সপ্তাহান্তে জার্মানির কেমনিৎস শহরে উগ্র দক্ষিণপন্থিদের তাণ্ডব ও পালটা বিক্ষোভের জের ধরে বিদেশি বিদ্বেষ নিয়ে বিতর্ক আবার দানা বাঁধছে৷ সরকার এই ঘটনার তীব্র নিন্দা করেছে৷
বিজ্ঞাপন
জার্মানির বিভিন্ন প্রান্তে বিদেশি বিদ্বেষ ও নব্য নাৎসি চিন্তাধারার বিচ্ছিন্ন বিকাশ ঘটলেও এ ক্ষেত্রে দেশের পূর্বাঞ্চল, বিশেষ করে স্যাক্সনি রাজ্যের বাড়তি বদনাম রয়েছে৷ গত সপ্তাহান্তে সেই রাজ্যের কেমনিৎস শহরে নব্য নাৎসিদের তাণ্ডব মারাত্মক আকার ধারণ করেছিল৷ রবিবার এক হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে তারা পথেঘাটে বিদেশিদের উপর নির্বিচারে হামলা চালায়৷ প্রায় ৮০০ মানুষের সমাবেশে বেশ কয়েকজন বিক্ষোভকারী হিংসাত্মক হয়ে ওঠে৷ পুলিশ বা আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী সেই তাণ্ডব থামাতে ব্যর্থ হয়৷ গোটা দেশে এমন ঘটনা নিয়ে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে৷
সোমবারও কেমনিৎস শহরে পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি৷ সন্ধ্যায় প্রায় ২,০০০ চরম দক্ষিণপন্থি ও তার প্রতিবাদে প্রায় ১,০০০ মানুষ পথে নেমেছিলেন৷ চরম দক্ষিণপন্থি ও বামপন্থিদের মধ্যে সংঘর্ষে কমপক্ষে ৬ জন আহত হয়েছে৷ দুই পক্ষ একে অপরের উপর আতসবাজিসহ নানা বস্তু নিক্ষেপ করে৷ ৪ জন চরম দক্ষিণপন্থি বিক্ষোভকারীর উপর হামলার ঘটনাও ঘটেছে৷ বামপন্থি বিক্ষোভকারীরা নব্য নাৎসি ভাবধারার বিরুদ্ধে স্লোগান দিতে থাকে৷ বামপন্থি রাজনৈতিক দল ‘ডি লিংকে' কেমনিৎস শহরে বিদেশি বিদ্বেষের বিরুদ্ধে সরব হয়ে উঠেছে৷ তবে চরম ডানপন্থি এএফডি দল জনতার এমন তাণ্ডবের প্রতি প্রচ্ছন্ন সমর্থন জানিয়ে বলেছে, রাষ্ট্র তার নাগরিকদের সুরক্ষা দিতে ব্যর্থ হলে মানুষই এভাবে পথে নেমে আত্মরক্ষা করবে৷
জার্মানির ফেডারেল সরকার কেমনিৎস শহরে অভিবাসীদের উপর হামলার তীব্র নিন্দা করেছে৷ এক সরকারি মুখপাত্র বলেন, কেমনিৎস শহরের কিছু অংশে রবিবার যা ঘটেছে এবং ভিডিওতে যা রেকর্ড করা হয়েছে, সংবিধানভিত্তিক রাষ্ট্রে তার কোনো স্থান নেই৷ জনতা ভিন্ন চেহারা বা ভিন্ন ঐতিহ্যের মানুষকে বাছাই করে তাদের উপর হামলা চালাবে এবং রাজপথে ঘৃণা ছড়াবে, এমন আচরণ বরদাস্ত করা হবে না৷ জার্মানির শহরগুলিতে এমন আচরণের কোনো স্থান নেই৷
স্যাক্সনি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মিশায়েল ক্রেচমারও কেমনিৎস শহরে হিংসার তীব্র নিন্দা করেন৷ তবে রাজ্য ও শহরের প্রশাসনের ব্যর্থতা নিয়েও সমালোচনার ঝড় উঠছে৷
রবিবার ৩৫ বছর বয়সি এক জার্মান ব্যক্তির হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগে ২৩ বছর বয়সি এক সিরীয় ও ২২ বছর বয়সি এক ইরাকিকে আটক করে আদালতে পেশ করা হয়েছে৷ সরকারি কৌঁসুলির মতে, কোনো সঙ্গত কারণ ছাড়াই তারা ছুরি নিয়ে ওই ব্যক্তির উপর হামলা চালিয়েছিল৷
কেমনিৎস শহরের ঘটনাবলির জের ধরে জার্মানির বিভিন্ন শহরে প্রতিবাদ বিক্ষোভ দেখা গেছে৷ ড্যুসেলডর্ফ শহরে প্রায় প্রায় দেড়শ' উগ্র দক্ষিণপন্থি বিক্ষোভ করে৷ প্রায় ২৫০ জন তাদের কর্মকাণ্ডেরও প্রতিবাদ জানিয়েছে৷
হলোকস্টের চিত্রকলা
নাৎসি বন্দিশিবিরে মৃত্যুর দিন গোণার অবসরেও ছবি এঁকে গেছেন শিল্পীরা৷ ইসরায়েলের ইয়াদ ভাশেম সংগ্রহশালা থেকে আনা কিছু ছবি এখন প্রদর্শিত হচ্ছে বার্লিনে৷
ছবি: Collection of the Yad Vashem Art Museum, Jerusalem
রঙিন ‘ঘেটো’
‘ঘেটো’ বলতে বোঝায় শহরের সেই সংকীর্ণ অংশ, ইহুদিদের যেখানে থাকতে বাধ্য করা হতো৷ পোল্যান্ডের লুড্জ শহরের ঘেটোর এই ছবিটি এঁকেছিলেন ইয়োসেফ কোভনার, যিনি হলোকস্ট থেকে প্রাণ বাঁচাতে সক্ষম হয়েছিলেন৷ ‘হলোকস্টের চিত্রকলা: ইয়াদ ভাশেম সংগ্রহশালা থেকে ১০০টি চিত্র’, এই নাম দিয়ে বার্লিনে জার্মান ঐতিহাসিক সংগ্রহশালায় কোভনার ও অন্যান্য হলোকস্ট শিল্পীদের শিল্পকর্ম প্রদর্শিত হচ্ছে৷
ছবি: Collection of the Yad Vashem Art Museum, Jerusalem
উদ্বাস্তু
প্রদর্শনীতে যে ৫০ জন শিল্পীর ছবি প্রদর্শিত হচ্ছে, তাদের মধ্যে ২৪ জন প্রাণ হারিয়েছিলেন নাৎসিদের হাতে৷ নিহতদের মধ্যে ছিলেন বিশিষ্ট চিত্রশিল্পী ফেলিক্স নুসবাউম, যিনি ১৯৪৪ সালে আউশভিৎসে প্রাণ হারান৷ তাঁর ‘উদ্বাস্তু’ ছবিটি আঁকা হয় ব্রাসেলসে, ১৯৩৯ সালে৷ নুসবাউম ছবিটিতে নির্বাসনের অবর্ণনীয় যন্ত্রণা তুলে ধরতে চেয়েছিলেন৷
ছবি: Collection of the Yad Vashem Art Museum, Jerusalem
আত্মপ্রতিকৃতি
শার্লট সালোমন-এর ছবি এর আগেও জার্মানিতে প্রদর্শিত হয়েছে৷ তাঁর সাতশ’র বেশি ছবির একটি সংগ্রহে দেখা যায়, ইহুদি হিসেবে শার্লট বার্লিনে কী ধরনের জীবন কাটিয়েছিলেন৷ পরে তিনি দক্ষিণ ফ্রান্সে আশ্রয় নেন, কিন্তু ১৯৪৩ সালে তাঁকে সেখান থেকে ধরে আউশভিৎসে পাঠিয়ে দেওয়া হয় এবং বন্দিশিবিরে পৌঁছানোর সঙ্গে সঙ্গে তাঁকে হত্যা করা হয়৷ শার্লট তখন সন্তানসম্ভবা৷
ছবি: Collection of the Yad Vashem Art Museum, Jerusalem
লুকনো মেয়েটির আঁকা ছবি
নেলি টল ও তাঁর মা ইহুদি হওয়া সত্ত্বেও পোল্যান্ডের লুভভ শহরে প্রাণে বাঁচেন কেননা তাঁদের খ্রিষ্টান বন্ধুরা তাঁদের লুকিয়ে রেখেছিলেন৷ একা ঘরে আটক নেলি জলরং দিয়ে ছবি এঁকে সময় কাটাতেন, যেমন ‘মাঠের মধ্যে মেয়েরা’ নাম দেওয়া এই ছবিটি৷ ৮১ বছর বয়সি নেলি টল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে বার্লিনে এসেছেন প্রদর্শনীর উদ্বোধন উপলক্ষ্যে৷
ছবি: Collection of the Yad Vashem Art Museum, Jerusalem
‘ব্যারাকের মাঝখানে রাস্তা’
লিও ব্রয়ার বন শহরের অধিবাসী ছিলেন, প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জার্মান কাইজারের হয়ে যুদ্ধও করেছেন৷ হিটলার ক্ষমতায় আসার পর ১৯৩৪ সালে তিনি প্রথমে দ্য হেগ ও পরে ব্রাসেলসে বসবাস করেন, শিল্পী হিসেবেই, তাঁর ছবিও তখন প্রদর্শিত হয়েছে৷ ১৯৪০ সালের পর ফ্রান্সের একাধিক শিবিরে অন্তরীণ হয়ে থাকেন লিও৷ সেখানকার অভিজ্ঞতা তুলিবদ্ধ করে রেখেছেন বিভিন্ন ছবিতে৷ লিও ব্রয়ার পরলোকগমন করেন ১৯৭৫ সালে, ঐ বন শহরেই৷
ছবি: Collection of the Yad Vashem Art Museum, Jerusalem
দুই শিল্পী
ফরাসি বন্দিশিবিরে লিও ব্রয়ার যে আলোকচিত্রশিল্পীর সঙ্গে নানাভাবে সহযোগিতা করেছিলেন – যেমন মঞ্চসজ্জায় – তাঁর নাম ছিল কার্ল রবার্ট বোডেক৷ দু’জনে গ্রিটিংস কার্ড ইত্যাদিও সৃষ্টি করেছেন৷ বোডেক-কে ১৯৪১ সালে অপরাপর শিবিরে নিয়ে যাওয়া হয় এবং শেষমেষ আউশভিৎসে পাঠানো হয়৷ সেখানেই তিনি নিহত হন ১৯৪২ সালে৷
ছবি: Collection of the Yad Vashem Art Museum, Jerusalem
শিল্পীর গুপ্তজীবন
বেড্রিশ ফ্রিটা থেরেজিয়েনস্টাট বন্দিশিবিরে সরকারি প্রচারপত্র ইত্যাদি তৈরির কার্যালয়ের প্রধান ছিলেন৷ অপরদিকে তিনি ও তাঁর সহকর্মীরা গোপনে নাৎসি ঘেটোগুলির বিভীষিকাকে ছবিতে ধরে রেখেছেন৷ ১৯৪৪ সালে তা ফাঁস হয়ে যাবার পর ফ্রিটাকে আউশভিৎসে জীবন দিতে হয়৷ থেরেজিয়েনস্টাট বন্দিশিবির মুক্ত হবার পর সেখানকার দেয়াল ও মাটির তলা থেকে ফ্রিটার আঁকা ২০০টি ছবি পাওয়া যায়৷
ছবি: Collection of the Yad Vashem Art Museum, Jerusalem
মৃত্যুর পরেও বন্ধুত্ব
লিও হাস তাঁর বন্ধু ফ্রিটাকে বন্দিশিবিরের জীবন নিয়ে ছবি আঁকতে নানাভাবে সাহায্য করেছিলেন৷ সাক্সেনহাউজেন বন্দিশিবিরে লিও হাস-এর ওপর নির্দেশ হয়, মিত্রশক্তিদের পাউন্ড ও ডলার নকল করার৷ যুদ্ধের পর হাস ফ্রিটার পুত্র টোমাসকে দত্তক নেন৷ এছাড়া হাস থেরেজিয়েনস্টাট বন্দিশিবিরে বেড্রিশ ফ্রিটার আরো চারশ’টি লুকনো ছবি আবিষ্কার করেছেন৷
ছবি: Collection of the Yad Vashem Art Museum, Jerusalem
ডাক্তারের ছদ্মবেশে শিল্পী
পাভেল ফান্টল থেরেজিয়েনস্টাটের শিল্পীমহলের সদস্য ছিলেন৷ ডাক্তার হিসেবে তিনি শিবিরের মধ্যে টাইফুস রোগীদের জন্য একটি ক্লিনিক চালাতেন৷ ফ্রিটার মতো তিনিও ধরা পড়েন, তাঁর উপর শারীরিক নিপীড়ন চালানো হয়; পরে তাঁকে আউশভিৎস বন্দিশিবিরে পাঠানো হয়৷ ১৯৪৫ সালের জানুয়ারি মাসে তাঁকে গুলি করে হত্যা করা হয়৷ তাঁর প্রায় ৮০টি ছবি থেরেজিয়েনস্টাট থেকে বার করে আনা সম্ভব হয়েছিল৷
ছবি: Collection of the Yad Vashem Art Museum, Jerusalem
কলা শিক্ষক
ইয়াকব লিপশিৎস যুদ্ধের আগে ভিলনিয়ুস-এর একটি কলা প্রতিষ্ঠানে অধ্যাপনা করতেন৷ ১৯৪১ সালে তিনি কাউনুস শহরের ঘেটোয় গিয়ে বাস করতে বাধ্য হন; সেখানে তিনি অপরাপর শিল্পীদের সঙ্গে গোপনে ঘেটো জীবনের ছবি আঁকতেন৷ ১৯৪৫ সালের মার্চ মাসে কাউফেরিং বন্দিশিবিরে তাঁর মৃত্যু ঘটে৷ যুদ্ধের পরে তাঁর স্ত্রী ও কন্যা কাউনুস ঘেটোয় ফিরে গিয়ে একটি কবরখানায় লুকনো ছবিগুলো উদ্ধার করেন৷ লিপশিৎস নিজেই সেগুলোকে লুকিয়ে রেখেছিলেন৷
ছবি: Collection of the Yad Vashem Art Museum, Jerusalem
চরম দুর্দশার মধ্যেও আত্মমর্যাদা
বার্লিনের জার্মান হিস্টোরিক্যাল মিউজিয়ামের এই প্রদর্শনী চলবে ৩রা এপ্রিল অবধি৷ ছবিগুলিতে একদিকে যেমন দেখতে পাওয়া যাবে নাৎসি বন্দিশিবিরের বিভীষিকা, অপরদিকে এই অমর শিল্পীরা যেন সেই বিভীষিকার মধ্যেই জীবনের জয়গান গেয়ে গেছেন৷ মরিৎস ম্যুলার-এর ‘শীতকালে বাড়ির ছাদে’ সেরকম একটি ছবি৷
ছবি: Collection of the Yad Vashem Art Museum, Jerusalem