নিঃসঙ্গ হয়ে পড়লে প্রবীণদের অনেকেই বড় বাড়ি থেকে ছোট কোনো বাসায় উঠতে চান৷ কেননা একার জন্য বড় বাড়ির তেমন প্রয়োজন পড়ে না৷ সামলানোও কঠিন৷ কিন্তু ছোট বাসা খুঁজতে গিয়ে হতবাক হয়ে যান তাঁরা৷
বিজ্ঞাপন
জার্মানির বিশেষ করে বড় বড় শহরগুলিতে বাড়িভাড়া বেড়েই চলেছে৷ আগের বড় বাসা ছেড়ে নতুন ছোট বাসায় উঠতে গেলে অনেক সময় বেশি ভাড়া গুনতে হয়৷ হামবুর্গ, মিউনিখ ও ফ্রাইবুর্গের মত শহরগুলিতে এই সমস্যা প্রবল, জানান জার্মান ভাড়াটে সমিতির প্রেস অফিসার উলরিশ রপার্টৎস৷ তাঁর মতে, মানুষের মধ্যে শহরে বসবাস করার প্রবণতা বাড়ছে৷ সে তুলনায় বাড়িঘর নির্মিত হচ্ছে কম৷
২০১১ সালে বার্লিনে ৬,০০০ বাড়ি নির্মিত হয়েছে৷ কিন্তু এই সময়ের মধ্যে শহরটিতে জনসংখ্যা বেড়েছে প্রায় ৪১,০০০৷
বড় শহরে সংকট বেশি
অন্যান্য বড় শহরগুলির অবস্থাও প্রায় একই রকম৷ বাড়ির সংখ্যা সীমিত৷ ভাড়াও উঁচু৷ বাড়িওয়ালারা নিজেরাই ভাড়া ঠিক করতে পারেন৷ এক্ষেত্রে আইনগত কোনো বিধিবিধান নেই৷ এর ফলে নতুন চুক্তি করতে গেলে ভাড়াটেদের ২০, ৩০ বা ৪০ শতাংশ বেশি ভাড়া গুনতে হয়৷
জার্মান ভাড়াটে সংঘ এই গলাকাটা ভাড়ার ব্যাপারে সোচ্চার হচ্ছে এখন৷ এক্ষেত্রে সরকারি উদ্যোগ প্রয়োজন বলে মনে করে প্রতিষ্ঠানটি৷ এজন্য আরো বেশি সুলভ মূল্যের ‘সোশাল হাউজিং' বা সামাজিক বাসস্থান নির্মাণ করা দরকার৷ ভাড়াটে সংঘের উলরিশ রপার্টৎস বলেন, ‘‘জার্মানির জনসংখ্যা হ্রাস পাচ্ছে৷ কথাটা এক অর্থে ঠিক হলেও পুরোপুরি নয়৷'' অর্থাৎ লোকসংখ্যা কমলেও গৃহস্থালির সংখ্যা বাড়ছে এখানে, বিশেষ করে বড় বড় শহরগুলিতে৷ অনেকে একাই একটি বাসায় বাস করছেন৷
কিছুটা সুরাহা করতে পারে সামাজিক বাসস্থান
এই সমস্যার সুরাহার জন্য ভাড়াটে সংঘ সামাজিক বাসস্থান নির্মাণের ওপর জোর দেয়৷ সরকারের আর্থিক সহায়তায় তৈরি করা হয় এইসব বাড়িঘর৷ ভাড়াও নির্দিষ্ট সীমা অতিক্রম করতে পারে না৷ এতে করে কম আয়ের মানুষরাও এইসব বাড়ি ভাড়া করতে পারেন৷ জার্মানিতে সামাজিক বাড়িঘরের ঐতিহ্য বহু দিনের, সেই ‘ভাইমার রিপাবলিক'-এর সময়, ১৯২০-এর দশক থেকে৷ সেই সময়েই প্রথম নিম্ন আয়ের মানুষদের জন্য একটি ভাল বসতি গড়ে ওঠে৷
জার্মান অর্থনৈতিক ইন্সটিটিউটের মিশাইল ফোগটল্যান্ডার এ ব্যাপারে অবশ্য সন্দিহান৷ তাঁর ভাষায়, ‘‘কেবলমাত্র অল্পসংখ্যক দুঃস্থ মানুষের জন্য সরকারি সহায়তায় বাড়ি নির্মাণ করা সম্ভব৷ কিন্তু নিম্ন আয়ের মানুষের সংখ্যা কম নয়৷ যেমন কোলোন শহরেই ৫০ শতাংশ ভাড়াটে সামাজিক বাড়ির জন্য অনুমোদন পেতে পারেন৷''
জার্মানিতে বাড়ি সমস্যায় অভিবাসীরা
অভিবাসীদের বিভিন্ন ক্ষেত্রেই সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়৷ তবে বাড়ির সমস্যাকে একটি বড় সমস্যা হিসেবে ধরা যেতে পারে৷এ সমস্যা জার্মানিতে বসবসারত তুর্কিদের মধ্যেই বেশি দেখা যায়৷ কারণ জার্মানিতে প্রায় ৪০ লাখ তুর্কি আছেন৷
ছবি: Suzheh.sub.ir
অভিবাসী তুর্কিদের সমস্যা বেশি
জার্মানিতে অভিবাসীদের বিভিন্ন ক্ষেত্রেই সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়৷ এগুলোর মধ্যে বাড়ির সমস্যাকে একটি বড় সমস্যা হিসেবে ধরা যেতে পারে৷ জার্মানিতে অভিবাসীদের মধ্যে তুর্কিদের সংখ্যাই সবচেয়ে বেশি প্রায় ৪০ লাখ৷ কাজেই সমস্যাটাও ওদের ক্ষেত্রেই বেশি দেখা যায়৷
ছবি: picture-alliance/dpa
শীতকালে ঠান্ডায় কষ্ট পায়
তুর্কিদের সাধারণত বাসা ভাড়া দেওয়া হয় পুরনো এলাকায় বহু বছরের পুরনো বাড়িগুলোয়৷ সেই সব বাড়িতে হয়ত দরজা ঠিকমতো বন্ধ হয় না বা জানালা দিয়ে বাতাস ঢোকে বা খানিকটা খোলা থাকে৷ অথবা শীতকালে হিটার কাজ করে না, অর্থাৎ ঠান্ডায় কাটাতে হয়৷ বাড়ির মালিককে কয়েকবার বলেও ঠিক করানো যায়নি৷ এভাবেই জানান তিন দশক আগে তুরস্ক থেকে জার্মানিতে আসা আহমেদ খালিফি৷
ছবি: DW/C. Ruta
বাড়ির অবস্থা অস্বাস্থ্যকর
আহমেদ খালিফির ছেলে আদেলের বাড়িতেও প্রায় একই সমস্যা৷ বাড়িটি ৪০ বছরের পুরনো হওয়ায় খুবই স্যাঁতসেঁতে, অন্ধকার এবং অস্বাস্থ্যকর৷ এ ব্যাপারে অবশ্য বাড়িওয়ালার মাথা ব্যথা নেই, কয়েকবার বলেও কোনো কাজ হয়নি৷
ছবি: DW/C. Ruta
অবশেষে নিজেই দায়িত্ব নেন
আবদাল ১৫ বছর এ বাড়িতে আছেন, কিন্তু একবারও রঙ করা হয়নি৷ আর সেকথা বাড়ির মালিককে কয়েকবার বলায় তিনি জানিয়ে দিয়েছেন যে, প্রয়োজনে তিনি যেন নিজেই এ কাজ করে নেন৷ তাই আবদাল এ কাজ ভালো না জানা সত্ত্বেও নিজেই করছেন৷
ছবি: picture-alliance/dpa/dpaweb
শীতের কথা ভেবে ভীত
একটি মাত্র ঘর আর সেখানেই বাচ্চাদের নিয়ে থাকেন আলিয়া৷ ঘরে যেসব জিনিসের জায়গা হয় না, সেসব জিনিস স্থান পেয়েছে বাড়ির বারান্দায়৷ কিন্তু শীতের সময় এসব প্রয়োজনীয় জিনিসের কি হবে – তা ভেবে অস্থির আলিয়া৷ এই অবস্থা অবশ্য শুধু আলিয়ার একার নয়৷
ছবি: DW/C. Stefanescu
অভিবাসীদের বেশি সন্তান
অভিবাসীদের বাড়ির বড় সমস্যা৷ তার কারণ, তাঁরা বড় শহরগুলোর ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় বসবাস করতে পছন্দ করেন৷ তাছাড়া জার্মানদের তুলনায় অভিবাসীরা কম রোজগার করেন এবং তাঁদের সন্তান সংখ্যা বেশি হওয়ায় বাড়ি পেতেও অসুবিধা হয়৷ এছাড়া একই ধরণের বাড়ির জন্য জার্মানদের তুলনায় তাঁদের কাছে বেশি ভাড়াও চাওয়া হয়৷
ছবি: picture-alliance/ZB
বাড়ির অবস্থা করুণ
অভিবাসীদের বাসস্থান সমস্যা অবশ্য নতুন সমস্যা নয়৷ অভিবাসীরা যেসব এলাকায় থাকেন সেই পুরনো বাড়িগুলোকে ঠিকঠাক না করানোয়, দিনদিন সেগুলি জরাজীর্ণ হয়ে পড়ছে৷ এই অবস্থা নিদিষ্ট কোনো শহরে নয়, প্রায় শহরেই এই একই অবস্থা৷
ছবি: Fars
আগুনে পরিবারের আট জনের মৃত্যু
প্রায় চার মাস আগে বাডেন-ভ্যুর্টেমব্যার্গের বাকনাং শহরে একটি বাড়ির বৈদ্যুতিক লাইন ছিল বিপজ্জনক এবং একথা বারবার মালিককে বলার পরও তা ঠিক করা হয়নি৷ যার ফল হয় মর্মান্তিক৷ ঘর গরম বা পানি গরমের জন্য ব্যবহার করা হতো কাঠের চুল্লি৷ ঐ বাড়িতেই আগুন লেগে একজন তুর্কি মা তাঁর সাত সন্তানসহ মারা যান৷ ছবিতে বাকনাং শহরের কিশোর-কিশোরীরা মৃত পরিবারের প্রতি ফুল আর মোমবাতি দিয়ে শ্রদ্ধা জানাচ্ছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
বাড়ি মালিকদের মত
বাড়িওয়ালাদের মধ্যে কেউ কেউ মনে করেন, তুর্কি পরিবারগুলো অনেক বড়, সবসময় হৈচৈ লেগে থাকে এবং তেমন পরিষ্কার- পরিচ্ছন্ন নয়৷ আর সেজন্যই তাঁদের বাড়ি ভাড়া দেওয়ার ব্যাপারে কিছুটা আপত্তি থাকে বাড়িওয়ালাদের৷
ছবি: picture-alliance/dpa
তরুণদের ভিন্নমত
বয়স্ক অভিবাসীরা বাসস্থানের ব্যাপারে যতটা বৈষম্যের শিকার হন বলে মনে করেন, এই প্রজন্মের তুর্কিরা তেমনটা মনে করে না৷ সম্ভবত এই প্রজন্মের ছেলে-মেয়েরা জার্মান ভাষা ভালো জানার কারণেই এমনটা ঘটছে৷
ছবি: Suzheh.sub.ir
10 ছবি1 | 10
অনেক সময় সরকারি সহায়তায় নির্মিত বাড়ির সুবিধা ভোগ করেন এমন সব মানুষ, যাদের কিছুটা বেশি ভাড়া দেওয়ার সামর্থ্য আছে৷
নেতিবাচক দিকও রয়েছে
এর আরেকটা নেতিবাচক দিক হলো, এর ফলে এক ধরনের ‘ঘেটো' সৃষ্টি হয়৷ শহরের যে সব অঞ্চলে সামাজিক বাড়িঘর তৈরি করা হয়, সেসব জায়গায় সাধারণত নিম্ন আয়ের ও বেকার মানুষজনই বসবাস করেন৷ এই সব এলাকায় অপরাধ প্রবণতাও বেড়ে যায়৷ আর তাই যাদের সামর্থ্যে কুলায়, তারা অন্য কোনো জায়গায় চলে যান৷
তাই ভাড়াটে সংঘ মনে করে, শুধু সামাজিক বাসস্থান নির্মাণই সমস্যার সমাধান করতে পারে না৷ ড্যুসেলডর্ফ ও হামবুর্গের মত বড় শহরগুলিতে বাড়িভাড়া যাতে সাধারণ মানুষের আয়ত্তের মধ্যে আসতে পারে, সে জন্য ‘ভাড়া ব্রেক' করার বিধান থাকতে হবে৷ অর্থাৎ বাড়ির মালিকরা যাতে ইচ্ছামত ভাড়া বাড়াতে না পারেন, সে ব্যবস্থা থাকতে হবে৷
সুরাহার পথ – শহর ছাড়া?
বাভারিয়া রাজ্য সরকার সম্প্রতি মিউনিখ ও আরো কয়েকটি শহরে এই ধরনের নীতিমালা চালু করেছে৷ এক্ষেত্রে ভাড়াটেদেরও সচেষ্ট হতে হবে৷ মিশাইল ফোগটল্যান্ডার যারা বাসা খুঁজছেন, তাদের পরামর্শ দেন, ‘‘শহর থেকে বাইরে বসবাসের ব্যাপারে ব্যাপারে চিন্তাভাবনা করতে৷ শহরের বাইরেও এমন অনেক জায়গা আছে, যেখানকার পরিবহন ব্যবস্থা ভালো৷'' তাই তো বলতে হয়, ‘ছাড়ো শহর ছাড়ো'৷