লিনে পদার্থবিদ হিসেবে অলিভার লাং সোলার সেল নিয়ে গবেষণা করতেন৷ এখন তিনি ব্যালকনি সিস্টেম বিক্রি করেন৷ তিনি বলেন, বেশিরভাগ মডেলই চীনে তৈরি৷ সবচেয়ে সস্তারগুলির দাম দেড়শো ইউরোর মতো৷ ক্রেতাদের জন্য সেই বিনিয়োগের দ্রুত সুবিধা আদায়ের সুযোগ রয়েছে৷ অলিভার বলেন, ‘‘নিজেই সবকিছু জোড়া দিলে, বেশি দামি ব্র্যাকেট না বেছে নিলে, সবচেয়ে সস্তার মডেল কিনলে এবং বাসায় বেশি সময় কাটালে তিন থেকে চার বছরের মধ্যে খরচ উঠে আসবে৷ চীনে তৈরি এমন মডেল বেশ কয়েক বছর নির্ভরযোগ্যভাবে চালু থাকে৷''
কিন্তু প্রশ্ন হলো, এর ফলে কি পরিবেশেরও সুবিধা হচ্ছে? কারণ ফোটোভোল্টাইক প্যানেল তৈরি করতেও তো অনেক জ্বালানির প্রয়োজন হয়৷ বাস্তবে কিন্তু এমন উদ্যোগ অবশ্যই সার্থক৷ কারণ দুই বছরের মধ্যেই সেগুলি এত জ্বালানি উৎপাদন করে, যা উৎপাদন, পরিবহণ ও বাতিল হওয়ার পর ফেলে দেওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় জ্বালানির সমান৷ তাছাড়া সোলার প্যানেল সামগ্রিকভাবে বেশ টেকসই হয়ে উঠেছে৷
কাটারিনা শানৎস/এসবি
সৌরশক্তির বিস্তার: মিনিগ্রিড থেকে সোলার সিটি
সৌরশক্তি এখন বিশ্বের সবচেয়ে সস্তা জ্বালানি উৎস৷ বিভিন্ন উপায়ে তাই প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে শুরু করে বিভিন্ন কমিউনিটি, এমনকি বড় শহরগুলোও সূর্য থেকে শক্তি উৎপাদন করছে৷
ছবি: ME SOLshare Ltd.
সূর্য থেকে পানীয় জল
ইথিওপিয়ার রিমা গ্রামে পানির ট্যাংক ভর্তি করতে সোলার পাম্প ব্যবহার করা হচ্ছে৷ বিশুদ্ধ খাবার পানির কুয়াটি গ্রাম থেকে বেশ দূরে৷ সোলার পাম্প ব্যবহার করে সেই কুয়া থেকে গ্রাম অবধি পাইপের মাধ্যমে পানি আনা হয়৷ আগে ডিজেল পাম্প ব্যবহার করে এই কাজটি করা হতো৷ কিন্তু তখন প্রায়শই পাম্পটি নষ্ট হতো, কিংবা জ্বালানির অভাবে চালানো যেতো না৷ ২০১৬ সালে সোলার পাম্প চালুর পর থেকে আর কোনো ঝামেলা হচ্ছে না৷
ছবি: Stiftung Solarenergie
পাওয়ার গ্রিড ছাড়াই মোবাইল চার্জ করার ব্যবস্থা
পূর্ব আফ্রিকার অধিকাংশ প্রত্যন্ত অঞ্চল বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থা বা পাওয়ার গ্রিড-এর বাইরে৷ সেখানে মোবাইল চার্জ দিতে সোলার কিয়স্ক ক্রমশ জনপ্রিয় হয়ে উঠছে৷ কেনিয়ার অলকিরামেশন গ্রামের এই সোলার কিয়স্কে সামান্য টাকার বিনিময়ে মোবাইল চার্জ দেয়া যায়৷
ছবি: Solarkiosk GmbH
কৃষকদের জন্য বিদ্যুৎ
নিকারাগুয়ার উত্তরের গ্রাম মিরাফ্লোরের বাসিন্দারা মুলত কফি চাষ এবং চিরাচরিত কৃষি কাজ করেন৷ ২০১৩ সাল অবধি এই গ্রামে কোনো বিদ্যুৎ ছিল না৷ এরপর সেখানে সোলার প্যানেল বসানো শুরু হয়৷ বর্তমানে গ্রামটির ছয়শ’র বেশি পরিবার সৌরশক্তি ব্যবহার করছে৷
ছবি: Stefan Jankowiak
পয়সা বাঁচাচ্ছে সৌরশক্তি
জার্মানির দক্ষিণাঞ্চলের ফ্রাইবুর্গ শহরের এই হাউজিং প্রকল্পে চাহিদার চেয়ে বেশি সৌরশক্তি উৎপাদিত হচ্ছে৷ বিশ বছর আগে তৈরি এই ভবনগুলো এখন শহর উন্নয়নের মডেলে পরিণত হয়েছে৷ আধুনিক এসব ভবনে পুরনো ভবনের তুলনায় বিদ্যুৎ খরচ কম হয়৷ ফলে পরিবেশরক্ষার পাশাপাশি বাসিন্দাদের পয়সাও সাশ্রয় হচ্ছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/R. Haid
মাইক্রো-গ্রিডের মাধ্যমে প্রত্যন্ত অঞ্চলে বিদ্যুৎ
সোলশেয়ার নামে একটি স্টার্টআপ বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে মাইক্রোগ্রিডের মাধ্যমে সস্তা এবং বিশুদ্ধ বিদ্যুৎ সরবরাহ করছে৷ যেসব বাড়িতে সোলার প্যানেল রয়েছে, তারা তাদের প্রতিবেশি যাদের এখনো প্যানেল নেই তাদের সঙ্গে বিদ্যুৎ সংযোগ শেয়ার করছে৷ এই ব্যবস্থায় সৌরশক্তি ব্যবহারকারীরা নিজেদের প্রয়োজন মিটিয়ে অন্যদের বিদ্যুৎ দিচ্ছে, যা তাদের জন্য বাড়তি আয়ের এক উৎসও৷ দেশটিতে ডিজেলের বিকল্প হয়ে উঠছে সৌরশক্তি৷
ছবি: ME SOLshare Ltd.
কোভিড মোকাবিলায় সৌরশক্তি
হাইতির তাবার-এ অবস্থিত এই হাসপাতালটির জ্বালানির উৎস ছাদে বসানো সোলার প্যানেল৷ ৭১০ কিলোওয়াটের এই প্যানেলটি দেশটিতে বসানো এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বড় প্যানেল৷ করোনা রোগীদের এই হাসপাতালে চিকিৎসা দেয়া হয়৷ এখনকার সব চিকিৎসা সরঞ্জাম সৌরবিদ্যুতে চলে৷ আর এই ব্যবস্থা ব্যবহার করায় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের বছরে পঞ্চাশ হাজার ইউরোর মতো সাশ্রয় হচ্ছে, কেননা, তাদের আর ডিজেল কিনতে হচ্ছে না৷
ছবি: Biohaus-Stiftung.org
পুরো গ্রামের জন্য মিনিগ্রিড
কেনিয়ার তালেক গ্রামে দেড় হাজারের মতো বাসিন্দা রয়েছেন৷ গ্রামটি ২০১৫ সাল থেকে সৌরবিদ্যুৎ ব্যবহার করছে৷ তালেক-এর এক কোণায় একটি ৫০ কিলোওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন সোলার ফিল্ড তৈরি করা হয়েছে৷ সেটির মাধ্যমে তিনশ’ মানুষের জন্য বিদ্যুতের ব্যবস্থা করা হয়৷
ছবি: Imago Images/photothek/T. Imo
সৌরশক্তি ছাড়া পানি মিলবে না
মিশরের মরুভূমিতে পানি পাওয়া দুর্লভ ব্যাপার৷ আর এ কারণেই ইল-ওয়াহাট ইল-বাহারিয়া ওয়াসিস-এ এই সোলার প্ল্যান্টটি স্থানীয় বাসিন্দাদের জন্য খুবই প্রয়োজন৷ এই প্ল্যান্টটি দিয়ে ওয়াটার পাম্প চালু করা হয়, যেটি ছাড়া কৃষি কাজ অসম্ভব৷ মরুভূমির অন্য সব স্থানের মতো এখানেও অবশ্য সোলার প্যানেলটির উপর দিয়ে নিয়মিত বালু সরাতে হয়৷
ছবি: Joerg Boethling/imago images
২০২৫ সালের মধ্যে ‘ক্লাইমেট নিউট্রাল’
ডেনমার্কের রাজধানী কোপেনহেগেন ২০২৫ সালের মধ্যে ‘ক্লাইমেট নিউট্রাল’ হতে চায়৷ আর এ কারণেই শহরটিতে পুর্নব্যবহারের উপযোগী জ্বালানির ব্যবহার ক্রমশ বাড়ানো হচ্ছে৷
ছবি: picture alliance / Zoonar
আইডিয়া আদানপ্রদান
জার্মানির পশ্চিমাঞ্চলের শহর সারবেক-এর বাসিন্দার সংখ্যা ৭,২০০৷ শহরটিতে সৌর, বায়ু এবং বায়োমাস ব্যবস্থায় প্রয়োজনের বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়৷ ছোট কমিউনিটির জন্য পরিবেশবান্ধব জ্বালানির উৎপাদনের এক মডেলে পরিণত হয়েছে শহরটি৷ ছবিতে মার্কিন একদল প্রতিনিধিকে দেখা যাচ্ছে যারা শহরটির এই মডেল সম্পর্কে জানতে এসেছেন৷